গত আর্থিক বছরে রাজনৈতিক দলগুলির মধ্যে বিজেপি আয়ের শীর্ষস্থান দখল করেছে৷ ২০১৮–১৯ সালে তাদের মোট আয় হয়েছে ২৪১০ কোটি ৮ লক্ষ টাকা৷ ৬টি রাজনৈতিক দল মোট যা আয় করেছে, তার ৬৫.১৬ শতাংশ গিয়েছে বিজেপির তহবিলে৷ এই তথ্য জানিয়েছে অ্যাসোসিয়েশন ফর ডেমোক্রেটিক রিফর্মস (এ ডি আর)৷
টাকা দিচ্ছে কারা? বড় বড় শিল্পপতিরা৷ তারা যে কোনও দলকে এই বিপুল পরিমাণ টাকা দেবে? না৷ যারা তাদের স্বার্থ পূরণ করবে তাদের দেবে৷ বিজেপিকে কেন দিচ্ছে? বিজেপি সবচেয়ে ভালো ভাবে তাদের স্বার্থ পূরণ করে চলেছে৷ শিল্পপতিদের ব্যবসার জন্য স্বল্পমূল্যে জমি জুগিয়ে, স্টেট ব্যাঙ্কে গচ্ছিত সাধারণ মানুষের টাকা ঋণ হিসাবে দিয়ে আত্মসাৎ করার সুযোগ করে দিয়ে, জনবিরোধী বিল পাশ করিয়ে নানা সুযোগ–সুবিধা দিচ্ছে৷
এর আগে রাফাল যুদ্ধবিমানের বরাত আম্বানিকে পাইয়ে দিয়েছিল বিজেপি৷ আম্বানিও নানাভাবে বিজেপি সরকারকে সাহায্য করেছে৷ অস্ট্রেলিয়ার খনি ব্যবসায়ে আদানি গোষ্ঠীকে জায়গা করে দিতে স্বয়ং আদানিকে সঙ্গে করে বিমানে উড়ে গিয়েছিলেন প্রধানমন্ত্রী৷ কোন আদানি? যিনি ২০১৪ সালে লোকসভা নির্বাচনে নরেন্দ্র মোদিকে ক্ষমতায় বসাতে তাঁর ডিজিটাল প্রচারের সম্পূর্ণ আর্থিক দায়িত্ব বহন করেছিলেন সম্প্রতি কেন্দ্রীয় সরকারের প্রতিরক্ষা মন্ত্রক বিদেশি প্রযুক্তির মাধ্যমে সাবমেরিন তৈরির বরাত আদানিদের পাইয়ে দিতে চেষ্টার ত্রুটি রাখছে না৷ নৌসেনার অধীনস্থ এমপাওয়ার্ড কমিটির প্রস্তাব অগ্রাহ্য করে তারা আদানি–ঘনিষ্ঠতাই প্রমাণ করছে৷ যে আদানি গোষ্ঠীর সাবমেরিন তৈরির কোনও অভিজ্ঞতাই নেই, এমপাওয়ার্ড কমিটির নির্বাচিত দুটি সংস্থার বদলে তাদেরই আহ্বান জানিয়েছে সরকারের প্রতিরক্ষা মন্ত্রক৷
শিল্পপতি ও সরকারের আতাঁত এখানে অত্যন্ত স্পষ্ট৷ ফলে বিজেপির মতো একচেটিয়া পুঁজিপতিদের দল বাৎসরিক আয়ে কীভাবে শীর্ষ স্থান দখল করে, সে কারণটা আন্দাজ করা অসম্ভব নয়৷ সরকারকে নির্বাচনের সময় মোটা মোটা ভেট দিচ্ছে শিল্পপতিরা, তাদের প্রচারে খরচ করা হাজার হাজার কোটি টাকার জোগান দিচ্ছে৷ আর শিল্পপতিরা সরকারি ‘দানে’ নতুন নতুন বরাত পেয়ে মুনাফার পাহাড় বাড়াতে থাকে৷ সরকার শিল্পপতিদের ব্যবসায়িক স্বার্থে জল–বিদ্যুৎ–জমি ও কর ছাড় দেয় বিপুল পরিমাণে৷ এভাবেই সম্পদের চূড়ায় পৌঁছয় শিল্পপতি গোষ্ঠীগুলি, পরিণত হয় ধনকুবেরে৷ কীভাবে আদানিরা ভারতের সম্পদশালীদের তালিকায় আম্বানির পরই দ্বিতীয় স্থান অধিকার করেছে, তাও স্পষ্ট হয়৷ বর্তমানে রাজনৈতিক দলগুলির আয়ে দ্বিতীয় স্থানে থাকা কংগ্রেস তাদের আমলে পুঁজিমালিকদের পছন্দের তালিকায় প্রথম স্থান দখল করে ছিল৷
আসলে নির্বাচনী প্রতিশ্রুতিতে সাধারণ মানুষের ‘উন্নয়নের’ কথা বললেও নির্বাচনসর্বস্ব দলগুলি জনস্বার্থে সরকার পরিচালনা করে না৷ ‘আচ্ছে দিনে’র স্বপ্ণ ফেরি করা বিজেপিও পুঁজিপতিদের স্বার্থে জনবিরোধী নানা নীতি গ্রহণ করছে, নানা বিল পাশ করাচ্ছে৷ অথচ জনজীবনের মূল সমস্যা– মূল্যবৃদ্ধি রোধ, বেকারি রোধে কোনও ব্যবস্থা নিচ্ছে না৷ আর্থিক বৃদ্ধি ক্রমশ নিচের দিকে নামছে৷ চাষি–মজুরের অবস্থা দুর্বিষহ৷ সরকার ঋণ মকুব না করায় আত্মহত্যা করতে বাধ্য হচ্ছে কৃষক৷ এই অবস্থায় সরকারবিরোধী ক্ষোভকে চাপা দিতে সাম্প্রদায়িক বিভাজন এনে মানুষের দৃষ্টি ঘুরিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করছে তারা৷
বিজেপি প্রতিশ্রুত ‘আচ্ছে দিন’ আসলে শিল্পপতিদের, যাদের সেবা তারা করে চলেছে নিরন্তর৷ যারা দেশের মাত্র এক শতাংশ৷ সংখ্যাগরিষ্ঠ বাকি ৯৯ শতাংশ জনসাধারণের উপরে লুটপাট চালাচ্ছে শিল্পপতিরা৷ আর সরকার ম্যানেজার হিসেবে এই লুটেরাদের সাহায্য করছে৷ তাই মুমূর্ষু পুঁজিবাদী ব্যবস্থায় বাজার সংকট তীব্র আকার ধারণ করলেও সাধারণ মানুষের আয় কমতে থাকলেও, তাদের ক্রয়ক্ষমতা কমতে থাকলেও পুঁজিপতিদের সম্পদ বৃদ্ধি হয়েই চলেছে৷ শ্রেণিবিভক্ত এই ব্যবস্থায় আর্থিক বৈষম্য বেড়েই চলেছে৷ তারই প্রকাশ পুঁজিপতি ও তাদের স্বার্থরক্ষাকারী দলের ক্রমবর্ধমান সম্পদ৷