আদিবাসী ও পরম্পরাগত বনবাসীদের উচ্ছেদের যে সংবাদ বিভিন্ন খবরের কাগজে প্রকাশিত হয়েছে তাতে দেশের শুভবুদ্ধিসম্পন্ন মানুষ আতঙ্কিত৷ ১৩ ফেব্রুয়ারি সুপ্রিম কোর্টের বিচারপতি অরুণ মিশ্রের নেতৃত্বাধীন বেঞ্চের এক নির্দেশে ১৬টি রাজ্যের ১১ লক্ষ ২৭ হাজার ৪৪৬ জন আদিবাসী ও বনবাসী পরিবার তাদের বংশপরম্পরাগত ভাবে বসবাসের ভিটেমাটি থেকে উচ্ছেদ হবে (আনন্দবাজার পত্রিকা–২১.২.২০১৯)৷ কেন এই উচ্ছেদ? প্রকাশিত সংবাদ অনুযায়ী, জমির পাট্টা চেয়ে যাঁরা আবেদন করেছেন, তাঁদের মধ্যে যাঁরা উপযুক্ত প্রমাণপত্র দেখাতে পারেননি, তাঁরাই উচ্ছেদের সামনে পড়েছেন৷ পশ্চিমবঙ্গে ৯৫ হাজার ৯৫৮টি আবেদন আদিবাসী পরিবার থেকে আসে৷ তার মধ্যে ৫০ হাজার ২৮৮টি আবেদন খারিজ হয় এবং অন্যান্য চিরাচরিত বনবাসী পরিবারের ৩৬ হাজার ৪টি আবেদন আসে তার মধ্যে ৩৫ হাজার ৮৫৬টি আবেদন খারিজ হয়৷ টাইমস অফ ইন্ডিয়ার সংবাদ অনুযায়ী ‘গত ৩০ সেপ্ঢেম্বর ২০১৮ পর্যন্ত ৪২ লক্ষ আবেদন জমা পড়েছিল, তার মধ্যে ১৯.৩ লক্ষ আবেদন বাতিল হয়’৷
এই রায় কার্যকর হলে কমবেশি ১৯ লক্ষ আদিবাসী ও বনবাসী মানুষ রুটি–রুজির ন্যূনতম সুযোগ থেকে বঞ্চিত হবেন৷ এমনকী বসবাসের জন্য প্রয়োজনীয় কুঁড়ে তৈরির ন্যূনতম জমির অধিকারও হারাবেন৷ সকলেই জানেন, তাঁদের একটা বড় অংশ জঙ্গলের উপর নির্ভর করে দিনাতিপাত করেন৷ তাঁরা অন্যান্য কাজ প্রায় জানেনই না৷ গ্রামের বাইরে গঞ্জে বা শহরে উপার্জন করার মতো কাজ তাঁদের অজানা৷ এই অবস্থায় জঙ্গল থেকে তাঁদের সরিয়ে দিলে পথের ভিখারিতে পরিণত হওয়া ছাড়া তাঁদের অন্য কোনও পথ থাকবে না৷
আদিবাসী ও বনবাসীদের উচ্ছেদের এমন নির্দেশিকা এটাই প্রথম নয়৷ ২০০২ সালে কেন্দ্রীয় বন ও পরিবেশ মন্ত্রক এক নির্দেশিকায় জঙ্গলের জমিতে বংশপরম্পরায় বসবাসকারীদের দখলকারী আখ্যা দিয়ে তাঁদের উচ্ছেদের কথা বলে৷ এর ফলে সেই সময় এক কোটির বেশি আদিবাসী ও চিরাচরিত বনবাসী মানুষের সামনে উচ্ছেদের বিপদ দেখা দিয়েছিল৷ স্বাভাবিকভাবেই সেই নির্দেশিকার বিরুদ্ধে দেশের সমস্ত প্রান্তে প্রতিবাদ ধ্বনিত হয়েছিল৷ সমস্ত গণতন্ত্রপ্রিয় ও মানবতাবাদী সংগঠনগুলি সংগঠিতভাবে এর প্রতিবাদ করেছিল৷ প্রতিবাদের মুখে পড়ে ২০০৩ সালে প্রাক্তন বিচারপতি বি এন কৃপালের নেতৃত্বে কেন্দ্রীয় সরকার ন্যাশনাল ফরেস্ট কমিশন গঠন করে৷ এই কমিশনের সুপারিশক্রমে ফরেস্ট রাইট অ্যাক্ট ২০০৬ তৈরি হয়৷ আইনে বলা হয়, আইন প্রণয়নের দিন অবধি যাঁরা জঙ্গলের জমিতে বসবাস করেছেন বা জঙ্গলের জমি চাষ করে জীবন নির্বাহ করছেন তাদের এই জমির পাট্টা দিতে হবে৷
