এস ইউ সি আই (সি)–র প্রতিষ্ঠাতা সাধারণ সম্পাদক, এ যুগের অন্যতম মহান মার্কসবাদী চিন্তানায়ক কমরেড শিবদাস ঘোষের ৪২তম স্মরণবার্ষিকী ছিল ৫ আগস্ট৷ এই উপলক্ষে দলের পলিটব্যুরো সদস্য কমরেড অসিত ভট্টাচার্য ৭ আগস্ট আসামের গুয়াহাটিতে এক সভায় বক্তব্য রাখেন৷ সম্পাদিত বক্তব্যটি এখানে প্রকাশ করা হল৷ এবার শেষাংশ৷
আসামের পরিস্থিতি সম্পর্কে কিছু আলোচনা করার জন্য অনুরোধ এসেছে৷ বিস্তারিত আলোচনা করার সুযোগ আজ আর নেই৷ তথাকথিত এনআরসি বা নাগরিকপঞ্জির যে খসড়া ইতিমধ্যে প্রকাশিত হয়েছে তাতে ৪০ লক্ষ প্রকৃত ভারতীয় নাগরিকের নাম বাদ পড়েছে৷ আপনারা জানেন, এনআরসি প্রস্তুত করার বিষয়টা যখন প্রস্তাব আকারে ছিল তখন থেকেই আমরা এই ধরনের পরিস্থিতি সৃষ্টি হওয়ার আশঙ্কা ব্যক্ত করেছিলাম৷ আমরা ঠিকই অনুমান করেছিলাম, উগ্র প্রাদেশিকতাবাদী ও সাম্প্রদায়িক শক্তির যোগসাজশে এবং কেন্দ্রীয় সরকার ও গোটা রাষ্ট্রশক্তির পৃষ্ঠপোষকতায় সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের মানুষের উপর এই ধরনের ফ্যাসিবাদী আক্রমণ আসন্ন হয়ে উুঠছে৷ দৃঢ়তার সাথে আমরা বলেছিলাম, সঠিক দৃষ্টিভঙ্গিতে এই ফ্যাসিবাদী আক্রমণ প্রতিহত করতে না পারলে আসামে আরও ভয়ানক পরিস্থিতি সৃষ্টি হবে৷ আপনারা অবহিত আছেন, আমরা বারবার বলেছি আসামের বিশেষ পরিস্থিতি বিশেষ ভাবে বুঝতে হবে৷ আবার যেহেতু আসাম ভারতের একটি অঙ্গরাজ্য তাই সমগ্র দেশের পরিস্থিতিকে মাথায় রেখেই আসামের পরিস্থিতিকে বুঝতে হবে, আদৌ বিচ্ছিন্ন করে নয়৷
আপনারা লক্ষ করছেন, সমগ্র ভারতবর্ষেই আজ এক মারাত্মক পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে৷ পুঁজিবাদের শোষণ–নির্যাতনের ফলে গোটা দেশে এক নরকের মতো অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে৷ লক্ষ করা দরকার, পুঁজিবাদের শোষণ–নির্যাতনের এই উৎকট রূপ বিশ্বের সমস্ত পুঁজিবাদী দেশে মূলত একই৷ শুধু ভারতবর্ষেই নয়, সমস্ত পুঁজিবাদী দেশেই পুঁজিবাদ গভীর সংকটে নিমজ্জিত৷ আমেরিকা থেকে শুরু করে গ্রেট ব্রিটেন, ফ্রান্স প্রভৃতি দেশের সাম্রাজ্যবাদী শাসকরা, যারা নিজেদের উন্নত পুঁজিবাদী দেশ বলে দাবি করে, সেই দেশগুলোও তীব্র অর্থনৈতিক সংকটের মুখে পড়েছে৷ সংবাদমাধ্যমে জানা যাচ্ছে সে সব দেশের জনসাধারণ জীবনধারণের পথ না পেয়ে দিশাহারা৷ কোথাও কোনও সঠিক নেতৃত্ব নেই, কিন্তু তৎসত্ত্বেও লক্ষ করার বিষয় যে, পুঁজিবাদের শোষণ–নির্যাতনের বিরুদ্ধে সেইসব দেশে স্বতঃস্ফূর্ত ভাবে আন্দোলন চলছে৷ আমেরিকা, গ্রেট ব্রিটেনের মতো দেশে যেখানে ১৫–২০ বছর আগেও আন্দোলন বলে কিছু ছিল না, আজ সে সব দেশের পুঁজিপতি শ্রেণির অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক আক্রমণের বিরুদ্ধে মানুষ স্বতঃস্ফূর্ত ভাবে সংগ্রামে রাস্তায় বেরিয়ে আসছেন৷ কিন্তু উপযুক্ত নেতৃত্ব না থাকার জন্য এই আন্দোলনগুলো বেশিদূর এগোতে পারছে না৷ মার্কসবাদ দেখিয়েছে কেবল স্বতঃস্ফূর্ততাকে ভিত্তি করে একটা ব্যবস্থার বিরুদ্ধে সংগ্রাম গড়ে তোলা যায় না৷ বিপ্লবী নেতৃত্ব যদি না থাকে তা হলে পুঁজিপতি শ্রেণি, শাসক শ্রেণি শক্তি প্রয়োগ করে অতি সহজে সেই আন্দোলনগুলো গুঁড়িয়ে দেয়, আর না হলে বিপথগামী করে দেয়৷ বিশ্বের বিভিন্ন দেশে এটাই আজ লক্ষ করা যাচ্ছে৷ আমাদের দেশেও তাই ঘটছে৷ এটাই স্বাভাবিক, কারণ ভারতের পুঁজিবাদ বিশ্ব পুঁজিবাদেরই একটা অংশমাত্র৷ পুঁজিবাদ একটা বিশ্বব্যবস্থা৷ বিভিন্ন পুঁজিবাদী দেশ মিলেই এই পুঁজিবাদী বিশ্বব্যবস্থা৷ বাজার দখল সংক্রান্ত বিষয়ে তাদের মধ্যে যেমন তীব্র দ্বন্দ্ব রয়েছে আবার একই সাথে বিপ্লবকে ধ্বংস করার জন্য তাদের মধ্যে প্রবল ঐক্যও আছে৷ এই পুঁজিবাদী