‘আয়ুষ্মান ভারত’ যোজনা নিয়ে কেন্দ্র–রাজ্য বাগযুদ্ধ শুরু হয়েছে৷ প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি দলবাজি করছেন– এই অভিযোগ তুলে রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী সম্প্রতি এই প্রকল্প রূপায়ণ থেকে সরে এসেছেন৷ কেন্দ্রীয় সরকার প্রচার করছে, আয়ুষ্মান ভারত প্রকল্পের মধ্য দিয়ে সাধারণ মানুষের কাছে চিকিৎসা পরিষেবা পৌঁছে দেওয়ার যে ব্যবস্থা করা হয়েছে, তা থেকে রাজ্যবাসীকে বঞ্চিত করছে তৃণমূল সরকার৷ তৃণমূলের বক্তব্য, রাজ্য সরকারের ‘স্বাস্থ্য সাথী’ প্রকল্পের মধ্য দিয়েই তারা সাধারণ মানুষের কাছে চিকিৎসা পরিষেবা পৌঁছে দেবেন৷
যদিও চিকিৎসক ও স্বাস্থ্যকর্মীদের অভিমত, ২০০৮ সালে কংগ্রেস সরকারের রাষ্ট্রীয় স্বাস্থ্য বিমা যোজনা (আর এস বি ওয়াই), তৃণমূলের স্বাস্থ্যসাথী প্রকল্প বা বিজেপির আয়ুষ্মান ভারত যোজনা– সবগুলিই একই প্রকল্পের ভিন্ন ভিন্ন নাম৷ সবগুলিরই মূল কথা হল স্বাস্থ্য হবে বিমা নির্ভর– যেখানে বিমার প্রিমিয়ামের একাংশ দিতে হবে সাধারণ মানুষকে, বাকিটা দেবে কেন্দ্র ও রাজ্য ৬০:৪০ অনুপাতে৷
‘আয়ুষ্মান ভারত’ প্রকল্পকে বিজেপি নাম দিয়েছে ‘মোদি কেয়ার’৷ সরকারের বক্তব্য, এই প্রকল্পের মধ্য দিয়ে ২০২২ সালের মধ্যে এক নতুন ভারত গড়ে তোলা হবে৷ কীভাবে? ভারতের হত দরিদ্র এবং স্বাস্থ্য বঞ্চিত ১০ কোটির বেশি পরিবারকে এই প্রকল্পের অন্তর্ভুক্ত করা হবে৷ চিকিৎসা হবে বিমার মাধ্যমে৷ এ জন্য সরকার বরাদ্দ করেছে ২০১৮–১৯ আর্থিক বছরের জন্য ১০,৫০০ কোটি টাকা৷ ১০ কোটি পরিবারের জনসংখ্যা ৫০ কোটি ধরলে, মাথাপিছু বরাদ্দ হয় মাত্র ২১০ টাকা৷ এই টাকায় কি কোনও চিকিৎসা হতে পারে? টাকা বরাদ্দের বহর দেখেই বোঝা যায়, সরকার কেমন নতুন ভারত গড়তে চায়!
প্রকল্পে আরও বলা হয়েছে, চিকিৎসা পরিষেবা দেশময় ছড়িয়ে দেওয়ার জন্য ১ লাখ ৫০ হাজার ‘হেলথ ওয়েলনেস সেন্টার’ গড়া হবে৷ এ ক্ষেত্রে বরাদ্দ করা হয়েছে কত? মাত্র ১২০০ কোটি টাকা৷ কেন্দ্র প্রতি বরাদ্দ মাত্র ৮০ হাজার টাকা৷ এই টাকায় একটা পরিপূর্ণ ওয়েলনেস সেন্টার গড়ে তোলা কি সম্ভব? এই টাকায় বড়জোর শিলান্যাস হতে পারে বা সেন্টারের দু’চারটে পিলার হতে পারে৷ তা দেখিয়ে ভোটের হাওয়া গরম করা যেতে পারে, চিকিৎসা কি সম্ভব?