কংগ্রেসের মনমোহন সিং সরকার এই আইন প্রণয়ন করতে বাধ্য হলেও তা কার্যকর করেনি৷ এই আইন প্রণয়নের পরেও পশ্চিমবঙ্গে সিপিএম সরকার পাঁচ বছর ক্ষমতায় ছিল৷ ত্রিপুরায় ছিল আরও কয়েক বছর৷ তারাও এই আইন প্রয়োগ করে বনবাসীদের পাট্টা দেয়নি৷ আর বিজেপি সরকার কেন্দ্রে ক্ষমতায় এসে আইনে এমন কিছু শর্ত জুড়ে দিল যাতে আদিবাসীদের পাট্টা পাওয়াই জটিল হয়ে পড়ল৷ কী করল বিজেপি? তারা এই শর্ত জুড়ে দিল যে, জমির পাট্টা পেতে হলে তিন প্রজন্ম ধরে বসবাসের প্রমাণ দিতে হবে৷ তিন প্রজন্ম মানে ৭৫ বছর৷ আদিবাসীরা বনবাসীরা কী করে এই প্রমাণ জোগাড় করবে
আদিবাসী ও বনবাসী মানুষেরা আর্থ–সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও শিক্ষা সমস্ত দিক থেকেই পিছিয়ে৷ এখনও তাঁদের অধিকাংশই অশিক্ষিত৷ তাঁদের শিক্ষার সুযোগ নেই বললেই চলে৷ অনেকে দরখাস্ত লিখতেই জানেন না৷ এই অবস্থায় তাঁদের কাছ থেকে সঠিক পদ্ধতিতে পাট্টার জন্য আবেদনও আশা করা যায় না৷ অজ্ঞ, অশিক্ষিত, আইন কানুন সম্পর্কে ধারণাহীন মানুষগুলির কাছ থেকে এই নথি পাওয়া বাস্তবে অসম্ভব৷ তাছাড়া ঝড়, বৃষ্টি, কীটপতঙ্গ প্রভৃতির হাত থেকে তাঁদের নথি রক্ষা করার উপযুক্ত ব্যবস্থাটুকুও নেই৷ এমনকী যে সরকারি অফিসে রক্ষণাবেক্ষণের জন্য লক্ষ লক্ষ টাকা ব্যয়িত হচ্ছে সেখান থেকেও দরকারি নথি হারিয়ে যাচ্ছে৷ সেক্ষেত্রে এই মানুষগুলির কাছ থেকে এই নথি চাওয়ার অর্থ তাদের এই অধিকার অস্বীকার করার সমান৷ তা ছাড়া নথির প্রশ্ন আসছে কেন? এই দেশেই স্বাধীনতার অব্যবহিত পরে যখন পাকিস্তান থেকে উদ্বাস্তু হয়ে হাজার হাজার মানুষ এ দেশে এসেছিল তখন তারা পতিত জমি পরিষ্কার করে বসবাস করতে শুরু করল৷ সেখানে কলোনি গড়ে ডঠল৷ সরকার তাদের জমির পাট্টা দিয়েছিল৷ বসবাসের অধিকার দিয়েছিল৷ সেটা দেওয়া যদি সম্ভব হয়, তাহলে বংশপরম্পরায় যাঁরা জঙ্গলে বসবাস করছেন তাঁদের পাট্টা দেওয়া হবে না কেন? বসবাসটাই তো জীবন্ত প্রমাণ৷ আলাদা নথি চাওয়া হচ্ছে কেন? তবে কি সরকার এঁদের দেশের মানুষ মনে করে না
সরকারের ভূমিকা আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সনদের বিরোধী৷ এই সনদে বলা আছে, ১) প্রত্যেক পরিবারের সমানাধিকার থাকবে, ২) আদিবাসীদের সেই সমস্ত জমির অধিকার রক্ষা করতে হবে যেগুলি তাঁরা বংশানুক্রমিকভাবে দখল করে আসছে৷ ৩) আদিবাসীরা যে সকল জমি, এলাকা এবং সম্পদ চিরাচরিতভাবে অধিকার করে আছেন, দখল করে আছেন বা ব্যবহার করে আসছেন তা রক্ষা করতে হবে ৪) জীববৈচিত্র্য রক্ষার ক্ষেত্রে আদিবাসীদের জ্ঞান সংরক্ষণের কথা বলা হয়েছে এবং ৫) রিও–র পরিবেশ সংক্রান্ত আন্তর্জাতিক ঘোষণাতে বলা হয়েছে, পরিবেশ রক্ষায় আদিবাসীদের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা আছে৷ এই ঘোষণাগুলির অন্যতম স্বাক্ষরকারী দেশ ভারত৷ এ সত্ত্বেও আদিবাসী ও বনবাসীদের উচ্ছেদের এই নির্দেশ কার স্বার্থে, কোন স্বার্থে?
