(গত সংখ্যার পর)
আইএমডিটি আইন চালু ও পরবর্তীকালে তা রদের ঘটনা
এখানে উল্লেখ করা প্রাসঙ্গিক হবে যে, গণতন্ত্রবিরোধী ও আধা–ফ্যাসিবাদী চরিত্রের উগ্র প্রাদেশিকতাবাদী আসাম আন্দোলন যখন গোটা আসাম রাজ্যকে ভাসিয়ে নিয়ে যাচ্ছিল, তখন এর বিরুদ্ধে দেশের ভিতরে ও বাইরে ধিক্কারের ঝড় উঠেছিল৷ সেই সময়ে ব্যাপক নিন্দার হাত থেকে বাঁচতে ভারত সরকার চালু করেছিল ‘বেআইনি অভিবাসী (নির্ধারণ ট্রাইব্যুনাল) আইন’ বা আইএমডিটি আইন, যা উপরে উপরে হলেও প্রকৃত ভারতীয় ধর্মীয় ও ভাষাগত সংখ্যালঘু মানুষদের চূড়ান্ত হেনস্তা ও নিপীড়নের বিরুদ্ধে কিছুটা নিরাপত্তা দিয়েছিল৷ সিদ্ধান্ত হয়েছিল, ১৯৬৬ থেকে ১৯৭১–এর মধ্যে আসামে আসা ভারতীয় নাগরিকরা আসামেই বাস করতে পারবেন, তবে তথাকথিত ‘বিদেশি’ হওয়ার কারণে নাম নথিভুক্তির তারিখ থেকে শুরু করে পরবর্তী দশ বছর তাঁদের ভোটাধিকার থাকবে না৷ আরও বলা হয়েছিল, বাংলাদেশের কয়েকটি নির্দিষ্ট অঞ্চল থেকে ১৯৬৬–র ১ জানুয়ারি বা তার পরে, কিন্তু ২৫ মার্চ ১৯৭১–এর আগে আসামে এসেছেন যাঁরা, আসামের বাসিন্দা হওয়ার কারণে নাগরিকত্বের জন্য তাঁদের ১৮ নং ধারায় নিজেদের নাম নথিভুক্ত করতে হবে৷ এই উদ্দেশ্যে নাগরিকত্ব আইন–১৯৫৫–র মধ্যে একটি নতুন ধারা ৬এ যুক্ত করা হয়৷
কিন্তু তৎকালীন অগপ সরকারের প্রতিনিধি হিসাবে চরম সাম্প্রদায়িক আরএসএস–বিজেপি জোটের মদতে আসু ২০০০ সালে আইএমডিটি আইন রদ করার অন্যায় দাবি জানায় সুপ্রিম কোর্টে৷ তারা মিথ্যা যুক্তি খাড়া করে বলে যে এই আইন গোটা ভারতে নয়, শুধু আসামের জন্য প্রযোজ্য৷ অথচ, এই আইনের ২ নং উপধারায় স্পষ্ট ভাবে বলা আছে যে এটি গোটা ভারতের জন্য প্রযোজ্য এবং প্রয়োজন মনে করলে যে কোনও সময় ও যে কোনও রাজ্যে নোটিশ জারি করার দ্বারা কেন্দ্রীয় সরকার এই আইন চালু করতে পারে৷ তাছাড়া, বিশেষ পরিস্থিতিতে একটি নির্দিষ্ট এলাকার জন্য যদি একটি আইন চালু করা হয় তাহলে চরিত্রগত ভাবে আইনটি পক্ষপাতমূলক হয়ে যায়– কোনও যুক্তিতেই এ কথা বলা চলে না৷ তা সত্ত্বেও আসুর আবেদন গ্রহণ করে সুপ্রিম কোর্ট ২০০৫ সালে আইএমডিটি আইনটি রদ করে দেয়৷ ফলস্বরূপ, উদ্দেশ্যমূলকভাবে ‘বিদেশি’ বলে দাগিয়ে দেওয়া নিপীড়িত ভারতীয় নাগরিকদের যে সামান্য নিরাপত্তাটুকু ছিল, উগ্র প্রাদেশিকতাবাদী–সাম্ অপশক্তিগুলির দৌলতে তাও হারিয়ে গেল৷
