ভোটের প্রচারে গলা ফাটিয়ে বলে চলেছেন প্রধানমন্ত্রী– ‘উজ্জ্বলা’ যোজনায় ৭ কোটি পরিবার নাকি বিনা পয়সায় রান্নার গ্যাসের কানেকশন পেয়ে মহানন্দে দিন কাটাচ্ছেন৷ পেট্রল পাম্পের দেওয়াল জুড়ে শোভা পাচ্ছে বিজ্ঞাপন– ছবিতে দেখানো মহিলারা হাসি হাসি মুখে বলছেন, ‘এখন আর কাঠ কুটো কুড়িয়ে রান্নার কষ্ট নেই– প্রধানমন্ত্রীর দেওয়া এলপিজি আছে’৷ বিজেপি তথা নরেন্দ্র মোদি সাহেবের ধোঁকাবাজির খেলায় এটি যে আর এক সংযোজন, তা আবার ফাঁস হয়ে গেল৷
২০১৬ সালের ১ মে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি ঘটা করে দারিদ্রসীমার নিচে থাকা পরিবারগুলির মহিলাদের নামে ‘বিনামূল্যে’ রান্নার গ্যাসের কানেকশন দেওয়ার প্রকল্প উদ্বোধন করেছিলেন উত্তরপ্রদেশের বালিয়া জেলার গুড্ডি দেবীর হাতে প্রথম গ্রাহকের কাগজ তুলে দিয়ে৷ একই সাথে কেন্দ্রীয় পেট্রোলিয়াম মন্ত্রীকে নিয়ে বিজেপি সভাপতি অমিত শাহও গুজরাটে একজন গ্রাহকের হাতে উজ্জ্বলা যোজনার গ্যাসের বই তুলে দিয়ে উদ্বোধনে সামিল হয়েছিলেন৷ সেই গুড্ডি দেবী গত ৭ মে এক টিভি চ্যানেলের ইন্টারভিউতে জানিয়েছেন, রান্নার জন্য এখন তাঁর ঘুঁটের আগুনই ভরসা৷ কারণ গ্যাস সিলিন্ডার কেনবার মতো পয়সা তাঁর নেই৷ তাই বিগত তিন বছরের ৩৬ মাসে তিনি ১১টির বেশি সিলিন্ডার কিনতে পারেননি (এই সময়, ৮ মে ২০১৯)৷
তিনি একা নন, ‘রিসার্চ ইনস্টিটিউট অফ কমপ্যাশনেট ইকনমিকস’ সংস্থা এই বছর ফেব্রুয়ারি মাসে সমীক্ষা করে দেখেছে, উজ্জ্বলা গ্যাস গ্রাহকরাই নন মধ্যবিত্ত বা নিম্নবিত্ত পরিবারগুলির যাদেরই রান্নার গ্যাসের সংযোগ আছে তাদের ৯০ শতাংশই পুরোপুরি গ্যাসের উপর নির্ভর করে রান্না করতে পারেন না৷ কাঠকুটো, ঘুঁটে, কেরোসিনের মতো অন্য কোনও জ্বালানির উৎসের উপর নির্ভরশীল তাঁরা৷
কারণটা বোঝা অসম্ভব নয়৷ গুড্ডি দেবী নিজেও সেকথা বলে দিয়েছেন৷ তিনি যখন এই সংযোগ পেয়েছিলেন সেই সময় গ্যাসের সিলিন্ডার নিতে গেলে নগদ ৫২০ টাকা দিতে হত৷ এখন ডিলারকে দিতে হয় ৭৭০ টাকা৷ মাঝে আরও বেড়ে তা হয়েছিল প্রায় ৯০০ টাকা৷ ভর্তুকির নামে সবচেয়ে বড় ভাঁওতার কারবার করেছে বিজেপি সরকার৷ বিনা পয়সায় সংযোগ দেওয়ার নামে গ্রাহকদের প্রত্যেকের কাছ থেকে প্রথম চোটেই গ্যাস ওভেন এবং প্রথম সিলিন্ডারের দাম বাবদ নেওয়া হচ্ছে ১৭৫০ টাকা৷ গ্রাকককে ঠকানোর জন্য কেন্দ্রের বিজেপি সরকার তেল কোম্পানিগুলিকে নির্দেশ দিয়েছে প্রথম ১৭৫০ টাকাকে ঋণ হিসাবে ধরতে৷ অর্থাৎ দরিদ্র যে মহিলা বিনাপয়সার সংযোগ ভেবে উজ্জ্বলা যোজনায় গ্যাস নিচ্ছেন, অজান্তেই তাঁর ঘাড়ে চাপছে ঋণের বোঝা৷ তেল কোম্পানিগুলি ভর্তুকি থেকে এই টাকা উসুল করে নেবে৷ যে ১৬০০ টাকা ভর্তুকি বাবদ সরকারের দেওয়ার কথা তা তারা নিজের কাছেই রেখে দিচ্ছে৷ গ্রাহককে গ্যাস নিতে হচ্ছে বাজার মূল্যে৷ এখন কলকাতায় ভর্তুকিবিহীন গ্যাসের দাম ৭৪০টাকা, অর্থাৎ ভর্তুকি বাবদ গ্রাহকের ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্টে জমা পড়ার কথা ২৪০টাকা৷ কিন্তু তথাকথিত ‘বিনাপয়সা’র গ্যাস গ্রাহকরা একটি পয়সাও ভর্তুকি পাবেন না৷ ১৭৫০ টাকা শোধ না করা পর্যন্ত দারিদ্র সীমার নিচে থাকা পরিবারগুলিকে পুরো বাজার দামেই গ্যাস নিয়ে যেতে হবে৷ ১৬০০ টাকা ভর্তুকি তারপরের ৬টি সিলিন্ডারে দফায় দফায় পাবে উজ্জ্বলা যোজনার গ্রাহকরা৷ সমস্ত ডোমেস্টিক গ্যাস গ্রাহকদের জন্য যে ভর্তুকি বরাদ্দ, দরিদ্র হওয়ার অপরাধে সেটুকু থেকেও তাঁরা বঞ্চিত থাকবেন৷ দরিদ্র পরিবারের মহিলাদের সাথে চরম প্রতারণা ছাড়া এ আর কিছু নয়৷ অতীতের ঠগীরাও বোধহয় এমন নির্বিকার নিষ্ঠুরতায় হাসতে হাসতে মানুষের গলা কাটতে লজ্জা পেত!
