ইন্দোরে দলের নেতা-কর্মীরা বুঝিয়ে দিলেন ভয় দেখিয়ে তাঁদের নত করা যাবে না

ইন্দোর লোকসভা কেন্দ্রের প্রার্থী কমরেড অজিত সিং পানওয়ারকে (মাঝে) অভিনন্দন জানাচ্ছেন স্থানীয় নাগরিকরা

আদর্শহীনতা যখন আজ ক্ষমতাকেন্দ্রিক রাজনীতির অপর নাম হয়ে দাঁড়িয়েছে, ঠিক সেই সময়ে বিপ্লবী তেজ, বলিষ্ঠতা ও আদর্শনিষ্ঠার অনন্য নজির সৃষ্টি করলেন ইন্দোর লোকসভা কেন্দ্রে এস ইউ সি আই (কমিউনিস্ট) প্রার্থী অজিত সিং পানওয়ার ও মধ্যপ্রদেশে দলের নেতা-কর্মীরা। দেখিয়ে দিলেন, কমিউনিজমের মহান আদর্শ বহনকারী একটি বিপ্লবী দলের নেতা-কর্মীরা শাসকের হুমকি কিংবা লোভের কাছে মাথা নত করেন না। প্রয়োজনে জীবন বাজি রেখেও তাঁরা ক্ষমতাশালীর অন্যায়ের বিরুদ্ধে মাথা উঁচু করে শেষ পর্যন্ত লড়ে যাওয়ার হিম্মত রাখেন।

 ‘মডেল রাজ্য’ গুজরাটের সুরাট কেন্দ্রে বিজেপি ভোট দেওয়ার প্রয়োজনকেই স্রেফ বাতিল করে দিয়েছে। ইন্দোরেও সে ঘটনার পুনরাবৃত্তি করতে চেয়েছিল তারা। সুরাটে চাপ সৃষ্টি করে দু-দু’বার প্রশাসনকে দিয়ে কংগ্রেস প্রার্থীর নমিনেশন বাতিল করিয়েছে বিজেপি। অন্যদেরও ভয় দেখিয়ে, লোভ দেখিয়ে প্রার্থীপদ প্রত্যাহার করে নিতে বাধ্য করেছে। ফলে ভোট শুরু হওয়ার আগেই বিজয়ীর খেতাব মিলে গেছে বিজেপি প্রার্থী মুকেশ দালালের।

ইন্দোরে খেলা আরও সহজ ছিল। কারণ বিজেপি ওই কেন্দ্রে ইন্ডিয়া জোটের কংগ্রেস প্রার্থীকে প্রার্থীপদ প্রত্যাহার করে বিজেপিতে যোগ দিতে বাধ্য করেছে। অন্য নির্দল প্রার্থীদের ম্যানেজ করে ফেলা বিজেপির কাছে কোনও ব্যাপারই ছিল না। তাঁদের সবাইকে জেলাশাসক অফিসে তুলে নিয়ে এসেছিল তারা। কিন্তু বাদ সাধল মহান মার্ক্সবাদী চিন্তানায়ক কমরেড শিবদাস ঘোষের হাতে গড়া এস ইউ সি আই (সি)। অভাবনীয় ভাবে এই দলটির কাছে বিরাট ধাক্কা খেয়ে ভেস্তে গেল বিজেপির ‘অপারেশন লোটাস’। আরও একবার সামনে এসে গেল তাদের ক্ষমতালোলুপ জঘন্য চেহারা। বোঝা গেল, হাতে সরকারি ক্ষমতা থাকলে পুলিশ-প্রশাসন সহ গোটা ব্যবস্থাটিকে কাজে লাগিয়ে, গণতন্ত্রের যেটুকু ছিটেফোঁটা আজও টিকে আছে, বিজেপি সেটুকুরও টুঁটি টিপে ধরতে ছাড়ে না।