বিচার সংক্রান্ত রীতিনীতির স্পষ্ট লঙঘন
বিচার সংক্রান্ত প্রচলিত নীতিগুলির ব্যাপক বিচ্যুতিও ঘটতে দেখা গেছে৷ সুপ্রিম কোর্ট এ কথাও ঘোষণা করেছিল যে, অতঃপর ফরেনার্স অ্যাক্ট–১৯৪৬–এর ভিত্তিতেই ‘বিদেশি’–দের চিহ্ণিত করা হবে৷ এই নির্মম ঘোষণার দ্বারা– ‘প্রমাণের দায় বিচারব্যবস্থার, অভিযুক্তের নয়’–বিচারব্যবস্থার এই বহু–পরীক্ষিত নীতিটি পরিত্যক্ত হল৷ কিন্তু ডি–ভোটার (পরবর্তীকালে এনআরসি–র ক্ষেত্রেও যা প্রযোজ্য হয়েছে)–দের উপরেই দায়িত্ব বর্তেছে নিজেদের প্রকৃত ভারতীয় নাগরিক বলে প্রমাণ করার, যারা তাঁদের ‘অনুপ্রবেশকারী’ বলে অভিযোগ তুলেছিল, তাদের উপর এ কথা প্রমাণ করার দায়িত্ব নেই৷ এই চরম অগণতান্ত্রিক পদ্ধতি বাস্তবায়িত করার জন্য কর্তৃপক্ষ সাম্রাজ্যবাদী ব্রিটিশ আমলের ফরেনার্স অ্যাক্ট–১৯৪৬–র শরণ নিয়েছে৷ এই ষড়যন্ত্র প্রশাসনের উচ্চতম স্তর পর্যন্ত কীভাবে গভীর শিকড় বিস্তার করেছে, এই ঘটনায় তা আবারও নিশ্চিত ভাবে প্রমাণিত হয়৷
তথাকথিত ডি–ভোটার প্রসঙ্গ
‘ডি’ ভোটার প্রসঙ্গে ফিরে আসার আগে আরেকটি বিষয় স্মরণ করা প্রয়োজন৷ তদানীন্তন পূর্ব পাকিস্তান থেকে অভিবাসীদের স্রোত প্রথমবার এদেশে আসার ঠিক আগে আগে ১৯৪৬ সালের বিদেশি আইন (ফরেনার্স অ্যাক্ট)–এর অধীনে ১৯৫১ সালে একটি নাগরিকপঞ্জি প্রস্তুত করা হয়৷ এই নাগরিকপঞ্জিকে চ্যালেঞ্জ করে ১৯৭০ সালে গুয়াহাটি হাইকোর্টে একটি মামলা দায়ের করা হয়৷ আদালত রায় দেয়, ১৯৫১ সালের এই রাষ্ট্রীয় নাগরিকপঞ্জিকে নাগরিকত্ব প্রমাণের নথি হিসাবে গণ্য করা যাবে না৷ তা সত্ত্বেও ভাষা ও ধর্মগত সংখ্যালঘু ভারতীয় নাগরিকদের হয়রানি করা বন্ধ হওয়া দূরে থাক, বরং তা উত্তরোত্তর বৃদ্ধি পেতে থাকে৷
এই সমস্ত ছল–চাতুরি এবং একতরফা নির্দেশাবলির মধ্যেও অনেকগুলি ‘ডি’ ভোটার সংক্রান্ত মামলা ‘ফরেনার্স ট্রাইব্যুনাল’–এ পাঠানো হয়৷ কিন্তু এতে কোনও সুরাহা হয়নি, কারণ এগুলি ছিল লোকদেখানো৷ আসলে সুপরিকল্পিতভাবে ‘ডি’ ভোটারের বেশ কিছু মামলা অভিযুক্ত ব্যক্তিদের অজ্ঞাতে ফরেনার্স ট্রাইব্যুনালে পাঠানো হয় এবং ন্যায়বিচারের মূল নীতিকেই পদদলিত করে একতরফা ভাবে তাদের ‘বিদেশি’ বলে ঘোষণা করা হয়৷ এমনকী নিচুতলার পুলিশকর্মীদেরও ভাষা ও ধর্মগত সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের যে কোনও ব্যক্তির বিরুদ্ধে অভিযোগ দায়ের করার নির্দেশ দেওয়া