স্বাভাবিকভাবেই গ্রামীণ দরিদ্র পরিবারগুলির পক্ষে এই বোঝা বয়ে চলা সম্ভব নয়৷ তাই তাঁরা সাবেক কাঠকুটো, ঘুঁটের ভরসাতেই রান্নার ব্যবস্থায় ফিরতে বাধ্য হয়েছেন৷ সরকার যতই দাবি করুক ৮০ শতাংশ গ্যাস গ্রাহক নিয়মিত গ্যাস নিচ্ছে, বাস্তব পরিস্থিতি ঠিক তার বিপরীত৷ পেট্রোলিয়াম মন্ত্রী নিজেই গত ডিসেম্বর মাসে সংসদে দাঁড়িয়ে বলেছেন ওড়িশার মতো রাজ্যে ৯৭ শতাংশের বেশি উজ্জ্বলা যোজনার গ্রাহক বছরে একটি বা দুটি সিলিন্ডার নিচ্ছেন৷ (ফ্রন্টলাইন ১২ এপ্রিল ২০১৯)৷ অন্যান্য রাজ্যের অবস্থাও ভাল নয়৷ সরকার হিসাবে যতই জল মেশাক, দেখা যাচ্ছে সারা দেশে প্রায় ৭৫ শতাংশ উজ্জ্বলা গ্রাহক সারা বছরে দুই থেকে তিনটির বেশি সিলিন্ডার কিনতে পারেন না৷ ডিলাররা হুমকি দিয়ে, মিথ্যে শাস্তির ভয় দেখিয়ে সিলিন্ডার কেনায় বলে কিছু জন গ্যাস কেনে, না হলে সেটুকু বিক্রিও হত না৷ কারণ মোদি সাহেবের গ্যাসের ধোঁকার বোঝা বওয়া দরিদ্র পরিবারগুলির পক্ষে প্রায় অসম্ভব৷
সরকারের ধামাধরা এবং ঘোলাটে বুদ্ধির কিছু বুদ্ধিজীবী চোখের জল ফেলে বলেন, পরিবেশ বান্ধব জ্বালানির মহান উপকারিতা গ্রামের মহিলারা বুঝতেই পারছেন না৷ সত্যিই কি তাই সরকার পরিবেশের কথা ভাবলে আম্বানি, আদানিদের মতো তেল কোম্পানির ধনকুবের মালিকদের স্বার্থে এলপিজি গ্যাস গ্রামের মানুষের ঘাড়ে চাপিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করত না৷ বরং গোবর গ্যাস, আনাজের খোসা–পাতা পচিয়ে তৈরি জৈব গ্যাস ইত্যাদি ব্যবহারের পরিকাঠামো গড়ে তুলত৷ যা অতি সহজেই গ্রামের মানুষের পক্ষে আয়ত্ত করা সম্ভব৷ এই সমস্ত জৈব গ্যাসের প্ল্যান্ট বানানোর যে প্রাথমিক খরচ সেটা সরকার জোগালে গ্রামীণ জনগণের বড় অংশের জ্বালানি চাহিদা এতেই মেটানো যায়৷ কিন্তু সে পথে হাঁটতে গেলে যে জনমুখী দৃষ্টি প্রয়োজন তা বিজেপির নেই৷ বিজেপি তো আর জনসেবা করার জন্য ধনকুবেরদের টাকায় ভোট লড়ছে না৷ যাদের টাকায় তাদের এত রমরমা সেই সব ধনকুবেরদের স্বার্থেই দরিদ্র মানুষের সাথে এই চরম ধোঁকাবাজি করছে বিজেপি সরকার৷