ইজরায়েলের ফ্যাসিস্ট চরিত্র সম্পর্কে ১৯৪৮ সালেই সতর্ক করেছিলেন মহান মানবতাবাদী বিজ্ঞানী আইনস্টাইন

সম্পাদকের প্রতি চিঠি

নিউ ইয়র্ক টাইমস। ৪ ডিসেম্বর, ১৯৪৮

আমাদের বর্তমান সময়ে একটি উদ্বেগজনক রাজনৈতিক ঘটনা হল, নতুন তৈরি ইজরায়েল রাষ্ট্রে ‘ফ্রিডম পার্টি’-র আবির্ভাব। এই রাজনৈতিক দলটির সংগঠন পরিচালন পদ্ধতি, রাজনৈতিক দর্শন এবং সামাজিক আবেদন– সর্বদিক দিয়েই নাৎসী এবং ফ্যাসিবাদী দলগুলির সমতুল্য। এই দলটির সদস্যরা এসেছেন প্যালেস্টাইনের পূর্বতন ‘ইরগুন জাভাই লেউমি’ নামের একটি সন্ত্রাসবাদী দক্ষিণপন্থী জাতিদম্ভী সংগঠন থেকে।

এই পার্টির নেতা মেনাচেম বেগিনের বর্তমানে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে সফর অবশ্যই উদ্দেশ্যমূলক এবং সেটি হল ইজরায়েলের আসন্ন নির্বাচনে আমেরিকার সমর্থন আছে এই ভাবমূর্তি তৈরি করা ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে অবস্থিত রক্ষণশীল জায়নবাদী গোষ্ঠীগুলির সঙ্গে সম্পর্ক গড়ে তোলা। বহু স্বনামধন্য মার্কিন নাগরিক বেগিনের মার্কিন সফরকে স্বাগত জানিয়েছেন। যাঁরা বিশ্ব জুড়ে ফ্যাসিবাদের বিরোধিতা করছেন, তাঁরা যদি বেগিনের রাজনৈতিক রেকর্ড এবং কার্যকলাপ সম্পর্কে যথাযথ অবহিত হতেন, তা হলে বেগিন যে আন্দোলনের প্রতিনিধিত্ব করেন, তার প্রতি তারা আর সমর্থন জানাতে পারতেন না। বিপুল পরিমাণ আর্থিক সাহায্য দানের দ্বারা বেগিনের তরফে জনগণের সামনে একটা ভালো ভাবমূর্তি গড়ে তোলার আগেই এবং ইজরায়েলের ফ্যাসিবাদী শক্তিগুলিকে আমেরিকা সমর্থন করে এই ধারণা গড়ে ওঠবার আগেই মার্কিন জনগণকে বেগিন এবং তার আন্দোলনের উদ্দেশ্য সম্পর্কে অবহিত করা দরকার। বেগিনের দল সম্পর্কে প্রকাশ্য স্তুতি থেকে সে দলের প্রকৃত চরিত্র ধরা যাবে না। এখন তারা স্বাধীনতা, গণতন্ত্র, সাম্রাজ্যবাদ বিরোধিতার কথা বলছে, অথচ কিছু দিন আগে পর্যন্ত তারা প্রকাশ্যে ফ্যাসিস্ট রাষ্ট্রের তত্ত্ব প্রচার করেছে। এই সন্ত্রাসবাদী দলটি তাদের কাজকর্মের দ্বারাই তাদের আসল চরিত্র তুলে ধরেছে। তাদের অতীতের কার্যকলাপ থেকেই বিচার করা যায়, ভবিষ্যতে তাদের থেকে কী আশা করা যেতে পারে।