হয়৷ ট্রাইব্যুনালে অন্যায্যভাবে একবার কোনও ‘ডি’ ভোটারকে বিদেশি ঘোষণা করে দেওয়া মাত্র তাকে গ্রেপ্তার করে হয় ডিটেনশন ক্যাম্পে ভরে দেওয়া হয়, নয়ত রাতের অন্ধকারে সীমান্তের ওপারে কুকুর বেড়ালের মতো তাড়িয়ে দেওয়া হয়৷ হিটলারের জমানায় ইহুদিদের জন্য যে ‘কনসেনট্রেশন ক্যাম্প’ তৈরি হয়েছিল, ডিটেনশন ক্যাম্পগুলিকে সেগুলির সাথেই একমাত্র তুলনা করা যায়৷
কিন্তু এত কিছু করেও ৩ লক্ষ ৭০ হাজার ‘ডি’ ভোটারের মধ্যে মাত্র ৫, ৫৫০ জন নাগরিককে প্রাথমিকভাবে ‘বিদেশি’ বলে ঘোষণা করা সম্ভব হয়৷ এত পদ্ধতিগত কারচুপি, নিয়ম–কানুনের ব্যাপক লঙঘন, এমনকী ট্রাইব্যুনালগুলিকে আংশিক ভাবে হলেও রাজনৈতিকভাবে প্রভাবিত করার পরেও স্বচ্ছ বিচারের সুযোগ নিতে পেরেছিলেন যে ডি–ভোটাররা, প্রমাণিত হয়েছে, তাঁদের ৮৫ শতাংশই প্রকৃত ভারতীয় নাগরিক৷
এন আর সি প্রবর্তন
স্বাভাবিকভাবেই ক্ষমতাসীন মহল, উগ্র সাম্প্রদায়িক ও প্রাদেশিকতাবাদী শক্তিগুলি ফাঁপরে পড়ে গিয়ে বাস্তব সত্যকেকীভাবে অবাস্তবে রূপান্তরিত করা যায়, তার নতুন কৌশল আমদানি করার ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হল ২০০৫ সালে আই এম ডি টি অ্যাক্ট বাতিল হওয়ার পর কেন্দ্র ও রাজ্যে ক্ষমতাসীন কংগ্রেস এবং সারা আসাম ছাত্র ইউনিয়ন (আসু)–কে নিয়ে একটি ত্রিপাক্ষিক বৈঠক হয়েছিল৷ এতে অন্য কোনও রাজনৈতিক দল বা ভাষা ও ধর্মগত সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের প্রতিনিধিদের মতামত নেওয়া হয়নি৷
এই বৈঠকে সিদ্ধান্ত নেওয়া হয় যে ‘বিদেশি’ চিহ্ণিত করার জন্য ১৯৫১ সালের এনআরসি–তে সাম্প্রতিকতম তথ্য সংযোজন করা হবে৷ এই সিদ্ধান্ত আরও একবার নগ্নভাবে প্রমাণ করল যে আইন এবং সংবিধানকে উপেক্ষা করে উগ্র প্রাদেশিকতাবাদী ও সাম্প্রদায়িক শক্তিগুলি কীভাবে শ্রমজীবী মানুষের ঐক্য নষ্ট করা এবং জনগণের এক অংশকে অপর অংশের বিরুদ্ধে লড়িয়ে দেওয়ার গভীর ষড়যন্ত্রে লিপ্ত৷ ১৯৫৫ সালের নাগরিকত্ব আইনে ১৮–র ৪ নং ধারায় নাগরিকপঞ্জি বা এনআরসি তৈরির জন্য জনগণনার তথ্য সংগ্রহের মতো করে গোটা দেশ জুড়ে ঘরে ঘরে গিয়ে সমীক্ষা করে বিশদ তথ্য সংগ্রহ করার কথা বলা হয়েছে, দায়সারা ভাবে বা যেমন তেমন ভাবে বিশেষ কোনও অংশের জন্য তা করা যায় না৷ প্রয়োজন সাপেক্ষে আইনের এই বিধানটি জাতীয় স্তরে প্রযোজ্য৷ কিন্তু ১৯৫১ সালে