বিশ্বব্যবস্থার বিপরীতে সমাজতান্ত্রিক দেশগুলো মিলে একদা একটা সমাজতান্ত্রিক বিশ্বব্যবস্থা গড়ে উঠেছিল৷ কিন্তু আধুনিক সংশোধনবাদীদের চক্রান্তে সেটা আজ আর টিকে নেই৷ যাই হোক, বিশ্ব পুঁজিবাদী ব্যবস্থায় পুঁজিবাদের যে তীব্র সংকট, যাকে থার্ড জেনারেল ইনটেন্স ক্রাইসিস অফ ক্যাপিটালিজম বলে অভিহিত করা হয় তারদ্বারা সমস্ত পুঁজিবাদী দেশই আক্রান্ত৷ ভারতবর্ষও তার থেকে মুক্ত নয়৷ ভারতবর্ষে যে দলই ক্ষমতায় আসছে তারা পুঁজিবাদেরই রক্ষক৷ পুঁজিপতি শ্রেণির স্বার্থ রক্ষা করাটাই তাদের কাজ৷ ফলে সংকট আরও ঘনীভূত হচ্ছে৷ উৎপাদন নেই, কর্মসংস্থান সৃষ্টির জন্য কলকারখানা গড়ে তোলার কোনও প্রচেষ্টা নেই, উল্টে কলকারখানাগুলি একটার পর একটা বন্ধ হচ্ছে৷ গ্রামাঞ্চলে কৃষকরা ক্রমাগত ভূমিহীন হচ্ছে৷ গরিব কৃষকদের সমস্ত জমি কেন্দ্রীভূত হচ্ছে ধনীদের হাতে৷ গ্রামে জীবনধারণের কোনও পথ না পেয়ে লাখ লাখ মানুষ শহরের দিকে পাড়ি দিচ্ছে৷ শহরেও কোনও কাজ নেই৷ চাকরি–বাকরি সব বন্ধ৷ ফলে বেঁচে থাকার কোনও অবলম্বন না পেয়ে মানুষ হয় ইতর প্রাণীর মতো জীবন ধারণ করছেন, না হলে আত্মহত্যা করছেন৷ কৃষকদের ক্রমবর্ধমান আত্মহত্যার ঘটনা অত্যন্ত উদ্বেগজনক৷ বেকার সমস্যা স্ফীত হতে হতে ভয়ঙ্কর রূপ ধারণ করেছে৷ শতকরা ৮০ ভাগ মানুষের জীবন ধারণ কৃষির ওপর নির্ভরশীল ছিল৷ কিন্তু এখন সেই পথও বন্ধ ৷
আসামে এই সমস্যা আরও ভয়ঙ্কর৷ স্বাধীনতার পর আজ পর্যন্ত এই রাজ্যে কর্মসংস্থান সৃষ্টির উদ্দেশ্যে কলকারখানা গড়ে তোলার কোনও পদক্ষেপ দেখা যায়নি৷ কিন্তু জীবনধারণের যে সমস্যা মানুষকে প্রতিদিন জ্বালিয়ে পুডিয়ে মারছে সেটা নিয়ে আসামে বিন্দুমাত্র আলোডন নেই, কোনও আন্দোলন নেই৷ বেকারের সংখ্যা প্রতিদিন বাড়ছে, এখানে কোনও কাজ না পেয়ে যে কোনও ধরনের কাজ পাওয়ার আশায় বেকার যুবকরা অন্য রাজ্যে পাড়ি দিচ্ছে৷ বেকার যুবক–যুবতীদের জরুরি প্রয়োজন হচ্ছে কিছু একটা করে জীবিকা নির্বাহ করা৷ সরকারের কাজই হচ্ছে, প্রতিনিয়ত কাজের সুযোগ সৃষ্টি করা৷ কিন্তু এ রাজ্যে এসব নিয়ে চিন্তা–ভাবনার, আলাপ–আলোচনার কোনও পরিবেশ নেই৷ মূল সমস্যার প্রশ্নে দেশের সব রাজ্যে সমস্যার প্রকৃতি এক হলেও অন্যান্য রাজ্যে জীবন–জীবিকার সমস্যা নিয়ে রাজনৈতিক ক্ষেত্রে, পত্র–পত্রিকা ইত্যাদিতে যতটুকু আলাপ–আলোচনা হয়, কিছু কিছু আন্দোলন হয়, আসাম এক্ষেত্রে সম্পূর্ণ ভিন্ন৷ এখানে ‘বাংলাদেশি’ তাড়ানোর বাইরে অন্য কোনও চিন্তা নেই৷ তার অর্থ কি এই যে, আসামের ছাত্র–যুবকের, আসামের শ্রমিক–কৃষকের জীবনে কোনও সমস্যা নেই? জীবন–জীবিকা সংক্রান্ত বিষয়ে তাঁদের কোনও ক্ষোভ–বিক্ষোভ নেই? তা তো নয়, তাঁদের গভীর ক্ষোভ–বিক্ষোভ রয়েছে৷ কিন্তু মূল সমস্যা হচ্ছে ক্ষোভ–বিক্ষোভ থাকা সত্ত্বেও এ নিয়ে উচ্চবাচ্য করার কেউ নেই৷ উগ্র প্রাদেশিকতাবাদীরা– আসু, এজিপি, আরএসএস, বিজেপি প্রমুখ সাম্প্রদায়িক শক্তিগুলি এগুলির কারণ হিসাবে এটা সেটা বলে এগুলিকে ধামাচাপা দিচ্ছে এবং এগুলির মূল কারণ যে পুঁজিবাদ তাকে আড়াল করছে৷ তাই আসামে যে দলই সরকারে থাকুক না কেন উন্নয়নের কাজ প্রায় কিছু না করেই উগ্র প্রাদেশিকতাবাদী চিন্তা–ভাবনাকে হাতিয়ার করেই তারা বছরের পর বছর মসনদে বসে আছে৷ এরকমই এক অবস্থা আসামে বুর্জোয়া শ্রেণির পত্র–পত্রিকা, প্রচারমাধ্যম সৃষ্টি করেছে৷পত্র–পত্রিকায় বাংলাদেশি অনুপ্রবেশের কথা ফুলিয়ে–ফাঁপিয়ে এমনভাবে উপস্থাপনা করা হচ্ছে, যেন এগুলোর বাইরে আসামের আর কোনও সমস্যা নেই৷ চিন্তাশীল মননে এই প্রশ্ন ডঠবেই, এই বিস্ফোরক পরিস্থিতি সৃষ্টি করা হচ্ছে কার স্বার্থে? মূল্যবৃদ্ধির তীব্রতা আসামে তো অন্যান্য রাজ্য থেকে কম নয়, আরও বেশি৷ তাহলে