এদেশে জঙ্গল যে ধ্বংস হচ্ছে সেটা কি আদিবাসী–বনবাসীদের জন্য? ‘সেন্টার ফর সায়েন্স অ্যান্ড এনভায়রনমেন্ট’–এর তথ্য বলছে, ২০০৭ থেকে ২০১১ এর মধ্যে সরকার ৮ হাজার ৭৩৪টি প্রোজেক্টের অনুমোদন দিয়েছে জঙ্গল কেটে প্রকল্প করার জন্য৷ এর ফলে ১.৯৮ লক্ষ হেক্টর জঙ্গল ধ্বংস হয়৷ তথ্য বলছে, ১৯৮১ সালের পর থেকে ডেভেলপমেন্ট প্রকল্পের জন্য মোট জঙ্গলের ২৪.৩ শতাংশ ব্যবহার করা হয়েছে৷ আরও দেখা গেছে, ২০০৯ সালে জঙ্গল কাটা হয়েছে ৮৫ হাজার ৮৪৯ হেক্টর৷
বনাধিকার আইন ২০০৬ অনুযায়ী, আদিবাসী এলাকাতে গ্রামসভার অনুমতি ছাড়া ওই জমি অন্য কোনও কাজে ব্যবহার করা যাবে না৷ কিন্তু দেখা যাচ্ছে, পুঁজিপতিদের ওই জমি পাইয়ে দিতে বহুক্ষেত্রে জালিয়াতি করে গ্রামসভার অনুমতি জোগাড় করতে সরকারগুলি তৎপর৷ যেমন, ছত্তিশগড়ের দান্তেওয়াড়ায় আনারুলা গ্রামে সরকারি উদ্যোগে ৯১ জন লোককে নিয়ে গ্রামসভা করা হয়৷ তাঁদের এক জনও সেখানকার বাসিন্দা নন৷ এই ভাবে জালিয়াতি করে গ্রামসভার অনুমতির দলিল তৈরি হয়ে গেল৷ ঝাড়খণ্ডের গোড্ডা জেলায় কয়েক হাজার একর জমির দখল নিল প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির প্রিয়পাত্র আদানি গোষ্ঠী৷ তাদের হয়ে প্রমাণ জোগালো বিজেপি পরিচালিত ঝাড়খণ্ড সরকার৷ দখলদারি সহজ করতে পুলিশ দিয়ে সাহায্য করল৷ এইভাবে ওড়িশার নিয়মগিরিতে বহুজাতিক বেদান্ত গোষ্ঠীর পক্ষে দাঁড়াল রাজ্যের বিজেডি সরকার৷ তামিলনাড়ুর তুতিকোরিনেও এভাবেই জঙ্গলের জমি তুলে দেওয়া হয়েছে শিল্পপতিদের হাতে৷ এই সমস্ত পুঁজিপতিরাই মুনাফার লক্ষ্যে প্রকৃতিকে খামখেয়ালিভাবে ব্যবহার করছে৷ এদের দ্বারাই জীববৈচিত্র্য ধ্বংস হচ্ছে৷ বিপরীতে আদিবাসীরা বুক আগলে বন রক্ষা করছেন৷
জঙ্গলে বসবাসকারী আদিবাসী ও বনবাসী মানুষ এই বঞ্চনার বিরুদ্ধে যুগ যুগ ধরে লড়াই আন্দোলন করে আসছেন৷ ব্রিটিশ শাসনের প্রথম যুগে যে আদিবাসী বিদ্রোহ হয়েছিল যা চুয়াড় বিদ্রোহ নামে পরিচিত তার থেকে শুরু করে মুণ্ডা বিদ্রোহ, ভূমিজ বিদ্রোহ, সিদো–কানহু’র নেতৃত্বে সাঁওতাল বিদ্রোহ যা ‘হুল’ নামে পরিচিত এবং বিরসা মুণ্ডার নেতৃত্বে উলগুলান– এই সকল লড়াই–আন্দোলনগুলিই ছিল জল–জমি–জঙ্গলের অধিকারের দাবিতে৷ লড়াই করার মধ্য দিয়ে তাঁরা একটার পর একটা অধিকার অর্জন করেছিলেন৷ যেমন ডইলকিনসন্স রুল, ছোটনাগপুর টেন্যান্সি অ্যাক্ট ও সাঁওতাল পরগণা টেন্যান্সি অ্যাক্ট প্রভৃতি৷ কিন্তু স্বাধীন ভারতে দীর্ঘ কংগ্রেসি শাসনে এবং বর্তমান বিজেপি শাসনে এই আইনগুলি বারে বারে পাল্টে দিয়ে আদিবাসীদের সাংবিধানিক অধিকার খর্ব করার অপচেষ্টা চলছে৷