আসাম ছাড়া ভারতের আর কোনও রাজ্যে এন আর সি তৈরির কোনও প্রচেষ্টা গ্রহণ করা হয়নি৷ যেহেতু আইন অনুযায়ী সারা দেশে একই সঙ্গে এনআরসি প্রস্তুত করার বিধান আছে, তাই সংসদকে এড়িয়ে গিয়ে প্রশাসনিক আদেশবলে ৪–এ ধারা সংযোজন করে আইনটিকে পরিবর্তন করা হয়৷ পরিবর্তিত আইনে ঘরে ঘরে গিয়ে তথ্য সংগ্রহের পরিবর্তে বলা হল, এনআরসি–তে নাম অন্তর্ভুক্তির জন্য ব্যক্তিগতভাবে আবেদন করতে হবে এবং ১৯৫১ সালের এন আর সি অথবা ১৯৭১ সালের আগের যে কোনও ভোটার তালিকায় তাঁর পূর্বপুরুষের নাম থাকার প্রমাণপত্র দাখিল করতে হবে৷ অথচ এই দু’টি নথি রাজ্যের সকল জেলায় পাওয়া যায় না৷ শাসকদলের সংখ্যাগরিষ্ঠতার জোরে সংসদে সহজেই সংশোধনীটি পাশ করিয়ে নেওয়ার সুযোগ থাকা সত্ত্বেও সংসদকে যেভাবে এড়িয়ে যাওয়া হল, তা থেকে এর পিছনে থাকা অসদুদ্দেশ্যটি স্পষ্ট হয়ে যায়৷ বাস্তবে সংসদে আলোচনার মাধ্যমে বিষয়টি যাতে প্রকাশ্যে না আসে, সেটাই ছিল মতলব৷ এর সাথে সাথে ভাষা ও ধর্মগত সংখ্যালঘু জনসাধারণের মধ্যে ভীতির মাত্রা তীব্র থেকে তীব্রতর করে তোলার প্রক্রিয়া শুরু হয়৷ তথাকথিত বিচারবিভাগীয় কার্যকলাপের আড়ালে ধর্ম ও ভাষাগত সংখ্যালঘু প্রকৃত ভারতীয় নাগরিকদের ‘বিদেশি’ ছাপ মেরে দেওয়ার জন্য উগ্র প্রাদেশিকতাবাদী–সাম্প্রদায়িক শক্তিগুলির ঘৃণ্য ষড়যন্ত্র ছাড়া এ আর কিছু নয়৷ সিপিআই(এম), সিপিআই সহ অন্যান্য দলগুলি এই নৃশংস পদক্ষেপকে সমর্থন করলেও একমাত্র এস ইউ সি আই (সি) চক্রান্তের অন্তর্নিহিত উদ্দেশ্য যথাযথভাবে ধরতে পেরে এই প্রক্রিয়া বন্ধ করার দাবি জানায়৷ আসামের সাম্প্রতিক এনআরসি উন্নীতকরণের এই অদ্ভুত প্রক্রিয়া শুধু ভারতবর্ষের অন্যান্য রাজ্যগুলিতেই নজিরবিহীন তাই নয়, বিশ্বের কোথাওই বোধহয় এই নজির নেই৷
বিচারবিভাগ বহির্ভূত সংস্থাকে দিয়ে
বিচারবিভাগীয় কার্যক্রম সম্পন্ন করা
দাবি করা হচ্ছে যে, চলতি এনআরসি উন্নীতকরণ এবং চূড়ান্তকরণ প্রক্রিয়া সুপ্রিম কোর্টের তত্ত্বাবধানে সম্পন্ন করা হবে৷ কিন্তু ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত অথবা ক্ষমতার মদতপুষ্ট জনবিরোধী সাম্প্রদায়িক–প্রাদেশ শক্তিগুলি প্রকৃত ভারতীয় নাগরিকদের বছরের পর বছর ছুতোনাতায় মিথ্যা অজুহাতে যেভাবে হয়রানি করছে, যেভাবে নিপীড়িত মানুষগুলি সুপ্রিম কোর্ট বা হাইকোর্টের সুবিচার থেকে বঞ্চিত হচ্ছে, তাতে তাদের প্রতি বিচারের স্বচ্ছতা বজায় রাখা এবং সুপ্রিম কোর্টের এই তত্ত্বাবধান কতটা কার্যকর হবে– তা নিয়ে প্রশ্ন উঠে যাচ্ছে৷