ইন্দোরে প্রার্থীপদ প্রত্যাহারের শেষ তারিখ ছিল ২৯ এপ্রিল। ঠিক এর দু’দিন আগে থেকে এস ইউ সি আই (সি)-র তরুণ প্রার্থী কমরেড পানওয়ারের মোবাইল ফোনে অজানা নম্বর থেকে শয়ে শয়ে কল আসতে থাকে। প্রথম কলটি আসে পরিচিত এক আইনজীবীর কাছ থেকে। তিনি জানান, বিজেপির এক প্রাক্তন এমএলএ একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে পানওয়ারের সঙ্গে কথা বলতে চান। এতে রাজি না হলে পানওয়ারকে ফোন করেন পূূর্বপরিচিত এক পুলিশ অফিসার। অফিসার জানান, কয়েকজন বিজেপি-নেতা ইন্দোরের উন্নয়নের বিষয়ে পানওয়ারের সঙ্গে কথা বলতে চাইছেন। কমরেড পানওয়ার ততক্ষণে বিজেপির মতলব ধরে ফেলেছেন। বুঝতে পেরেছেন, সুরাটের মতো ইন্দোরেও বিনা যুদ্ধে জিততে চাইছে বিজেপি। তাঁকে দিয়ে প্রার্থীপদ প্রত্যাহার করিয়ে নেওয়ার জন্যই এদের এই তৎপরতা। এরপর অজানা নম্বর থেকে আসা কল নেওয়া বন্ধ করে দেন তিনি।

পানওয়ারকে ফোনে না পেয়ে বিজেপি এবার অন্য কৌশল নেয়। ইন্দোর কেন্দ্রে তাঁর প্রস্তাবক এস ইউ সি আই (সি)-র এক প্রবীণ কর্মীর বাড়িতে হঠাৎ চড়াও হন বিজেপি নেতা-কর্মীরা। তাঁকে বলা হয়, ২৯ এপ্রিল জেলাশাসক দফতরে গিয়ে বলতে হবে, পানওয়ারের প্রস্তাবকের ফর্মে তিনি সই করেননি, স্বাক্ষরটি জাল হয়েছে। বিজেপি তাঁকে বলে, ‘আপনি শুধু আমাদের সঙ্গে জেলাশাসক অফিসে চলুন। সেখানে আমাদের লোকজন যা করার করবে’। ওই প্রবীণ কর্মীকে প্রথমে প্রচুর লোভ দেখানো হয়। বলা হয়, ‘এটুকু করলেই আপনার যা চাই, আমরা সব দেবো’। দলের আদর্শে অনুপ্রাণিত এস ইউ সি আই (সি)-র ওই কর্মীকে কোনও মতেই এই অপকর্মে রাজি করাতে না পেরে বিজেপির লোকজন তাঁকে ভয় দেখাতে শুরু করে। এমনকি প্রাণে মেরে ফেলার হুমকিও দেওয়া হয়। কিন্তু প্রবীণ ওই কর্মী কোনও হুমকিতেই ভয় পাননি। সেই মুহূর্তে সমস্ত ঘটনা তিনি দলের নেতাদের জানান। দল বলিষ্ঠভাবে তাঁর পাশে এসে দাঁড়ায়। এতে পিছু হঠতে বাধ্য হয় বিজেপির লোকজন।

এবার তারা গুনায় কমরেড পানওয়ারের নির্বাচনী এজেন্টকে ফোন করা শুরু করে। তাঁকে তারা পানওয়ারের সঙ্গে দেখা করার ব্যবস্থা করে দিতে বলে। তার জন্য ইন্দোর থেকে ৩০০ কিমি দূর গুনাতে এমনকি মাঝরাতেও যেতে তাদের আপত্তি নেই বলে জানায়। যথারীতি সে প্রস্তাবও প্রত্যাখ্যান করেন এস ইউ সি আই (সি)-র ওই কর্মী। এর পরেও ২৯ এপ্রিল নাম প্রত্যাহারের শেষ দিন বিকেলে দপ্তর বন্ধ হওয়া পর্যন্ত কমরেড পানওয়ারের ফোনে অচেনা নম্বর থেকে কল আসতেই থাকে।

 এস ইউ সি আই (সি)-র মধ্যপ্রদেশ রাজ্য কমিটির সম্পাদক কমরেড প্রতাপ সামল বলেন, ‘‘বিজেপি কেন আমাদের প্রার্থীকে ফোন করছে, প্রথমে আমরা বুঝতে পারিনি। কিন্তু যে মুহূর্তে জানতে পারলাম কংগ্রেস প্রার্থী নাম প্রত্যাহার করে বিজেপিতে যোগ দিয়েছেন, তখনই আমরা ওদের মতলব ধরে ফেলি।’’ তিনি বলেন, ‘‘আমরা এসইউসিআই(সি) দলের কর্মীরা মহান মার্ক্সবাদী চিন্তানায়ক কমরেড শিবদাস ঘোষের ছাত্র। ভয় দেখিয়ে আমাদের পিছু হঠানো যায় না। কোনও বুর্জোয়া দলের সাধ্য নেই আমাদের কিনে নেওয়ার। প্রাণ গেলেও আমাদের কোনও কর্মীই লড়াইয়ের ময়দান ছাড়তে রাজি নয়। আমাদের সাধারণ সম্পাদক কমরেড প্রভাস ঘোষ সর্বদা আমাদের পাশে থেকেছেন। ওঁর পরামর্শ ও নির্দেশ মতোই আমরা চলেছি।’’ তিনি বলেন, ‘‘ইন্দোরে বিজেপির বিরুদ্ধে এখন আমরা ছাড়া অন্য কোনও সংগঠিত দলের প্রার্থী নেই। যাঁরা আছেন, তাঁরা নির্দল প্রার্থী। ফলে এই কেন্দ্রে বিজেপির সঙ্গে সরাসরি লড়াই এখন কেবলমাত্র এস ইউ সি আই (সি)-র।’’

