প্রচার চলছে উত্তরপূর্বের তিন রাজ্যে নাকি বিজেপির বিজয় রথ খুব দৌড়চ্ছে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি দিল্লির দলীয় দপ্তরে বিজেপির ‘উত্তরপূর্ব জয়’ উদযাপন করতে উপস্থিত সকলকে মোবাইলের ফ্ল্যাশ লাইট জ্বালাতে অনুরোধ করেছেন৷ নাগাল্যান্ডে মুখ্যমন্ত্রীর শপথ গ্রহণ অনুষ্ঠানে যোগ দিতে তিনি উড়ে গিয়েছিলেন৷ ত্রিপুরাতেও তিনি এবং কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ দলের সভাপতি জয়প্রকাশ নড্ডাকে সাথে নিয়ে বিজেপির বিজয় সমাবেশে যোগ দিয়ে এসেছেন৷ কর্পোরেট মালিকদের পয়সায় চলা বিজেপির ধামাধরা সংবাদমাধ্যম প্রচার করছে বিজেপির বিরুদ্ধে দেশ জুড়ে সাধারণ মানুষের যত ক্ষোভের প্রকাশই ঘটুক, সারা দেশের কৃষকরা যতই বিক্ষোভে ফেটে পড়ুন, বিজেপি জিতছেই৷ তারা প্রচার করছে গ্যাসের দাম, নিত্যপ্রয়োজনীয় সমস্ত জিনিসের মূল্যবৃদ্ধি, ক্রমবর্ধমান বেকারি, আদানি-আম্বানিদের স্বার্থে বিজেপি সরকারের একের পর এক জনবিরোধী নীতি, জালিয়াতিতে অভিযুক্ত আদানি গোষ্ঠীর সাথে প্রধানমন্ত্রীর সম্পর্ক ইত্যাদি যে সমস্ত বিষয়গুলি নিয়ে দেশের মানুষ বিক্ষোভ জানাচ্ছেন তার কোনও অস্তিত্বই নেই। বাস্তবে বিজেপি তথা নরেন্দ্র মোদির থেকে এটা কেউ ভাল জানে না যে, মিডিয়া কথিত ‘মোদি ম্যাজিক’-এর কারসাজি আর চলছে না৷ বরং বিজেপি নেতারা প্রতিদিন জনসাধারণের তীব্র ক্ষোভের আঁচ টের পাচ্ছেন৷ তাই সামনের কর্ণাটক বিধানসভা নির্বাচন এবং ২০২৪-এর লোকসভা নির্বাচনে বিজেপির হাওয়া তুলতে উত্তরপূর্ব নিয়ে প্রচারের এই মরিয়া প্রচেষ্টা প্রধানমন্ত্রীর৷
কিন্তু উত্তরপূর্বে বিজেপি কি আদৌ বিরাট কোনও সাফল্য পেয়েছে? বাস্তব হল, তিন রাজ্যের নির্বাচনে মোট ১৮০টি আসনের মধ্যে বিজেপি পেয়েছে ৪৬টি৷ একমাত্র ত্রিপুরায় কোনও রকমে কান ঘেঁষে তারা সংখ্যাগরিষ্ঠতা পেয়েছে৷ ৬০ আসনের বিধানসভায় তাদের আসন ৩২, আর জোটসঙ্গী আইপিএফটি-র ১টি আসন ধরে তারা ম্যাজিক সংখ্যা থেকে মাত্র তিনটি বেশি পেয়েছে৷ গত বারের তুলনায় তাদের আসন কমেছে ১০টি, ভোট কমেছে ১১ শতাংশেরও বেশি৷ বহু আসনেই বিজেপির জয়ের ব্যবধান খুবই সামান্য৷ এমনকি তাদের মুখ্যমন্ত্রী জিতেছেন ১২৫৭ ভোটে৷ অনেক আসনে তারা এর থেকেও কম ভোটে জিতেছে৷
এবারের নির্বাচনের আগে ত্রিপুরা জুড়ে বিজেপি বিরোধী জনমত প্রবল ছিল৷ সরকারে বসার পর মাত্র পাঁচ বছরেই বিজেপির অপশাসনের বিরুদ্ধে সাধারণ মানুষের ক্ষোভ-বিক্ষোভ প্রবলভাবে ফেটে পড়তে চেয়েছে৷ তা চাপা দিতে বিজেপি একদিকে সারা রাজ্য জুড়ে প্রবল সন্ত্রাস চালিয়েছে৷ ভোটের বছরখানেক আগে মুখ্যমন্ত্রী বদল করতে হয়েছে তাদের৷ একদিকে তারা নানা