বলা হচ্ছে এনআরসি প্রস্তুতি একটি আইনি প্রক্রিয়া এবং যথোপযুক্ত ক্ষমতাশালী ট্রাইব্যুন্যাল অথবা আদালতের উপর সেই কাজের দায়িত্ব দেওয়া হবে৷ ফরেনার্স ট্রাইব্যুনাল–এ প্রেরিত ব্যক্তি উকিল নিয়োগ করে তার নাগরিকত্ব প্রমাণ করার সুযোগ পাবেন৷ যদি এই প্রক্রিয়া সত্যিই চালু হয়, তা হলে কিছুটা হলেও সুবিচার আশা করা যায়৷ কিন্তু এনআরসি উন্নীতকরণ প্রক্রিয়া যে ভাবে চলছে, তাতে আইনি কোনও সুরাহা আশা করা যায় না৷ এনআরসি–তে নাম অন্তর্ভুক্তির জন্য নথিপত্র পরীক্ষা করার দায়িত্ব কাদের দেওয়া হয়েছে? এদের কাউকেই আদালত নিয়োগ করেনি৷ রাজ্য ও কেন্দ্রীয় সরকারের কর্মচারী এবং স্কুল–কলেজের শিক্ষকদের মধ্য থেকে বিশেষভাবে বাছাই করে এদের নিযুক্ত করা হয়েছে৷
নাগরিকত্বের অধিকার বেঁচে থাকার অধিকারের সমতুল্য৷ এইরকম একটি মৌলিক বিষয়ের উপর রায় দেওয়ার অধিকার কী করে একদল সরকারি কর্মচারী ও শিক্ষকদের উপর ন্যস্ত করা যেতে পারে? মনগড়া ও চূড়ান্ত অগণতান্ত্রিকভাবে পক্ষপাতিত্বের ভিত্তিতে এমনকী বৈধ প্রমাণপত্রগুলিকেও বাতিল করে প্রকৃত নাগরিকদের আবেদন অস্বীকার করার নির্দেশ যদি উপরমহল থেকে দেওয়া হয়, তা হলে এঁরা কি তা অমান্য করার সাহস দেখাতে পারবেন? অভিযোগ উঠছে, আদেশ অমান্য করলে ‘যথাযথ’ ব্যবস্থা নেওয়া হবে বলে অনবরত এঁদের হুমকি দেওয়া হচ্ছে৷ এমনকী এনআরসি রাজ্য কোর্ডিনেটরের পক্ষ থেকে গোপন সার্কুলার দিয়ে এঁদের নির্দেশ দেওয়া হচ্ছে যে তাঁরা যেন প্রচলিত রীতি এবং প্রামাণ্য নথিকেও অগ্রাহ্য করেন৷ বাংলাভাষী সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের আবেদনকারীর নাম এমনকী তাদের সন্তান–সন্ততি ভাই–বোনদের নাম এনআরসি–তে যুক্ত না করার গোপন নির্দেশ যাচ্ছে৷ আইন শাস্ত্রের মূলনীতি হল, অপরাধ প্রমাণিত না হওয়া পর্যন্ত সব অপরাধীকেই নির্দোষ বলে গণ্য করতে হবে৷ অথচ, এনআরসি–র ক্ষেত্রে সুপ্রিম কোর্টের তকমা লাগিয়ে, প্রত্যেক আবেদনকারীকেই দোষী বলে ধরে নেওয়া হচ্ছে যতক্ষণ না তাঁরা নির্দোষ প্রমাণিত হচ্ছেন প্রমাণের দায়িত্বও চাপানো হয়েছে অভিযুক্তদেরই ঘাড়ে, অভিযোগকারীদের উপরে নয় আইনের নাম করে এই রকম প্রহসনের কথা কেউ কখনও শুনেছেন কি?