সেটা নিয়ে কোনও চিন্তা চর্চা নেই কেন? কেবল পৃথকতাবাদ, সাম্প্রদায়িকতাবাদ, বিচ্ছিন্নতাবাদ, উগ্র প্রাদেশিকতাবাদ দিয়ে মানুষকে আচ্ছন্ন করে দেওয়া হচ্ছে কেন? এটা হচ্ছে মানুষকে যত প্রকারে সম্ভব বিভক্ত করে রাখার চক্রান্ত৷ জনজীবনের সমস্যা নিয়ে আন্দোলন গডে উঠুক এবং আন্দোলন গডে ওঠার মধ্য দিয়ে জনসাধারণের মধ্যে ঐক্য সৃষ্টি হোক, এটা পুঁজিপতি শ্রেণি কোনও ভাবেই কোথাও হতে দিতে চায় না৷ তাই হিন্দু–মুসলিম–অসমীয়া-বাঙালি-ওড়িয়া-বিহারি এসব চিন্তায় মানুষের বিভোর হয়ে থাকাটাই পুঁজিপতি শ্রেণির প্রয়োজন৷ এজন্যই পৃথকতাবাদ–বিভাজন চর্চাকে পুঁজিপতি শ্রেণি পৃষ্ঠপোষকতা করছে৷ শ্রমিক–কৃষকের সমস্যা নিয়ে সর্বভারতীয় আন্দোলন, বেকার সমস্যা নিয়ে সর্বভারতীয় ঐক্যবদ্ধ আন্দোলন যাতে গড়ে না ওঠে তা সুনিশ্চিত করার জন্য পুঁজিপতি শ্রেণি যা করা দরকার তাই করছে৷
শাসক শ্রেণির বিরুদ্ধে শোষিত শ্রেণির ঐক্যের প্রয়োজনীয়তার কথা মহান কার্ল মার্কস ১৮৪৮ সালেই কমিউনিস্ট ম্যানিফেস্টোতে বলেছিলন৷ বিভাজনবাদ তখন তো আজকের মাত্রায় ছিল না৷ তৎসত্ত্বেও বিশ্বের শ্রমিক শ্রেণিকে উদ্দেশ করে দৃঢ়তার সাথে তিনি বলেছিলেন, বিশ্বের শ্রমজীবী মানুষ তোমরা এক হও৷ তুমি নিগ্রো না শ্বেতাঙ্গ, তুমি ভারতীয় না আমেরিকান, তুমি কালো না সাদা, তোমাদের মধ্যে এসব কোনও পার্থক্যই নেই৷ সারা বিশ্বে শোষক–শোষিতে বিভক্ত দেশগুলিতে আসল পার্থক্য হচ্ছে মুষ্টিমেয় একদল ধনী এবং বাকি সকলেই গরিব এবং শোষিত৷ মুষ্টিমেয় শোষক তোমাদের সকলকে একইভাবে শোষণ করে ক্ষমতায় বসে আছে৷ তাই জাতি–ধর্ম–ভাষা–বর্ণ এসব নয়, সমাজে বসবাসকারী মানুষের আসল পরিচয়– একদল শোষক পুঁজিপতি শ্রেণি, আর অন্যরা শোষিত, সর্বহারা শ্রমিক শ্রেণি৷ মুষ্টিমেয় শোষকরা ৯০–৯৫ ভাগ সাধারণ মানুষকে শোষণ করে করেই সমস্ত উৎপাদন যন্ত্রের তথা সকল সম্পদের অধিকারী হচ্ছে৷ তাই জনসাধারণকে বিভক্ত করা শোষক শ্রেণির শ্রেণি–চক্রান্ত৷ আসামে তাই দেখা যাচ্ছে৷ এই অতি বিপজ্জনক বিভাজনবাদী কার্যকলাপ আরম্ভ হয়েছিল ১৯৭৯ সালে তথাকথিত আসাম আন্দোলনের সময় থেকে৷ তারপর থেকে আসামে কোথাও কখনও সকল জনগণের সাধারণ দাবি–দাওয়া নিয়ে কোনও আন্দোলন গড়ে উঠেছে এমন দেখা যায়নি৷ কারণ, পুঁজিপতি শ্রেণি তার প্রচারযন্ত্রের দ্বারা বিভেদকামী মানসিকতা সৃষ্টি করার জন্য অন্তহীন প্রচেষ্টা চালাচ্ছে৷ এই অবস্থায় শ্রেণি দৃষ্টিভঙ্গির ভিত্তিতে রাজনৈতিক আন্দোলন, ন্যায্য দাবি–দাওয়া পূরণের জন্য সকল শোষিত জনসাধারণকে ঐক্যবদ্ধ করে অবিরাম গণতান্ত্রিক আন্দোলন গড়ে তোলার বাইরে অন্য কোনও বিকল্প নেই৷ কাল্পনিক দৃষ্টিভঙ্গি আমাদের পরিহার করতে হবে ঠিকই৷ কিন্তু একই সঙ্গে দৃঢ়তার সাথে আমি বলতে চাই, এই অসহনীয় পরিস্থিতির মোকাবিলা করার জন্য রাজ্যে প্রকৃত কমিউনিস্ট আন্দোলন গড়ে তুলতে বলিষ্ঠ পদক্ষেপ নিতে হবে৷ এই উদ্দেশ্যে শ্রেণি চেতনার জন্ম দিতে হবে এবং এই পথেই আসু–এজিপিদের উগ্র প্রাদেশিকতাবাদী এবং আরএসএস–বিজেপির সাম্প্রদায়িক চিন্তা–ভাবনা নির্মূল করতে হবে, পৃথকতাবাদী চিন্তা–ভাবনার অবসান ঘটাতে হবে৷ জনসাধারণের মূল সমস্যা যে পুঁজিবাদ, মুষ্টিমেয় ধনী পুঁজিপতি জনসংখ্যার ৯০–৯৫ ভাগ মানুষকে যে শোষণ করে নিঃস্ব করে দিচ্ছে এবং পুঁজিপতি শ্রেণির এই শোষণ যে জাতি–ধর্ম–ভাষা–বর্ণ নির্বিশেষে সকল রাজ্যেই সকল শোষিত মানুষের ক্ষেত্রে একই তা জনসাধারণকে ভাল করে বোঝাতে হবে৷ প্রকৃত বিপ্লবী দল হিসাবে এস ইউ সি আই (কমিউনিস্ট)–কেই এই কাজ প্রতিদিন নিষ্ঠার সাথে পরিচালনা করতে হবে৷ বোঝালে জনগণ বুঝবেন না এ কথা ঠিক নয়৷ অভিজ্ঞতা হচ্ছে ঠিক মতো বোঝাতে পারলে জনগণ বোঝেন৷ তাই জনসাধারণকে বোঝানোর এই প্রচেষ্টা নিরলসভাবে উন্নত রূপে চালিয়ে যেতে হবে৷ তার সঙ্গে জনসাধারণের জীবনের জ্বলন্ত সমস্যাগুলোকে নিয়ে প্রতিনিয়ত গণতান্ত্রিক আন্দোলন গড়ে তুলতে হবে৷ ছাত্র, শ্রমিক, কৃষক, যুবক এবং মহিলাদের দাবি নিয়ে ঐক্যবদ্ধ আন্দোলন গড়ে তুলতে হবে৷ এই আন্দোলনগুলির একটি অতীব জরুরি দিক হচ্ছে শোষিত জনসাধারণকে শ্রেণি চিন্তায় সচেতন করে তোলা৷ এই পথেই জনসাধারণকে বিভাজনবাদী চিন্তা, সংকীর্ণ প্রাদেশিকতাবাদী চিন্তার প্রভাব থেকে মুক্ত করতে হবে৷