আরব গ্রামের উপর আক্রমণ

‘দের ইয়াসিন’ নামে আরব দেশের একটি গ্রামে এদের আচরণ একটি ভয়ঙ্কর দৃষ্টান্ত হয়ে দাঁড়িয়ে রয়েছে। মূল রাস্তার পাশে এবং ইহুদিদের অধিকৃত জমির দ্বারা পরিবেষ্টিত এই গ্রামটি যুদ্ধে কোনও অংশই নেয়নি, এমনকি আরব বাহিনী, যারা এই গ্রামটিকে তাদের ঘাঁটি হিসেবে ব্যবহার করতে চেয়েছিল, এরা সেই আরব বাহিনীর বিরুদ্ধে পর্যন্ত লড়েছিল। ৯ এপ্রিল সন্ত্রাসবাদী দল এই শান্তিপূর্ণ গ্রামটিকে আক্রমণ করে, যা কোনও ভাবেই যুদ্ধের অংশ ছিল না। গ্রামের অধিকাংশ অধিবাসীকে তারা হত্যা করে, নারী-পুরুষ-শিশু মিলিয়ে যার সংখ্যা ২৪০ জন এবং জীবন্ত কয়েক জনকে বন্দি করে জেরুজালেমের রাস্তায় প্যারেড করায়। ইহুদি সম্প্রদায়ের অধিকাংশ মানুষই এই ঘটনায় আতঙ্কিত হয় এবং ইহুদিদের পক্ষ থেকে ট্রান্স জর্ডানের রাজা আবদুল্লার কাছে ক্ষমা চেয়ে টেলিগ্রাম পাঠানো হয়।

কিন্তু সন্ত্রাসবাদীরা এতে লজ্জা পাওয়ার পরিবর্তে এই হত্যাকাণ্ডে গৌরব বোধ করে ও এর পক্ষে প্রচার চালায় এবং দেশে উপস্থিত সকল বিদেশি সাংবাদিকদের আমন্ত্রণ জানিয়ে স্তূপীকৃত মৃতদেহ এবং ভয়াবহ ধ্বংসলীলা দেখায়। দের ইয়াসিনের ঘটনা ফ্রিডম পার্টির কাজ ও চরিত্রের একটা ন্যক্কারজনক দৃষ্টান্ত হিসেবে হয়ে আছে।

তারা উগ্র জাতীয়তাবাদ, ধর্মীয় রহস্যবাদ এবং জাতিগত শ্রেষ্ঠত্বের ধারণার একটা মিশ্রণ ঘটিয়ে ইহুদি সম্প্রদায়ের মধ্যে প্রচার চালিয়েছে। অন্যান্য ফ্যাসিস্ট পার্টির মতো এদেরকেও ধর্মঘট ভাঙতে ব্যবহার করা হয়েছে এবং এরা নিজেরাও স্বাধীন ট্রেড ইউনিয়ন ধ্বংস করার দাবি তুলেছে। পরিবর্তে ইটালীয় ফ্যাসিস্ট মডেল অনুযায়ী কর্পোরেট ইউনিয়ন করার প্রস্তাব দিয়েছে। ব্রিটিশ বিরোধী বিচ্ছিন্ন বিক্ষোভ ও হিংসার শেষ বছরগুলিতে এই সব গোষ্ঠীগুলি প্যালেস্টাইনের ইহুদি সম্প্রদায়ের মধ্যে সন্ত্রাসের ঝড় বইয়ে দেয়। তাদের বিরুদ্ধে বলার অপরাধে শিক্ষকদের মারধোর করা হয়, সন্তানদের তাদের দলে নাম না লেখানোর অপরাধে অভিভাবকদের গুলি করে মারা হয়। গুণ্ডামি মারধোর, ঘরের জানালা-দরজা ভেঙে দেওয়া, ব্যাপক চুরি, ডাকাতির মধ্য দিয়ে এই সন্ত্রাসবাদীরা জনগণকে ভীত সন্ত্রস্ত করে তাদের প্রতি বিরুদ্ধতার মূল্য আদায় করে নেয়।

প্যালেস্টাইনের গঠনমূলক কার্যকলাপে এদের কণামাত্র অবদান নেই। এরা কোনও জমি নেয়নি, কোথাও কোনও বসতি স্থাপন করেনি, তাদের বহুপ্রচারিত অভিবাসন প্রচেষ্টা বাস্তবে ছিল নগণ্য এবং প্রধানত তা তাদের ফ্যাসিবাদী সহযোদ্ধাদের নিয়ে আসার মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল।

ইতি

অ্যালবার্ট আইনস্টাইন