দ্বিতীয়ত, নিয়ম অনুসারে কোনও নাগরিক অথবা তার সন্তান–সন্ততির নাম যদি ১৯৫১ সালের এনআরসি বা ১৯৭১ সালের আগের কোনও ভোটার লিস্টে থাকে তাহলে তাঁরা এনআরসি–তে অন্তর্ভুক্তির জন্য আবেদন করতে পারবেন৷ সেইমতো নিজেদের নাগরিকত্বের প্রমাণপত্র এবং উত্তরাধিকারের তথ্য সহ এনআরসি–তে নাম নথিভুক্ত করার জন্য মোট ৩ কোটি ৭০ লক্ষ নাগরিক আবেদনপত্র জমা দেন৷ প্রত্যেকেই পরিবার পিছু একটি করে এআরএন (অ্যাপ্লিকেশন রিসিপ্ট নং) পান৷ এর অর্থ হল, এই ৩ কোটি ৭০ লক্ষ মানুষ, যাদের এ আর এন দেওয়া হয়েছে তারা প্রকৃত ভারতীয় নাগরিক অথবা প্রকৃত ভারতীয় নাগরিকের সন্তান–সন্ততি৷ পূর্বপুরুষের বৈধ উত্তরাধিকার সংক্রান্ত তথ্য নেই, এমন একজনকেও নাগরিকত্বের জন্য আবেদন করার অনুমতি দেওয়া হয়নি৷ উল্লেখ্য, নাগরিকত্ব আইনে লিগেসি ডেটার কোনও ধারা নেই৷ যার অর্থ, বাপ–ঠাকুর্দা ভারতে জন্মেছিলেন– এর কোনও প্রমাণপত্র নিজের নাগরিকত্ব প্রমাণের জন্য পেশ করার প্রয়োজন নেই৷ কিন্তু এনআরসি প্রস্তুতির পদ্ধতিতে এই ধারা স্রেফ এড়িয়ে যাওয়া হয়েছে স্পষ্টতই একটা বড় অংশের প্রকৃত নাগরিকের নাগরিকত্ব বাতিলের উদ্দেশ্য থেকে৷ তার উপর বিবাহ হয়ে যাওয়ার পর বহু মহিলা শ্বশুরবাড়িতে চলে গেছেন৷ কর্তৃপক্ষ আগে বলেছিল, গেজেটেড অফিসার দ্বারা অনুমোদিত গ্রাম পঞ্চায়েতের দেওয়া যে ‘লিংকেজ সার্টিফিকেট’ এই মহিলারা দাখিল করেছিলেন, তা বৈধ প্রমাণপত্র হিসাবে গৃহীত হবে৷ কিন্তু আশ্চর্যজনক ভাবে ৩০ লক্ষ বিবাহিত মহিলার নাম এনআরসি থেকে বাদ দেওয়া হয়েছে৷ এই ঘটনার ব্যাখ্যাটি অভিনব৷ কেউ জানে না কার নির্দেশে এই নথিকে দুর্বল নথি হিসাবে গণ্য করে এটি গ্রহণযোগ্য নয় বলে ঘোষণা করা হয়েছে সুপ্রিম কোর্টের রায় অনুযায়ী, এই ধরনের সার্টিফিকেট এবং মাইগ্রেশন সার্টিফিকেট, রিফিউজি সার্টিফিকেট, কিংবা জন্মের এক বছরের মধ্যে তৈরি করা বার্থ সার্টিফিকেট প্রামাণ্য দলিল হিসাবে গৃহীত হওয়ার কথা৷ কিন্তু এগুলিকে এখন দুর্বল নথি বলে চিহ্ণিত করা হয়েছে৷ ঘটনাক্রমে, এনআরসি–তে নাম অন্তর্ভুক্তির জন্য আদতে যে ১৫ পয়েন্টের মোডালিটির কথা বলা হয়েছিল, তার মধ্যে এই ধরনের দুর্বল নথির উল্লেখ ছিল না৷