দীর্ঘদিন ধরে উগ্র প্রাদেশিকতাবাদী শক্তি, সাম্প্রদায়িকশক্তি, পুঁজিপতি শ্রেণির পত্র–পত্রিকা, প্রচারমাধ্যম একজোট হয়ে প্রচার চালাচ্ছে যে, আসামে প্রতিদিন হাজারে হাজারে বাংলাদেশি অনুপ্রবেশ ঘটছে৷ এই প্রচার যে সম্পূর্ণ অসত্য, এটা যে ধূর্তামি এই কথা জনগণকে ভাল করে বোঝাতে হবে৷ আর কোথাও কোথাও কখনও কখনও গোপন অনুপ্রবেশ যদি ঘটেও সেটা রোধ করার জন্য সমস্ত আধুনিক উপায় অবলম্বন করে সীমান্ত সুরক্ষিত করার দ্বারাই যে এটার সমাধান সম্ভব, তাও জনসাধারণকে বোঝাতে হবে৷ তথ্য বলছে, ১৯৭১ সালের পর আসামে বিদেশি বা বাংলাদেশি নাগরিকের খুব মারাত্মক অনুপ্রবেশ ঘটেনি৷ অগপ–র শাসনকালে বারবার ভোটার তালিকা সংশোধনের মধ্য দিয়ে তা পরিষ্কারভাবে প্রতিপন্ন হয়েছে৷ আপনারা এটাও লক্ষ করছেন যে, বিদেশি নাগরিক এবং বহিরাগতদের অবাধ প্রবেশের ফলে আসামে অসমীয়াভাষী মানুষ অতি শীঘ্রই সংখ্যালঘু হয়ে যাবেন, খুব পরিকল্পিত ভাবে এই প্রচার চালিয়েও অসমীয়াভাষী মানুষকে আতঙ্কিত করে তোলা হয়েছে৷ এই প্রচার কতটা সত্য, এই ধরনের প্রচারের যৌক্তিকতা কতটা, অসীম ধৈর্য নিয়ে জনসাধারণকে তা আমাদের বোঝাতে হবে৷ আমাদের দেশে ৫০ বছরেরও অধিক সময় ধরে যে স্বাধীনতা সংগ্রাম চলেছিল আসামের দেশপ্রেমিক জনসাধারণও সেই সংগ্রামে সামিল হয়েছিলেন, অশেষ ত্যাগ স্বীকার করেছিলেন, অনেকে প্রাণ দান করেছিলেন৷ স্বাধীন ভারতবর্ষ গড়ে তোলার ক্ষেত্রে অন্যান্য প্রদেশের জনসাধারণের সাথে আসামের জনগণেরও অত্যন্ত উল্লেখযোগ্য অবদান রয়েছে৷ এটাই ইতিহাস৷ সেদিন অসমীয়া এবং অ–সমীয়া সকল জনগণেরই আকাঙক্ষা ছিল ব্রিটিশ শাসনমুক্ত স্বাধীন নতুন ভারতীয় রাষ্ট্রের জন্ম দেওয়া৷ আজ আমরা সকলেই স্বাধীন ভারতবর্ষের নাগরিক যেটা জাতি–ধর্ম–ভাষা–বর্ণ নির্বিশেষে সকলের সম্মিলিত ইচ্ছার মধ্য দিয়ে নতুন করে জন্ম নিয়েছে৷ আমাদের সত্তা, আমাদের পরিচয় একটা– আমরা ভারতীয়৷ এটাই ছিল স্বাধীনতা আন্দোলনের লক্ষ্য৷ পাঞ্জাবের জনসাধারণ বা পশ্চিমবঙ্গের জনসাধারণ কেবল পাঞ্জাব বা পশ্চিমবঙ্গের স্বাধীনতার জন্য যেমন লড়াই করেননি, তেমনি আসামের জনসাধারণও কেবল আসামের স্বাধীনতার জন্য লড়েননি৷ সকলেই লড়াই করেছিলেন গোটা ব্রিটিশ শাসিত ভারতবর্ষে স্বাধীন ভারতবর্ষের জন্ম দেওয়ার জন্য৷ গোটা ব্রিটিশ শাসিত ভারতবর্ষে সকলেই যে স্বাধীনতার জন্য ঐক্যবদ্ধ হয়ে লড়াই করলেন, সে তো হিন্দু পরিচয় বা মুসলিম পরিচয় বহন করার জন্য নয়৷ এগুলি তো ধর্ম এবং ধর্মবিশ্বাস সংক্রান্ত বিষয়, রাষ্ট্র গঠন সংক্রান্ত বিষয় নয়৷ ধর্ম তো কোনও ভাবেই একটি আধুনিক, স্বাধীন গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র গঠনের কোনও ভিত্তি হতে পারে না৷ আধুনিক রাষ্ট্র গড়ে তোলার প্রক্রিয়ায় বিশ্বের কোথাও তা হয়নি৷ আমরা সকলে মিলে ভারতীয় এই পরিচয় প্রতিষ্ঠার জন্যই আসমুদ্রহিমাচলে এই দুর্বার স্বাধীনতা সংগ্রাম গড়ে উঠেছিল৷ দেশ স্বাধীন করার অর্থ হচ্ছে এক জাতি এক প্রাণ এক রাষ্ট্রের জন্ম দেওয়া৷ এক জাতির ধারণা বাদ দিয়ে আধুনিকরাষ্ট্র হয় না৷ স্বাধীনতার আগে ভারত বলে কোনও রাষ্ট্র ছিল না, ছিল ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদের অধীন ব্রিটিশ ইন্ডিয়া৷ সেই ব্রিটিশ ইন্ডিয়ায় ভারতীয় জাতীয়তাবাদের উন্মেষ ঘটিয়েই ভারতীয় স্বাধীনতা আন্দোলন শুরু হয়৷ স্বাধীনতা আন্দোলনে বিভিন্ন প্রদেশের হাজার হাজার মানুষ যুক্ত হয়েছিলেন জাত–পাত–ধর্ম–বর্ণ ইত্যাদির ঊর্ধ্বে উঠে আমরা ভারতীয় এই পরিচয় প্রতিষ্ঠা করার জন্যই৷ রাষ্ট্র সংক্রান্ত বিষয়ে তো একই সাথে একশো গণ্ডা পরিচয় হতে পারে না৷ এটাইবাস্তব সত্য৷ বঙ্গদেশ তথা সমগ্র ভারতে এই জাতীয় কোনও সংকীর্ণ পরিচিতি নয়, ‘আমরা ভারতীয়’ এই পরিচিতি প্রতিষ্ঠার জন্যই সর্বশক্তি নিয়োজিত করেছিলেন স্বামী বিবেকানন্দ৷ এই ভাবেই স্বামী বিবেকানন্দ জনসাধারণের মধ্যে ভারতীয় জাতীয়তাবাদ প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে অসামান্য অবদান রেখে গেছেন৷ বিবেকানন্দের পর বিখ্যাত নেতা দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাস, গান্ধীজি প্রমুখ নেতৃত্ব আবির্ভূত হয়েছিলেন৷ তাঁদের মধ্যে মতবাদিক পার্থক্য যাই থাকুক না কেন গান্ধী কিংবা তিনি কেউই বাঙালি পরিচিতি বা গুজরাটি পরিচিতি তুলে ধরার চেষ্টা করেননি৷ মহান লাল–বাল–পাল সহ যাঁরা স্বাধীনতা আন্দোলন গড়ে তোলার মহান হোতা, পথিকৃৎ, তাঁরা সকলেই ভারতীয় পরিচয় তুলে ধরেছেন৷ ভারতবর্ষে বসবাসকারী সকলেরই পরিচয় যদি যথার্থই ভারতীয় হয় তাহলে ভারতীয় জাতির অভ্যন্তরে ভারতীয়দের একাংশ আরেক অংশের ভারতীয়দের সংখ্যালঘু করে দেবে এই প্রশ্ন আসে কী করে?
ভারতীয় জাতির মধ্যে বাঙালি কতজন আর পাঞ্জাবি কতজন, হিন্দু কতজন আর মুসলিম কতজন এভাবে এই প্রশ্ন উত্থাপন করা যায় কী? এর ঐতিহাসিক প্রয়োজন এবং প্রাসঙ্গিকতা আছে কি? অপরদিকে এই ধরনের জনগণের ঐক্য ধ্বংসকারী চিন্তার সর্বনাশা পরিণাম সম্বন্ধে আমরা সচেতন কি? বহু ভাষাভাষী, বহু ধর্মাবলম্বী জনগণ অধ্যুষিত এই দেশে আমাদের ইতিহাসলব্ধ ভারতীয় পরিচয়কে কার্যত চাপা দিয়ে বাঙালি পরিচিতি, ওড়িয়া পরিচিতি, বিহারি পরিচিতি– এসব সংকীর্ণ পরিচিতিবোধ, আমরা ভারতীয় এই চিন্তার মূলে যে আঘাত করছে তা আমরা প্রত্যক্ষ করছি৷ এই ধরনের কনফ্লিকটিং আইডেন্টিটির কোনও ঐতিহাসিক প্রয়োজন আছে কি? এগুলো তো মিউচ্যুয়ালি কনফ্লিকটিং থট, একটা অপরটাকে নিগেট করবে৷ এগুলি তো দেশকে অনিবার্যভাবে ইউনিটির দিকে নয়, ইন্টিগ্রেশনের দিকে নয়, চূড়ান্ত ডিজইউনিটি এবং ডিজইন্টিগ্রেশনের দিকেই ঠেলে দেবে৷ বাস্তবেও তো এই দৃষ্টিভঙ্গি চূড়ান্ত ক্ষতিকারক পৃথকতাবাদের জন্ম দিচ্ছে এবং তারই পরিণামে বিচ্ছিন্নতাবাদী (সিসেশনিস্ট) মুভমেন্টের জন্ম হচ্ছে৷
ইতিহাস পর্যালোচনা করলে দেখা যায় যে, আদিম সমাজ ব্যবস্থার সময় থেকেই মানুষ তাদের মধ্যকার পার্থক্যবোধ দূরীভূত করে ক্রমাগত ঐক্যবদ্ধ হওয়ার চেষ্টা করেছে৷ পার্থক্যবোধ থেকে অগ্রগতির গতিধারায়, পার্থক্যহীনতার জন্ম দিয়ে উন্নততর ব্যবস্থার দিকে এগিয়ে যাওয়াটাই মানবসমাজের বিকাশের নিয়ম৷ পুঁজিবাদও একসময় সামন্ততন্ত্র, রাজতন্ত্রের অবসান ঘটিয়ে পৃথকতাবাদী মন–মানসিকতার, বিচ্ছিন্নতাবোধের অবসান ঘটিয়ে একটি আধুনিক জাতীয় রাষ্ট্রের ধারণার জন্ম দিয়েছিল৷ সেদিন পুঁজিবাদ ছিল প্রগতিশীল৷ কিন্তু পুঁজিবাদ যখন ক্ষয়িষ্ণু অবস্থায় পৌঁছল তখন বিপ্লব ভয়ে ভীত হয়ে সেই পুঁজিবাদই আবার এর বিপরীত প্রক্রিয়া অর্থাৎ ডিভিসিভনেস– ডিজইউনিটিকেই সে উৎসাহ দিতে শুরু করল এবং এগুলি তীব্র থেকে তীব্রতর হতে শুরু করল৷ এই অবস্থায় সমাজের অগ্রগতির প্রশ্ণে মার্কসবাদ এসে স্লোগান তুলল– জাতীয়তাবাদ আজ নিঃশেষিত, তার পরিবর্তে এর উন্নততর আদর্শ হচ্ছে সর্বহারার আন্তর্জাতিকতাবাদ৷ এরই পরিক্রমায় এল কমিউনিজমের আদর্শ৷ এটা হচ্ছে