সরকার যদি সত্যিই গরিবের চিকিৎসার ব্যবস্থা করতে চায় তা হলে হাসাপাতালেই তো বিনামূল্যে চিকিৎসা এবং দ্রুত চিকিৎসা পাওয়ার ব্যবস্থা করতে পারত৷ তা না করে বিমা কেন? সরকার যদি সত্যিই মনে করে, স্বাস্থ্য হবে সকলের অধিকার, তা হলে সেই অধিকার পাওয়ার সামনে সকল বাধাগুলি সরকারকে দূর করতে হবে৷ বিশেষ করে ‘টাকা যার চিকিৎসা তার’– এই যে পরিস্থিতি বিভিন্ন সরকারের হাত ধরে তৈরি হয়েছে তা দূর করতে হবে৷ এজন্য চিকিৎসার সমস্ত খরচ সরকারকে বহন করতে হবে৷ তা না করে সরকার বিমা নির্ভর চিকিৎসা আনতে চাইছে কেন? বিমা মানেই তো বিনামূল্যে চিকিৎসার অধিকারকে অস্বীকার করা৷ আসলে সরকার কিছু মানুষেরবিমার কিছু প্রিমিয়াম বহন করে বাস্তবে বিনামূল্যে চিকিৎসার অধিকারই হরণ করছে৷ এতবড় একটা প্রতরণা আড়াল করতেই সরকার গরিব দরদের বাহানা তুলছে৷
এই বিমার সুবিধা পেতে গেলে হাসপাতালে রোগীকে ভর্তি হতে হবে৷ তথ্য বলছে, হাসপাতালের আউটডোরে যত বড় লাইন বা ভিড় থাকুক, হাসপাতালে ভর্তি হন ৪ শতাংশেরও কম মানুষ৷ বাকিদের চিকিৎসা চলে আউটডোর থেকেই৷ তাতে খরচ যতই রোগ বিমা মিলবে না৷ আবার বিমা আছে বলে সরকারও হাত গুটিয়ে নেবে৷ আবার যে কোনও রোগ নিয়ে হাসপাতালে ভর্তি হলেই বিমায় চিকিৎসা মিলবে না৷
কারণ বিমায় সবধরনের চিকিৎসাও হয় না৷ বিশেষ বিশেষ কিছু রোগ বিমা নির্ভর চিকিৎসার অন্তর্ভুক্ত৷ কাজেই বিমা করলেই সুরাহা মিলবে এ কথা সত্য নয়৷ তা ছাড়া বিমার সুবিধা পাওয়ার ক্ষেত্রেও রয়েছে নানা সমস্যা, রয়েছে দুর্নীতি– যা আরএসবিওয়াইয়ের ক্ষেত্রে দেখা গেছে৷ চিকিৎসা সহজলভ্য করতে হলে জরুরি ছিল নিখরচায় হাসপাতালে দ্রুত চিকিৎসার জন্য পর্যাপ্ত অর্থ বরাদ্দ করা, পর্যাপ্ত সংখ্যক ডাক্তার, নার্স, চতুর্থ শ্রেণির কর্মী থেকে নিয়োগ শুরু করে অত্যাধুনিক সব রকম পরীক্ষা নিরীক্ষার ব্যবস্থা চালু রাখা৷ সরকার এ দিকটা অবহেলা করে বিমার বাদ্যি বাজাচ্ছে কাদের স্বার্থে?
আরএসবিওয়াইয়ের ক্ষেত্রে দেখা গেছে বিমা করা রোগীদের সিংহভাগ পরিষেবা দিয়েছে বেসরকারি নার্সিং হোম৷ বিমাতে তারাই পরিষেবা বেচে মুনাফা তুলেছে৷ সেই কারণে আয়ুষ্মান প্রকল্প ঘোষিত হতেই নার্সিং হোম ব্যবসায়ীরা উল্লসিত৷ এদের স্বার্থ সুরক্ষাই আয়ুষ্মানের মূল উদ্দেশ্য৷
চিকিৎসার খরচ নিয়ে ছোট–বড় যে গবেষণাগুলি হয়েছে তাতে দেখা যাচ্ছে, সরকারি স্বাস্থ্য বিমার আওতায় থাকা পরিবারদের মধ্যেও চিকিৎসার বার্ষিক খরচ তেমন কিছু কমেনি৷ কারণ সাধারণ অসুখ–বিসুখ যা বারবার হয় তার চিকিৎসা খরচ বেড়ে বহুগুণ বেড়েছে৷ বেড়ে চলেছে ওষুধপত্রের ঊর্ধ্বমুখী দাম৷ ন্যাশনাল স্যাম্পেল সার্ভে অর্গানাইজেশনের হিসাবে রোগীদের চিকিৎসায় এখন আগের চেয়ে প্রায় ৩০০ শতাংশ বেড়ে গিয়েছে৷
আয়ুষ্মান ভারত প্রকল্পের সিইও ইন্দুভূষণ সম্প্রতি বলেছেন, চিকিৎসার বোঝা বইতে গিয়ে ভারতে প্রায় প্রতি বছর নতুন করে ৬ কোটি মানুষ দারিদ্রসীমার নিচে চলে যাচ্ছে৷ মানুষকে বিভ্রান্ত করতে কেন্দ্রীয় সরকার বলছে, চিকিৎসার অত্যধিক খরচ কমাতেই বিমা চালু করা হচ্ছে৷ অথচ বাস্তব বলছে বিমা সত্ত্বেও চিকিৎসার খরচ বাড়ছে৷
সত্যিই চিকিৎসার খরচ কমাতে হলে আয়ুষ্মানের ধোঁকা নয়, বিনামূল্যে চিকিৎসা পরিষেবা দিয়েই একমাত্র তা সম্ভব৷