উপজাতীয় গোষ্ঠীর প্রভাবশালী, উচ্চাকাঙক্ষী ও ক্ষমতালোভী মুষ্টিমেয় বিশিষ্টদের সাথে লেনদেন এবং বোঝাপড়া করে কিছু আসন পাওয়ার চেষ্টা করেছে৷ একই সাথে জনজাতিগুলির পরস্পরের মধ্যে বিরোধে উস্কানি দিয়েছে, নানা ভাষাভাষি মানুষের বিভেদে উস্কানি দিয়ে ভোটব্যাঙ্কের জঘন্য রাজনীতি করেছে৷ ত্রিপুরায় দীর্ঘদিন শাসন চালানো সিপিএম এবং কংগ্রেস সে রাজ্যের মানুষের কাছে এতটাই গ্রহণযোগ্যতা হারিয়েছে যে বিজেপিকে চাই না বলেও মানুষ বলতে পারেনি– সিপিএম-কংগ্রেসকে চাই৷ বিজেপির অপশাসনের বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ বামগণতান্ত্রিক আন্দোলন গড়ে তোলার জন্য এসইউসিআই(সি) বারবার আহ্বান জানালেও সিপিএম নেতৃত্ব তাতে কর্ণপাত করেননি৷ এই পরিস্থিতিতে বিজেপির রাজনীতিকে মোকাবিলা করে শক্তিশালী আন্দোলন এবং তার মধ্য দিয়ে বিকল্প রাজনৈতিক শক্তি গড়ে তোলা যায়নি৷ সিপিএম ভোটের স্বার্থে একদা মানুষের দ্বারা পরিত্যক্ত কংগ্রেসের সাথেই জোট করেছে৷ সে জোটও এই কারণেই মানুষের আস্থা অর্জন করতে পারেনি৷
ত্রিপুরাকে দু’টুকরো করে গ্রেটার তিপ্রাল্যান্ডের দাবিদার ‘তিপ্রা মথা’র সঙ্গে কংগ্রেস এবং সিপিএম উভয়েই তাদের অধিকাংশ দাবি মানার প্রতিশ্রুতি দিয়ে বোঝাপড়ার চেষ্টা চালিয়ে গেছে৷ সিপিএমের মুখ্যমন্ত্রী পদপ্রার্থীর বিরুদ্ধে তিপ্রা প্রার্থীও দেয়নি৷ আবার কংগ্রেস সিপিএমের সাথে তিপ্রার বৈঠকের বাইরেই লাইন দিয়ে দাঁড়িয়েছিল বিজেপি৷ তিপ্রার হয়ে জেতা কয়েকজন এমএলএ আবার ভোটের সামান্য আগেও ছিলেন বিজেপি-আইএফটিতে৷ এদিকে কংগ্রেসের এক প্রাক্তন রাজ্য সভাপতি এবং সিপিএমের এক এমএলএ ভোটের আগে বিজেপিতে যোগ দেন৷ সব মিলিয়ে সাধারণ মানুষের পক্ষে এই দলগুলির মধ্যে কোনও পার্থক্য খুঁজে পাওয়াই দুষ্কর৷ এর সুযোগে কেন্দ্রীয় সরকারের ক্ষমতা, নির্বাচন কমিশনের পক্ষপাতিত্ব ও রাজ্যের প্রশাসনের দলদাসত্বের জোরে আবার ক্ষমতায় বসেছে বিজেপি৷ কিন্তু এই জেতাটা যে কত দুর্বল, তা বোঝা যায় যখন ভোটে জেতার পর রাজ্যে বিজয় সমাবেশ করতে গিয়ে নরেন্দ্র মোদির মতো বাকসর্বস্ব নেতাও সম্পূর্ণ নীরব থাকেন৷ ভোটে জেতার পরে আগরতলার এই বিজয় সমাবেশ কার্যত ফাঁকা ছিল৷ বোঝা যায়, বিজেপির জয় সাধারণ মানুষকে এতটুকু খুশি করতে পারেনি৷ বিজেপি যে তলায় তলায় ত্রিপুরা বিভাজনের দাবিদার তিপ্রা মথার সাহায্য ভোটে নিয়েছে তা এখন স্পষ্ট৷ কান ঘেঁষে পাওয়া সংখ্যাগরিষ্ঠতাকে রক্ষা করতে তারা তিপ্রা মথার সাথে নানা বোঝাপড়া করতে চাইছে৷ তিপ্রার নেতারাও নিজেদের আখের গোছানো ও এমএলএদের বিক্রি হওয়া আটকাতে বিজেপির সাথে বোঝাপড়া চাইছে৷ এই পরিস্থিতিতে সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে ত্রিপুরার জনজাতি এবং নানা ভাষাভাষী মানুষের মধ্যেকার সৌহার্দ্য, ভ্রাতৃত্ব৷ তাদের পরস্পরকে লড়িয়ে দিচ্ছে এই মতলববাজ নেতারা৷