বিজ্ঞানসম্মত একটি বিশ্বজনীন আদর্শ৷ কমিউনিজম কোনও দেশকালের সীমায় সীমায়িত নয়৷ তাই রাশিয়ায় ১৯১৭ সালে বিপ্লবের পর আমরা লক্ষ করলাম, লেনিন বললেন– রাশিয়ান রেভোলিউশন ইজ দ্য বিগিনিং অফ ওয়ার্ল্ড রেভোলিউশন অর্থাৎ রুশ বিপ্লব বিশ্ববিপ্লবের সূচনা৷ আবার চীন বিপ্লব সম্পন্ন করে মাও সে–তুঙ বললেন, ইট ইজ দ্য কন্টিনিউয়েশন অফ অক্টোবর রেভোলিউশন অর্থাৎ চীন বিপ্লব রুশ বিপ্লবের ধারাবাহিকতা৷ তাই দেখা যাচ্ছে মানবসভ্যতা বিকাশের ইতিহাসের অভিমুখ হচ্ছে প্রসেস অফ ইউনিফিকেশন (একাত্মকরণের প্রক্রিয়া)৷ এটাই মার্কসবাদী তত্ত্বের বুনিয়াদ৷ কার্ল মার্কস সমগ্র বিশ্বের শ্রমিক শ্রেণিকে আহ্বান করে বলেছিলেন, ওয়ার্কার্স অফ দ্য ওয়ার্ল্ড ইউনাইট৷ ইউ হ্যাভ নাথিং টু লুজ বাট ইয়োর চেইনস৷
কিন্তু আসামে আজ কী পরিলক্ষিত হচ্ছে? ইতিহাসের গতির বিপরীতমুখী চিন্তা৷ পুঁজিবাদের শোষণের বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ হওয়ার পরিবর্তে মানুষকে যত প্রকারে বিভক্ত করা যায় তারই অবিরাম চেষ্টা৷ অথচ মানুষের অর্থনৈতিক শোষণ দিন দিন তীব্রতর হচ্ছে, একই সাথে তাদের জীবনধারণের দিক থেকে অপরিহার্য দাবি–দাওয়াগুলি আদায়ের জন্য ঐক্যবদ্ধ গণতান্ত্রিক আন্দোলন আরও জরুরি হয়ে উঠছে৷ কিন্তু আপনারা নিশ্চয়ই লক্ষ করছেন, আসামে উগ্র প্রাদেশিকতাবাদী আসু–এজিপি এবং আরএসএস–বিজেপি প্রভৃতি সাম্প্রদায়িক শক্তিগুলি যত প্রকারে পারা যায় তা আটকে দেওয়ার চেষ্টাই করছে৷ এই সত্যটা আসামের আপামর জনসাধারণকে আমাদের বোঝাতে হবে৷ বোঝাতে হবে, এই পৃথকতাবাদী চিন্তার দ্বারা কোনও অংশের শোষিত জনসাধারণেরই কোনও উপকার সাধিত হবে না৷ আজকের দিনে পৃথকতাবাদ, বিভাজনবাদ চর্চা করে পুঁজিবাদের শোষণের বিরুদ্ধে দাঁড়ানো যাবে না৷ পৃথকতাবাদ, বিভাজনবাদ আজ পুঁজিবাদের শোষণের হাতিয়ারে পর্যবসিত হয়েছে৷
আপনারা জানেন, অবিভক্ত ব্রিটিশ ভারতে ভারতীয় জাতীয়তাবোধের ভিত্তিতে যে ঐক্যবদ্ধ স্বাধীনতা আন্দোলন গড়ে উঠেছিল ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদীদের চক্রান্তের ফলে সেই জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের উপর আঘাত আসে এবং এরই পরিণামে অখণ্ড দেশটা ধর্মের ভিত্তিতে বিভক্ত হয়ে যায়৷ কিন্তু তার ফলে কার কী উপকার হল? দুই জায়গাতেই পুঁজিবাদী শাসন শোষণ প্রবর্তিত হল৷ পাকিস্তান সৃষ্টি করে পাকিস্তানের শোষিত মুসলিম জনসাধারণের অবস্থার যেমন কোনও উন্নতি হয়নি, তেমনি খোলাখুলি ভাবে না বলেও হিন্দুস্থান, হিন্দু এই মানসিকতার সঙ্গে আপস করে ভারতবর্ষেও জনসাধারণের শোষণের অবসান ঘটেনি, তাদের জ্বলন্ত সমস্যার কোনও সমাধান হয়নি৷ তাই বর্তমান সময়ের প্রয়োজনকে অস্বীকার করে যারা পৃথকতাবাদী আন্দোলন, বিচ্ছিন্নতাবাদী আন্দোলনকে কিংবা ন্যক্কারজনক সাম্প্রদায়িক চিন্তা–ভাবনাকে উস্কানি দিচ্ছে, তারা কার্যত পুঁজিপতি শ্রেণিকে সাহায্য করছে, শক্তিশালী করছে৷ তাই মূল কথাটা হচ্ছে, এই পৃথকতাবাদী–বিভাজন চিন্তা–ভাবনা থেকে জনসাধারণকে মুক্ত করতে হলে শ্রেণি চেতনার চর্চা করতে হবে৷ একটা বৃহত্তর, মহত্তর চেতনার সন্ধান না পেলে ক্ষুদ্র চিন্তা থেকে মুক্ত হওয়া যায় না৷ আরেকটি গুরুত্বপূর্র্ণ কথা হচ্ছে– যে কোনও উগ্র চিন্তার মধ্যে অন্যের বিরুদ্ধে একটা বিদ্বেষভাব লুকিয়ে থাকে৷ উগ্র হিন্দু চিন্তা মানেই হচ্ছে মুসলিম বিদ্বেষী ভাব এবং তার উল্টো দিকে উগ্র মুসলিম চিন্তাটাও হিন্দুবিরোধী মানসিকতা৷ ঠিক একই ভাবে প্রতিক্রিয়াশীলদের মদতে যদি কোথাও উগ্র অসমীয়া চিন্তা দেখা দেয় তার মধ্যে কিন্তু বাঙালি কিংবা অন্য সম্প্রদায়ের বিরুদ্ধে চিন্তার বীজ থাকে৷ উগ্রতা আরেকটা উগ্রতার জন্ম দেয়, এই কথাটাও মনে রাখতে হবে৷ একই সঙ্গে এই কথাটাও মনে রাখতে হবে যে অসমীয়া, বিহারি, বাঙালি কোনও সমাজই শ্রেণি বিভাজনের ঊর্ধ্বে নয়৷ এই সব সমাজ বা জনগোষ্ঠীর মধ্যে মুষ্টিমেয় একদল ধনী আর বাকি সকলেই গরিব– এই বাস্তবটাই ক্রমশ প্রকট হচ্ছে৷ এটা অবশ্যই সকলের সবসময় মনে রাখতে হবে৷
