গত কয়েক বছরের মতো এ বছরও সারা দেশের ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজগুলি ছাত্রের অভাবে ধুঁকছে৷ সারা দেশে ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগে মোট আসনের ৪৯.৩০ শতাংশ আসন এই বছর শূন্য৷ তার আগের দু’বছর শূন্য ছিল যথাক্রমে ৪৯.৭০ শতাংশ এবং ৪৭.৬৮ শতাংশ৷ অল ইন্ডিয়া কাউন্সিল ফর টেকনিক্যাল এডুকেশনের নিয়ম অনুযায়ী ন্যূনতম ৩০ শতাংশ আসন প্রথম বর্ষে ভর্তি হতে হবে৷ সেই মানও বেশ কিছু ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজ ছুঁতে পারেনি৷
পশ্চিমবঙ্গের ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজগুলির চিত্রটাও একই রকম৷ রাজ্যের ৮০টি বেসরকারি ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজের মধ্যে ৩৫টি নামমাত্র ছাত্রছাত্রী নিয়ে চলছে৷ ছাত্রের অভাবে ইতিমধ্যেই ১৫টি কলেজ বন্ধ করে দেওয়ার জন্য রাজ্য সরকারের অনুমতি চেয়েছে কর্তৃপক্ষগুলি৷ এমনকী যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের মতো দেশের নামকরা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে প্রযুক্তি শিক্ষার জন্য পাঁচবার কাউন্সেলিংয়ের ব্যবস্থা করতে হয়েছে৷ দেখা যাচ্ছে, ইলেক্ট্রনিক্স অ্যান্ড কমিউনিকেশন, ইলেকট্রিক্যাল অ্যান্ড ইলেক্ট্রনিক্স ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগ ছাড়াও সরকারের বহুল প্রচারিত তথ্যপ্রযুক্তি, কম্পিউটার অ্যাপ্লিকেশনের মতো বিষয় ছাত্রের অভাবে বন্ধ হতে বসেছে৷
ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগে এরকম ভয়াবহ অবস্থার কারণ হিসাবে চাকরির আকালকেই দায়ী করছেন বেশিরভাগ মানুষ৷ যে আই টি শিল্প নিয়ে উচ্চ–মধ্যবিত্ত পরিবারের ছাত্রছাত্রীদের একাংশের মধ্যে অনেক প্রত্যাশা ছিল, সেখানেও ভয়াবহ অবস্থা৷ ১৩ ডিসেম্বর ২০১৬, টাইমস অব ইন্ডিয়ার একটা খবর অনেককেই চমকে দিয়েছিল৷ খবরটি চেন্নাইয়ের৷ হেডিং ছিল ‘নব্বই শতাংশ আই টি কোম্পানিতে তালা, অধিকাংশ কারখানা বন্ধ’৷ সম্প্রতি ভিয়েতনামে আয়োজিত ওয়ার্ল্ড ইকনমিক ফোরাম আয়োজিত সভায় বিশেষজ্ঞদের আশঙ্কা আগামী দিনে নতুন কাজের সুযোগ তো দূর অস্ত, দক্ষিণ–পূর্ব এশিয়ায় নতুন করে আরও ৬৬ লক্ষ মানুষকে কাজ খোয়াতে হবে৷ ফলে কেন্দ্র বা রাজ্য সরকারগুলি সরকারি কোষাগারের লক্ষ কোটি টাকা খরচ করে যতই ‘স্কিল ইন্ডিয়া’, ‘মেক ইন ইন্ডিয়া’, ‘স্টার্ট আপ’, ইত্যাদি হরেক রকম কর্মসংস্থানের প্রকল্প ঘোষণা করুক না কেন সেগুলি সবই ফাঁকা আওয়াজ ছাড়া আর কিছু নয়৷
দেশে এই মুহূর্তে আনুমানিক ৩ লক্ষ কল–কারখানা বন্ধ৷ সেগুলি খোলার কোনও উদ্যোগ সরকারের নেই৷ শোষণমূলক এই পুঁজিবাদী ব্যবস্থায় সর্বোচ্চ মুনাফা লুটের নেশায় পুঁজিপতি শ্রেণি দেশের জনতাকে লাগাতার শোষণ করে মানুষকে সর্বস্বান্ত করে তুলছে৷ তাদের কেনার ক্ষমতা নেই৷ ফলে শিল্পের উৎপাদিত পণ্য বাজারে বিক্রি হচ্ছে না, মজুত হয়ে থাকছে৷ লাভ উঠে আসতে দেরি হচ্ছে৷ ফলে ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজগুলিতে ক্যাম্পাসিংও প্রায় বন্ধের মুখে৷ আর যেখানে মাঝে মধ্যে ক্যাম্পাসিং হচ্ছে সেখানে পাশ করে বেরিয়ে আসা ছাত্রছাত্রীরা চাকরিদাতাদের প্রত্যাশিত যোগ্যতামান ছুঁতে পারছেন না৷ কারণ বেসরকারি ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজগুলির অধিকাংশেরই লক্ষ্য পড়ুয়াদের চাকরিযোগ্য করে তোলা নয়৷ তাদের আসল উদ্দেশ্য ছাত্রদের কাছ থেকে মোটা অঙ্কের টাকা হাতিয়ে নেওয়া৷ দেশের বেশিরভাগ কলেজে উন্নত মানের ল্যাবরেটরি সহ ন্যূনতম পরিকাঠামোই নেই৷ ছাত্রছাত্রীরা হাজার হাজার টাকা খরচ করে বি–টেক, এম–টেক পড়ে বেকার হয়ে থাকছে৷ দশটা খালি পদের জন্য আবেদনপত্র জমা পড়ছে কুড়ি লক্ষ৷ এসব আজ সারা দেশে খবরের শিরোনামে৷ এই অসহনীয় পরিস্থিতির বিরুদ্ধে মাঝে মাঝেই কোথাও কোথাও ফুঁসে উঠছেন ছাত্রছাত্রীরা৷ ক্ষোভে ফেটে পড়ছে দেশের বিভিন্ন ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজের পড়ুয়ারা৷ কিন্তু বন্ধ্যা এই ব্যবস্থার আর ক্ষমতা নেই যোগ্যতা অনুযায়ী মানুষকে কাজ দেওয়ার৷ তাই এই ক্ষোভকে সমাজবদলের লড়াইয়ে পরিণত করতে হবে৷
(৭১ বর্ষ ৯ সংখ্যা ২৮ সেপ্টেম্বর, ২০১৮)