নাগাল্যান্ডে বিজেপি নিজের জোরে একটি আসনেও জেতেনি৷ তারা এখানে গৌণ শক্তি৷ জোট শরিকের জোরেই তাদের জোর৷ এই রাজ্যে তারা ভোট পেয়েছে মাত্র ১৮ শতাংশ, ২০টি আসনে লড়ে জিতেছে ১২টায়৷ তাদের জোটসঙ্গী এনডিপিপি পেয়েছে ২৫টি আসন৷ তাদের জয়ের জন্য বিরোধীদের অনৈক্য যেমন কাজ করেছে, একই সাথে তারা নানা জনজাতির মধ্যেকার দ্বন্দ্বকে সুচতুরভাবে উস্কানি দিয়েছে৷ ভোটে জেতার পর মোদিজি এই জয়কে বিজেপির জয় বলে চালানোর চেষ্টা করছেন৷ অথচ জনজাতির মানুষের উপর কেন্দ্রীয় বাহিনীর গুলি চালানো, অত্যাচার ও অন্যান্য সমস্যা নিয়ে বিজেপি বিরোধী বিক্ষোভ সেখানে প্রবল৷ নাগাল্যান্ডের বিচ্ছিন্নতাবাদীদের নানা গোষ্ঠীকে বিভিন্ন প্রতিশ্রুতি দিয়ে বিজেপি সেখানে ভোটে লড়েছে৷ সারা দেশে বিজেপি গোরক্ষার জিগির তুললেও ভোটে জিততে নাগাল্যান্ডে তারা উল্টো সুর গেয়েছে৷ কেন্দ্রীয় সরকারি প্রকল্পগুলিতে প্রধানমন্ত্রীর ছবি যথেচ্ছ ব্যবহার করে নাগাল্যান্ডে সেগুলিকেই প্রচারের হাতিয়ার করেছে কেন্দ্রীয় শাসক দল৷
বিজেপি আরও ন্যক্কারজনক কাজ করেছে মেঘালয়ে৷ এখানে তারা জিতেছে মাত্র ২টি আসনে৷ জিতেই তারা ন্যাশনাল পিপলস পার্টি বা এনপিপির সরকারকে সমর্থন করে বসেছে৷ অথচ ভোটের আগেই এনপিপি নেতা কনরাড সাংমা দুর্নীতিগ্রস্ত বলে ব্যাপক প্রচার চালিয়েছিল বিজেপি৷ রাজ্যের ৬০টি আসনেই তারা এনপিপি জোটের বিরুদ্ধে লড়েছিল৷ ভোটে জেতার পর বিজেপি দেখে তারা কার্যত একঘরে৷ ফলে অতি দ্রুত তারা সরকারে কনরাড সাংমাকে সমর্থন জানায়৷ ভোট হওয়া ৫৯ আসনের মধ্যে এনপিপি ও বিজেপি দুই নির্দলের সমর্থনে প্রথমে ৩০জন এমএলএ নিয়ে সরকারের দাবি জানায়৷ বিরোধীরা ২৯টি আসনে পাল্টা সরকার গড়ার দাবি জিইয়ে রাখলে এনপিপি-বিজেপি নেতারা নামেন টাকার থলি নিয়ে এমএলএ কেনা বেচার খেলায়৷ তাতে যে এইচএসপিডিপি বিজেপির সাথে থাকবো না বলে ভোটের ফল ঘোষণার পরে এনপিপির সাথে জোট ছেড়ে বেরিয়ে এসেছিল, তারা আবার ঠিক দু’দিন বাদেই সরকারে সামিল হয়৷ একই কায়দায় সরকারে ভেড়ানো হয় ইউডিপি এবং পিডিএফের মতো ছোট আঞ্চলিক দলগুলিকে৷ এই ধান্দাবাজির রাজনীতিকেও কি বিজেপির পক্ষে মানুষের রায় বলে মানতে হবে?
উত্তরপূর্বের তিন রাজ্যের এই নির্বাচন আবার দেখালো, আজকের দিনে সংসদীয় নির্বাচনে জনগণের যথার্থ চাওয়া, তাদের মতামতের কোনও প্রতিফলনই ঘটে না৷ টাকার জোর আর মতলববাজ-ক্ষমতা নানা কূটকৌশল এবং মানি-মাসল-মিডিয়া পাওয়ারই এর চালিকাশক্তি৷