এইসব অতি গুরুত্বপূর্ণ দিকগুলি বিবেচনা করে আমি আবার আপনাদের বলতে চাই, আউটনাম্বার্ড বা সংখ্যালঘুতে পরিণত হওয়ার এই চিন্তা আসলে একটি অতি মারাত্মক বিভাজনবাদী চিন্তারই নামান্তর৷ এই চিন্তার মধ্য দিয়ে তো গোষ্ঠী বিদ্বেষই জন্ম নেয়৷ এই চিন্তার পরিণাম হচ্ছে একটা গোষ্ঠীর মানুষের সঙ্গে অন্য গোষ্ঠীর মানুষের দ্বন্দ্ব–সংঘর্ষ সৃষ্টি করা৷ আমরা সকলেই স্বাধীনতা অর্জনের মধ্য দিয়ে ভারতীয় রাষ্ট্রের জন্ম দিয়েছি৷ যদিও জাতীয় পুঁজিপতি শ্রেণি ক্ষমতাসীন হওয়ার ফলে আমরা ভারতীয়রা পরস্পরবিরোধী দুটি শ্রেণি– একদিকে মুষ্টিমেয় ধনী আর অন্যদিকে বাকি সকলেই গরিব, এই দুই ভাগে বিভক্ত হয়েছি৷ মানুষের অবাধ চলাফেরা, আসা যাওয়া, উৎপাদন অভিজ্ঞতা বিনিময় করা, বস্তুগত এবং ভাবগত ডৎপাদনের জন্য একই দেশের যে কোনও জায়গায় বসবাস করা, এগুলোর কোনওটাই কোনও দিক থেকেই ক্ষতিকারক তো নয়ই, বরং এগুলো সকল জনগোষ্ঠীর সঠিক বিকাশের দিক থেকে খুবই জরুরি৷
এই পটভূমিতে ভারত ভূখণ্ডে একই সাথে বসবাস করা মানুষের কোনও এক সম্প্রদায়ের মানুষের মধ্যে যদি এরকম চিন্তা আসে যে, অমুক সম্প্রদায়, তমুক সম্প্রদায় আমাদেরকে আউটনাম্বার্ড করবে তা হলে সেই চিন্তাই হচ্ছে সর্বনাশা, ধ্বংসাত্মক৷ লক্ষ লক্ষ স্বাধীনতা সংগ্রামীর রক্ত ঝরানো সংগ্রামের মধ্য দিয়ে, শত–সহস্র শহিদের আত্মবলিদানের মধ্য দিয়ে যে স্বাধীন ভারতবর্ষ জন্ম নিয়েছিল তার অস্তিত্বের মূলেই আঘাত হানবে৷ এর ফলে একটা জনগোষ্ঠীর গরিব মানুষের বিরুদ্ধে অন্য একটা জনগোষ্ঠীর গরিব মানুষের তীব্র বিদ্বেষ সৃষ্টি হবে৷ আর অন্য দিকে পুঁজিপতি শ্রেণির শাসন আরও পাকাপোক্ত হবে, শোষণ আরও তীব্র হবে৷ পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে ইউরোপ, আমেরিকায় মানুষ এরকম চিন্তা করে না৷ আমেরিকার অঙ্গরাজ্য পেনসিলভেনিয়ার মানুষ চিন্তা করে না যে, আমরা ক্যালিফোর্নিয়ার মানুষের দ্বারা আউটনাম্বার্ড হয়ে যাচ্ছি৷ এই সব প্রশ্নে তাদের চিন্তার স্তরটা ক্ষুদ্রতার অনেক উপরে উঠে গেছে৷ এই বাস্তব পরিস্থিতিতে যে কথাটা আমি আপনাদের গভীর ভাবে ভাবতে বলব তাহল, পুঁজিবাদী শোষণ–শাসনে পর্যুদস্ত বিধ্বস্ত অসমীয়াভাষী জনসাধারণের ‘অস্তিত্ব রক্ষার ধ্বনি’ তুলে, দীর্ঘকাল ধরে এই আন্দোলন চালিয়ে তাদের জীবনে কি স্বস্তি আনা গেল? নাকি উল্টে শোষণের বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ গণতান্ত্রিক আন্দোলনের সম্ভাবনাকেই বিনষ্ট করা হল৷ পুঁজিবাদ–সৃষ্ট মূল্যবৃদ্ধির সমস্যা, বেকার সমস্যা, দুর্নীতি এগুলোই তো সকল শোষিত মানুষের অস্তিত্বকে শেষ করে দিচ্ছে৷ আমার প্রশ্ন হচ্ছে, এই জ্বলন্ত সমস্যাগুলির সাথে সম্পর্কিত না করে অস্তিত্ব রক্ষার কথা বলা কতটা ন্যায়সঙ্গত৷ অন্যদিকে পুঁজিবাদী শোষণ–শাসন থেকে উদ্ভূত জ্বলন্ত সমস্যার বিরুদ্ধে সংগ্রাম তো পৃথকতাবাদী চিন্তার ভিত্তিতে গড়ে উঠতে পারে না, গড়ে তুলতে হবে ঐক্যের চিন্তার ভিত্তিতে, মার্কসবাদী চিন্তার ভিত্তিতে৷ এই উচ্চ চেতনা সৃষ্টি করতে হলে আমাদের অসমীয়াভাষী মানুষের কাছে অস্তিত্ব রক্ষার এই সকল দিক সঠিকভাবে তুলে ধরতে হবে৷ পুঁজিবাদের শোষণ–নির্যাতনের প্রেক্ষাপট বোঝাতে হবে৷