কেন্দ্রে ও মধ্যপ্রদেশে সরকারে আসীন প্রবল শক্তিধর বিজেপি যখন টাকা ছড়িয়ে, সুবিধা পাইয়ে দিয়ে কিংবা ভয় দেখিয়ে অন্য বড় দলগুলিকে হাতের মুঠোয় পুরে ফেলছে, তখন ইন্দোরে এস ইউ সি আই (সি)-র নেতা-কর্মীরা যে সাহস ও আদর্শনিষ্ঠার পরিচয় দিলেন, তা সারা দেশে ব্যাপক সাড়া ফেলেছে। ইন্দোর কেন্দ্রের মানুষের মধ্যেও এই ঘটনা সাড়া জাগিয়েছে।

বিজেপির বিরুদ্ধে ভোটের আসর গরম করছে যারা, সেই ইন্ডিয়া জোটের কংগ্রেস প্রার্থী নিজেই বিজেপিতে যোগ দেওয়ায়, বিজেপি বিরোধী হিসাবে সিপিএম সমর্থন করবে এস ইউ সি আই (সি)-কে, মানুষের এটাই আশা ছিল। কিন্তু দুঃখের হলেও সত্য, তারা তা না করে বিজেপিকে হারাতে নিজেদের কর্মী ও জনগণকে ‘নোটা’য় ভোট দেওয়ার আহ্বান জানিয়েছে। অথচ এ কথা সকলেই জানেন যে, ভোটের হারজিত নোটা দিয়ে নির্ধারিত হয় না। নোটায় সবচেয়ে বেশি সংখ্যক মানুষ ভোট দিলেও দ্বিতীয় স্থানাধিকারী দলের প্রার্থীই বিজয়ী বলে ঘোষিত হন। এটাই নিয়ম। এ ভাবে বিজেপিকে হারানোর নাম করে সিপিএম ইন্দোরেও এবার দলের কর্মী ও জনগণকে স্রেফ ধোঁকা দেওয়ারই চেষ্টা করল। ‘কমিউনিস্ট’ নাম নিয়ে চলা একটি সোসাল ডেমোক্রেটিক দলের চরিত্র এমনই। সিপিএম নেতা বিমান বসু সম্প্রতি বলেছেন, তাঁরা নাকি এস ইউ সি আই (সি)-র সঙ্গে জোট চেয়েছিলেন। তা যে সত্য নয়, ইন্দোরের ঘটনাই তা স্পষ্ট দেখিয়ে দিল।

এর বিপরীতে প্রবল ক্ষমতাধর বিজেপির বিরুদ্ধে মাথা উঁচু করে লড়াই করার সাহস দেখালেন এ দেশের একমাত্র যথার্থ কমিউনিস্ট দল এস ইউ সি আই (সি)-র মধ্যপ্রদেশের নেতা-কর্মীরা। ইন্দোরের ঘটনা সারা দেশেই বিপুল সাড়া ফেলেছে। এ রাজ্যেও বামমনস্ক মানুষ এস ইউ সি আই (সি)-র যথার্থ বামপন্থী ভূমিকায় খুবই আনন্দিত। তাঁরা দলের কর্মীদের অভিনন্দন জানাচ্ছেন। দেশের খেটে-খাওয়া মানুষের স্বার্থে প্রতিনিয়ত আন্দোলনের পথে হেঁটে চলা বিপ্লবী আদর্শের শক্তিতে বলীয়ান এস ইউ সি আই (কমিউনিস্ট)-এর কাছে গোটা দেশের মানুষের তাই অনেক প্রত্যাশা। সেই প্রত্যাশা পূরণে দলের কর্মী-সমর্থকরা সর্বশক্তি দিয়ে কাজ করে যাওয়ার জন্য প্রস্তুত।