স্পষ্টতই একটার পর একটা আইনি নথিকে বাদ দেওয়ার জন্য একতরফা, কর্তৃত্ববাদী ও ক্ষতিকর সিদ্ধান্ত নিয়ে বৈধ নথিগুলির তালিকা বারবার পুনর্বিবেচনা করা হচ্ছে এবং ‘দুর্বল নথি’ নামের অদ্ভুত শব্দ সৃষ্টি হচ্ছে৷ নথি বাতিলের এই ধরনের একতরফা সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে আপিল করার সুযোগও নেই৷ আইনের নীতি ও নিয়মকানুন এই ভাবে লঙিঘত হলে বিচারব্যবস্থা কার্যকর থাকতে পারে কীভাবে? তাহলে, সমস্ত রকম রীতিনীতি, আইন–কানুন ও ন্যায়বিচারের মূল নীতিকে পদদলিত করে রাষ্ট্রশক্তির পৃষ্ঠপোষকতায় এইভাবে নাম বাদ দেওয়াটা একটি রাজনৈতিক চক্রান্ত– এই সিদ্ধান্তে পৌঁছনো কি ভুল? এই অপকর্ম যাতে অবাধে চলতে পারে সেই উদ্দেশ্যে অন্যায়কারীদের জন্য কোনও শাস্তিমূলক ব্যবস্থাও রাখা হয়নি এসব থেকে একথাই কি স্পষ্ট হয় না যে, এনআরসি–র আপডেটেশনের গোটা কর্মসূচিটাই প্রহসনমূলক এবং পূর্বনির্ধারিত অসৎ উদ্দেশ্য হাসিল করার সর্বনাশা ষড়যন্ত্র?
গণতন্ত্রের নামে এই মস্ক্রার মধ্য দিয়েই এনআরসি–র দ্বিতীয় খসড়ায় তথাকথিত ‘বিদেশি’র সংখ্যা ৪০ লক্ষেরও বেশি দেখানো সম্ভব হয়েছে৷ বিজেপি পরিচালিত রাজ্য এবং কেন্দ্রীয় সরকার এখন মানুষকে বলছে, আশঙ্কার কোনও কারণ নেই, কারণ এটা একটা খসড়া তালিকা মাত্র এবং নাম অন্তর্ভুক্তির জন্য আবেদন করার প্রক্রিয়া শীঘ্রই কার্যকরী হতে যাচ্ছে৷ ভারতের ধর্ম ও ভাষাগত সংখ্যালঘু জনগণের এ ধরনের ফাঁপা প্রতিশ্রুতি শোনার ও জোর করে তাঁদের উপর ‘বিদেশি’ ছাপ মেরে দেওয়ার একের পর এক ষড়যন্ত্রের শিকার হওয়ার যথেষ্ট অভিজ্ঞতা আছে৷ ফলে তাঁরা চরম নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছেন এবং প্রবল আশঙ্কার মধ্যে দিন কাটাচ্ছেন৷ এই পরিস্থিতিতে মানুষকে সন্ত্রস্ত করে রাখতে ও বিক্ষোভ দমন করতে পুলিশ ও আধা–সামরিক বাহিনী মোতায়েন করা হয়েছে৷ বিজেপি সভাপতি অমিত শাহ প্রকাশ্যে বলেছেন যে, এনআরসি একটি গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ এবং দেশের অন্যান্য রাজ্যেও এটা করা উচিত৷ আসামের প্রাক্তন অগপ মুখ্যমন্ত্রী প্রফুল্লকুমার মহন্ত বলেছেন, এনআরসি থেকে যাঁরা বাদ পড়েছেন তাঁরা সকলেই ‘অনুপ্রবেশকারী’ এবং তাঁদের দেশ থেকে তাড়িয়ে দেওয়া হবে৷ এসবই হল জাতিগোষ্ঠী নিশ্চিহ্ণ করে ফেলার (এথনিক ক্লিনজিং) সুপরিকল্পিত ষড়যন্ত্র৷ (আগামী সংখ্যায়)
(৭১ বর্ষ ১৪ সংখ্যা ১৬ – ২২ নভেম্বর, ২০১৮)