১৭৫ বছর আগে কার্ল মার্ক্স লিখেছিলেন, ইউরোপকে তাড়া করছে কমিউনিজমের ভূত। একবিংশ শতকের দ্বিতীয় দশকে ইউরোপকে ভূত তাড়া করছে ঠিকই, তবে সেই ভূত অতি দক্ষিণপন্থার।
নেদারল্যান্ডসে হের্ট ভিল্ডার্সের অতি দক্ষিণপন্থী ‘পার্টি ফর ফ্রিডম’ ক্ষমতায় এসেছে। ইটালির বুকে ডানা ঝাপটাচ্ছে মুসোলিনির উত্তরসূরীরা। দেশের ক্ষমতায় প্রধানমন্ত্রী মেলোনির অতি ডান ‘ব্রাদার্স অফ ইটালি’। সঙ্গে জোটসঙ্গী ডেপুটি প্রাইম মিনিস্টার সালভিনির ‘লিগা নর্ড’। দুটিই কট্টর দক্ষিণপন্থী, শরণার্থী বিরোধী দল। জার্মানিতে বিপুল শক্তিবৃদ্ধি করেছে ‘অল্টারনেটিভ ফর জার্মানি’ (এএফডি)। প্রতিষ্ঠান বিরোধিতাকে হাতিয়ার করে রীতিমতো সরকার ফেলার ছক কষছেন অতি ডানপন্থীরা। আর্ন্তজাতিক সংবাদমাধ্যমে সেই ‘বিপ্লবের’ খবর প্রকাশিত হচ্ছে। যাবতীয় ‘অ-জার্মান’ এথনিক ব্যাকগ্রাউন্ডের মানুষজনকে, এমনকি তাঁরা যদি জার্মানির নাগরিকও হন, দেশ থেকে তাড়ানোর পরিকল্পনা নিয়ে আলোচনা হচ্ছে প্রকাশ্যে। দ্রুত জনপ্রিয় হচ্ছে ‘জার্মানি ফার্স্ট’ স্লোগান।
এর মাঝেই ভেঙে গিয়েছে জার্মানির শক্তিশালী বামপন্থী দল ‘ডি লিংকে’। তাদের জনপ্রিয় নেত্রী সাহরা ওয়াজেনকনেচ, যিনি সমাজতান্ত্রিক পূর্ব জার্মানির সোস্যালিস্ট ইউনিটি পার্টির মাধ্যমে রাজনীতি শুরু করেছিলেন, নতুন দল তৈরি করেছেন। অবশ্য তাতে শাপে বর হয়েছে। কারণ সাহরা ১৪ শতাংশ ভোট পেতে পারেন বলে ইঙ্গিত দিচ্ছে সাম্প্রতিক সমীক্ষা। একইসঙ্গে তিনি নিও-নাজি এএফডির ভোট কেটে নিতে পারেন ৪ শতাংশ। কিন্তু সার্বিকভাবে পরিস্থিতি অত্যন্ত উদ্বেগজনক।
জার্মানির মতো অতখানি না হলেও স্পেনে শক্তি বাড়ছে অতি ডানপন্থী ‘ভক্স’-এর। যদিও সেখানে মধ্য বাম সোস্যালিস্ট ওয়ার্কার্স পার্টিও শক্তিশালী। হাঙ্গেরিতে ক্ষমতায় প্রধানমন্ত্রী ভিক্টর ওরবানের অতি দক্ষিণপন্থী ‘ফিদেজ’। পোল্যান্ডে ক্ষমতায় ‘ল অ্যান্ড জাস্টিস পার্টি’, অস্ট্রিয়ায় ক্ষমতায় ‘ফ্রিডম পার্টি’। প্রতিটিই চরম দক্ষিণপন্থী। ফ্রান্সেও বিপুল শক্তিশালী অতি ডানপন্থী লা পেনের দল ‘ন্যাশনাল ব়্যালি’।
ফ্রান্সের পরিস্থিতি অবশ্য অত্যন্ত চিত্তাকর্ষক। বামপন্থী সাংসদ জাঁ লুক মেলেনকঁর দল ‘লা ফ্রান্স ইনসৌমিসে’, যাকে পশ্চিমের মিডিয়া ‘অতি বামপন্থী’ বলে প্রচার করে, তারাও অত্যন্ত শক্তিশালী। গত নির্বাচনের প্রথম রাউন্ডে ২২ শতাংশ ভোট পেয়েছিলেন একসময় ‘সরাসরি’ কমিউনিস্ট রাজনীতি করা মেলেনকঁ অতি ডান লা পেনের চেয়ে মাত্র ১ শতাংশ কম ভোট পেয়ে দ্বিতীয় রাউন্ডে যেতে পারেননি। যদি ফরাসী কমিউনিস্ট পার্টি আলাদা লড়ে ৩ শতাংশ ভোট না কেটে নিত, হয়তো ফ্রান্সের রাজনীতি অন্যরকম হত। জেরেমি করবিন ছাড়া ইউরোপের মেইনস্ট্রিম ‘বামপন্থী’ নেতাদের মধ্যে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছেন মেলেনকঁ। করবিনের মতো ইনিও ঝুঁকি নিতে ভয় পান না। করবিন এবং মেলেনকঁ দু’জনেই সোচ্চারে প্যালেস্টাইনের পক্ষে দাঁড়িয়েছেন। সেজন্য তাঁদের রীতিমতো মুণ্ডুপাত করছে পশ্চিমের মিডিয়া।