স্বাধীন ভারতে উন্নয়নের নামে বহু সরকারি–বেসরকারি কলকারখানা, জলাধার, খনি, ড্যাম, রাস্তা নগরায়ন প্রভৃতির জন্য লক্ষ লক্ষ আদিবাসী মানুষ উচ্ছেদ হয়েছেন৷ তাঁদের পুনর্বাসনের সুনির্দিষ্ট ব্যবস্থা করা হয়নি৷ উচ্ছেদ হওয়া পরিবারগুলিকে সরকারি নামমাত্র আর্থিক ক্ষতিপূরণ দিয়ে দায়িত্ব শেষ করেছে, যা দিয়ে তাঁদের নতুন জায়গায় পুনর্বাসন হতে পারে না৷ তাঁরা ছিন্নমূল হয়ে পড়েন৷ এই উচ্ছেদের বিরুদ্ধে বহু আন্দোলন হয়েছে৷ সরকার পুলিশ ও আধাসামরিক বাহিনী নামিয়ে তা নির্মমভাবে দমন করেছে৷
বিজেপি কংগ্রেসের মতো চিহ্ণিত বুর্জোয়া দল পুরোপুরি দেশের ধনিক শ্রেণির সেবাদাসে পরিণত হয়েছে৷ ধনিক শ্রেণি সর্বোচ্চ মুনাফার জন্য সমস্ত মানবিক মুল্যবোধকে পদদলিত করে গরিব মানুষদের উচ্ছেদ করছে৷ এই সমস্যার সমাধান আন্দোলন ছাড়া সম্ভব নয়৷ জনবিরোধী নীতির বিরুদ্ধে একমাত্র আন্দোলনের মধ্য দিয়েই জনগণ জয়যুক্ত হয়েছে৷ যেমন ওড়িশার নিয়মগিরিতে বেদান্ত কোম্পানির বিরুদ্ধে আদিবাসীদের আন্দোলনের জয়৷ পশ্চিমবঙ্গে সিঙ্গুর ও নন্দীগ্রামে টাটা ও সালেম গোষ্ঠীর জন্য সরকারের জমি অধিগ্রহণের প্রতিবাদে আন্দোলনের জয়৷ ছোটনাগপুর টেন্যান্সি অ্যাক্ট ও সাঁওতাল পরগণা টেন্যান্সি অ্যাক্ট সংশোধনী বিল ২০১৬–র প্রতিবাদে দেশজুড়ে আদিবাসীদের আন্দোলনের জন্য এই বিল আইনে পরিণত হতে পারেনি৷ এ ছাড়াও গত বছর তফসিলি জাতি ও তফসিলি উপজাতি নিষ্ঠুরতা নিবারণী আইনের উপর সুপ্রিম কোর্টের রায়ের পুনর্বিবেচনার দাবিতে দেশজুড়ে তীব্র ও লাগাতার আন্দোলন গড়ে ডঠেছিল এবং আন্দোলন জয়যুক্ত হয়েছিল৷ এই আইন পূর্বাবস্থায় পুনর্বহাল হয়েছে৷ তাই জঙ্গলে বসবাসকারী আদিবাসী ও চিরাচরিত বনবাসীদের উচ্ছেদের এই নির্দেশিকা পুনর্বিবেচনার দাবিতে সকল আদিবাসী গোষ্ঠী সহ সমস্ত শুভবুদ্ধিসম্পন্ন গণতন্ত্রপ্রিয় জনগণকে ঐক্যবদ্ধভাবে তীব্র ও লাগাতার আন্দোলন গড়ে তুলতে হবে৷ অবিলম্বে বিনা শর্তে জমির পাট্টা দিতে হবে এসইউসিআই (সি) এই দাবি তুলেছে৷