আসাম আন্দোলনের সময় থেকেই এই তথাকথিত সংকীর্ণ আইডেনটিটি ফিলিং (অস্তিত্বের চিন্তা) আসামের কী সর্বনাশ করেছে, নানা ধরনের পার্থক্যবোধ বা তথাকথিত আইডেনটিটি ফিলিং–এর অবশ্যম্ভাবী পরিণামে আসাম যে আজ খণ্ড–বিখণ্ড হয়ে তার ভৌগোলিক অস্তিত্বকেই হারাতে বসেছে– এই ভয়াবহ পরিণাম সম্পর্কেও আসামের জনসাধারণকে সচেতন করতে হবে৷ আপনারা জানেন, এই উগ্র প্রাদেশিকতাবাদীরা দীর্ঘদিন থেকে এই কথাটাও বলছে ‘বিদেশি’ অনুপ্রবেশের ফলে এবং অন্যান্য অ–সমীয়া জনগণের অবাধ প্রবেশের ফলে অসমীয়া ভাষার অস্তিত্বও বিপন্ন হচ্ছে৷ নিরন্তর এই প্রচারের ফলে অসমীয়াভাষী জনসাধারণ বিভ্রান্ত হচ্ছেন৷ তাই এই কথাটাও তাঁদের কাছে তুলে ধরা দরকার যে ভাষা হচ্ছে ভেহিকল অব থট বা চিন্তার বাহক৷ উচ্চচিন্তার বিকাশের উপযোগী করে যে ভাষা ক্রমাগত উন্নত হচ্ছে, সেই ভাষার অস্তিত্ব নিয়ে আশঙ্কার কোনও কারণ নেই৷ এই প্রশ্নে কত সংখ্যক লোক এই ভাষায় কথা বলেন, এটা মুখ্য বিষয় নয়, মুখ্য বিষয় সেই ভাষার উৎকর্ষ, উন্নততর চিন্তা বহন করার ক্ষমতা৷ ভাষা বিকাশের ইতিহাস বারবার এই সত্যটাই প্রতিপন্ন করেছে৷ এই দিক থেকে বিচার করলে নিঃসংশয়ে বলা যায়, অসমীয়া ভাষা সময়ের প্রয়োজনে অবাধে বিকশিত হচ্ছে, আরও উন্নত হচ্ছে৷ ভাষার প্রশ্নে এই সত্যটাও আমাদের অসমীয়াভাষী মানুষের কাছে তুলে ধরতে হবে এবং পুঁজিপতি শ্রেণি এবং তাদের স্বার্থরক্ষাকারী রাজনৈতিক দলগুলোই যে এই অলীক, অসত্য, অসৎ প্রচার চালাচ্ছে তা বুঝিয়ে বলতে হবে৷ অসীম ধৈর্য নিয়ে আমাদের জনসাধারণকে বোঝাতে হবে যে, মানুষের স্বেচ্ছাপ্রণোদিত আন্দোলনের মধ্য দিয়ে ধর্ম–ভাষা–বর্ণ–জাত ইত্যাদির ঊর্ধ্বে উঠেই ইতিহাসের গতিপথে জন্মলাভ করেছিল আরও উন্নততর ঐক্যবোধ–জাতীয়তাবাদ৷ আর আজ পুঁজিবাদের ক্ষয়িষ্ণু যুগে জাতীয়তাবাদের ঊর্ধ্বে উঠেই জন্মলাভ করেছে সর্বহারার আন্তর্জাতিকতাবাদ এবং ওয়ার্ল্ড কমিউনিজম বা বিশ্ব সাম্যবাদের ধারণা৷ যে কোনও একটি দেশে বাস করলেও শ্রেণি এবং সঠিক পরিচয় হবে একটাই– আমি একজন কমিডনিস্ট, আমি একজন বিশ্ববিপ্লবী৷
পরিশেষে দৃঢ়তার সাথে আমি আপনাদের বলতে চাই, অবস্থা যতই জটিল কিংবা কঠিন হোক না কেন আসামের পরিস্থিতি মোকাবিলায় এটাই হচ্ছে একমাত্র শুদ্ধ এবং সঠিক পথ৷ দ্বিতীয় কোনও পথ নেই৷ আপনারা নিশ্চয়ই লক্ষ করছেন আর এস এস–বিজেপি এই অবস্থাকে আরও জটিল করার জন্য চেষ্টার অবধি রাখছে না৷ তারা ইতিমধ্যে পশ্চিমবঙ্গেও এন আর সি করার দাবি তুলছে৷ গভীর ডদ্বেগের সাথে আমরা লক্ষ করছি যে, এর অন্তর্নিহিত মানে হচ্ছে আসামের মতো ভারতীয় নাগরিক মুসলিম জনসাধারণকে জোর করে বিদেশি বানানো৷ বিজেপির সভাপতি অমিত শাহ বলছেন সমগ্র ভারতবর্ষে এন আর সি করতে হবে৷ ভারতবর্ষে নাকি ৪ কোটি বাংলাদেশি মুসলমান আছে৷ এসব কথা বলে এরা চূডান্ত মুসলিম বিদ্বেষ জাগিয়ে তুলতে চাইছে এবং তার থেকে রাজনৈতিক ফায়দাও তুলতে চাইছে৷ এটাই আর এস এস–বিজেপির রাজনীতি৷ এই ধরনের জঘন্য চিন্তা ছডিয়ে দিয়ে উগ্র প্রাদেশিকতাবাদীরা সাম্প্রদায়িকতাবাদীর মানুষকে মারাত্মকভাবে বিভ্রান্ত করে চলেছে৷ আর তারদ্বারা এই রাজ্যে পুঁজিবাদ বিরোধী সংগ্রাম মারাত্মক ভাবেবাধাগ্রস্ত হচ্ছে৷ ফলে প্রকৃত কমিউনিস্ট পার্টি এসইউসি আই(সি)–র নেতা–কর্মীদের উপযুক্তভাবে এই কথাগুলো জনসাধারণকে ধরিয়ে দিতে হবে৷ জনসাধারণের সমস্যা নিয়ে লাগাতার গণতান্ত্রিক আন্দোলন গড়ে তুলতে হবে এবং এই পথেই উগ্র প্রাদেশিকতাবাদী চিন্তা–ভাবনাগুলির চূড়ান্ত ক্ষতিকারক প্রভাব থেকে জনসাধারণকে মুক্ত করতে হবে৷ আর এই গুরুত্বপূর্ণ কাজ সম্পন্ন করতে হলে অতি অবশ্যই কমরেড শিবদাস ঘোষের শিক্ষাগুলো প্রতিদিন জীবনে ধারণ করে উন্নত কমিউনিস্ট চরিত্র অর্জনের সংগ্রাম চালাতে হবে৷ আজকের এই স্মরণসভায় এই আহ্বান রেখেই আমি আমার বক্তব্য শেষ করছি৷
(৭১ বর্ষ ১১ সংখ্যা ১২ – ১৮ অক্টোবর, ২০১৮)