ফ্রান্সে যে কোনও কিছুই হতে পারে। ডান অথবা বাম– যে কোনও দিকেই হাঁটতে পারে রাজনীতি। কিন্তু তার বাইরে ইউরোপের অধিকাংশ দেশই এখন দেখছে বিপুল অতি দক্ষিণপন্থী উত্থান। আগামী জুনে ইউরোপিয়ান পার্লামেন্টের নির্বাচন। সেখানে অতি দক্ষিণপন্থী ব্লকের দারুণ ফলাফলের সম্ভাবনা। ষষ্ঠ স্থান থেকে একলাফে তৃতীয় স্থানে উঠে আসতে পারে তারা।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর দীর্ঘদিন মূলধারার রাজনীতিতে প্রায় অচ্ছুৎ অতি দক্ষিণপন্থীরা এমন জনপ্রিয় হলেন কেমন করে? শরণার্থী সংকট কি তাঁদের অক্সিজেন দিল? নাকি আরও কিছু কারণ? মধ্য বাম, সোস্যাল ডেমোক্র্যাট বা মধ্য ডানপন্থীদের ব্যর্থতাই কি অতি দক্ষিণপন্থার উত্থানের পথ করে দিল? সেই আলোচনা দীর্ঘ। তবে বাস্তবিকই ইউরোপের জন্য ‘এ বড় সুখের সময় নয়’।
জেরেমি করবিন লেবার পার্টির নেতৃত্বে আসার পর ব্রিটেনের রাজনীতিতে যে বাম উত্থান হয়েছিল, এখন আর তেমন পরিস্থিতি নেই। লেবার পার্টি জিতবে, তবে এই লেবার কয়েক বছর আগের মধ্য বাম অবস্থান থেকে অনেকখানি ডানে সরে গিয়েছে। করবিন ইতিমধ্যেই বহিষ্কৃত। গ্রিসের কমিউনিস্ট পার্টি অত্যন্ত শক্তিশালী, তাদের ভোটও সম্প্রতি বেড়েছে, কিন্তু গোটা দেশের সংসদীয় রাজনীতির নিরিখে তা বেশ কম। পর্তুগাল, অস্ট্রিয়াতেও কিছু পকেটে কমিউনিস্টরা শক্তিশালী। রাজধানী ভিয়েনার পর অস্ট্রিয়ার দ্বিতীয় বৃহত্তম শহর গ্রাজের মেয়র একজন কমিউনিস্ট। পর্তুগিজ কমিউনিস্টদের একাধিক সাংসদ আছেন।
ইউরোপিয়ান পার্লামেন্টে অতি ডানের উত্থান হবে ঠিকই, তবে বামপন্থীদের ফলও খুব খারাপ হবে না। সমস্যা হল বামেরা বিভিন্ন ব্লকে ভাগ হয়ে আছেন।
কিন্তু ভোট রাজনীতির পাটিগণিতে সবটুকু বিচার করা যাবে না। অতি দক্ষিণপন্থার উত্থানের মাঝেই ভীষণ উৎসাহব্যঞ্জক বিষয় হল, গোটা ইউরোপ জুড়ে শ্রমিক আন্দোলনের জোয়ার বইছে। ব্রিটেনে একের পর এক ধর্মঘট চলছে। জুনিয়র ডাক্তাররা দফায় দফায় ধর্মঘট করছেন রেল শ্রমিক, লন্ডনের টিউবরেলের কর্মীরা ধর্মঘট করছেন। গত ১৮ জানুয়ারি গোটা উত্তর আয়ারল্যান্ড লক্ষ লক্ষ শ্রমিকের ধর্মঘটে স্তব্ধ হয়ে গিয়েছিল। যাকে বলা হল উত্তর আয়ারল্যান্ডের ইতিহাসে সবচেয়ে বড় ধর্মঘট। ইউরোপের অন্য দেশগুলিতেও পরিস্থিতি প্রায় একই রকম। সুইডেনে টেসলার শ্রমিকরা বিরাট আন্দোলনে নেমেছেন। সুইডিশ শ্রমিকদের সংহতিতে অন্য দেশের শ্রমিকরাও পথে নামছেন। টেসলার শ্রমিক আন্দোলন ইতিহাস তৈরি করছে। ফিনল্যান্ডেও বইছে ধর্মঘটের জোয়ার। জার্মানি এবং ফ্রান্সে কৃষকরা ট্রাক্টর নিয়ে পথে নেমেছেন। প্যারিসে ঢোকার কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ রাস্তা অবরোধ করে রেখেছিলেন তাঁরা।
অন্য মহাদেশ লাতিন আমেরিকার আর্জেন্টিনায় নিজেকে ‘অ্যানার্কো ক্যাপিটালিস্ট’ বলে সদ্য ক্ষমতায় আসা চরম দক্ষিণপন্থী প্রেসিডেন্ট জাভিয়ের মিলেইয়ের বিরুদ্ধে সে দেশের শ্রমিক শ্রেণি প্রাথমিক বিহ্বলতা কাটিয়ে ধর্মঘটে ফেটে পড়েছেন। ঠিক তেমনই ইউরোপেও অতি দক্ষিণপন্থার উত্থানের মাঝে শ্রমিক-কৃষকদের নাছোড় লড়াইগুলি আলোর ফুলকির মতো জ্বলজ্বল করছে।
(বিশিষ্ট সাংবাদিক অর্ক ভাদুড়ি লন্ডন থেকে প্রতিবেদনটি পাঠিয়েছেন)