আসামের বিভিন্ন জেলায় মোট ৬টি ডিটেনশন ক্যাম্পে দীর্ঘ দিন ধরে বন্দি করে রাখা হয়েছে হাজারের বেশি নিরপরাধ মানুষকে৷ এদের মধ্যে কয়েকজন অন্য দেশের নাগরিক যারা পাসপোর্ট ছাড়া বা পাসপোর্টের মেয়াদ শেষ হয়ে যাওয়ার অপরাধে বন্দি৷ তাদের বাদ দিলে বাকি সকলেই ভারতীয় নাগরিক৷ রাষ্ট্র তাদের বিদেশি সাজিয়ে বন্দি করে রেখেছে৷
১৯৯৭ সাল থেকে আসামে উগ্র প্রাদেশিকতা ও জাতিবিদ্বেষী মানসিকতার দ্বারা পরিচালিত সরকার রাজ্যের ভাষিক ও ধর্মীয় সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের লক্ষ লক্ষ গরিব ভারতীয় নাগরিককে ‘ডি–ভোটার’ বানিয়ে বিদেশি সন্দেহের আবর্তে নিয়ে আসে৷ এদের বেশির ভাগকেই একতরফা ভাবে বিনা বিচারে আটকে রাখা হয়েছে৷
ইতিহাসে কুখ্যাত হিটলারের কনসেনট্রেশন ক্যাম্পের মতো এইসব ডিটেনশন ক্যাম্পে নিরপরাধ গরিব মানুষগুলিকে অবর্ণনীয় পরিবেশে দিনের পর দিন কাটাতে হচ্ছে৷ ছোট্ট একটি কুঠুরিতে ৪০–৫০ জন মানুষ শ্বাসরোধকারী অবস্থায়, ন্যূনতম সুযোগ–সুবিধা থেকে বঞ্চিত হয়ে, তিল তিল করে মৃত্যুর প্রহর গুনছে৷ কুঠুরির মেঝেতেই তাদের শুতে হয়৷ খাবার বলতে সামান্য ডাল–ভাত, সেও মানুষের খাদ্যের অনুপযুক্ত৷ এই কারণে অনেকেই নানা রোগে আক্রান্ত হচ্ছেন৷ তাদের চিকিৎসারও কোনও ব্যবস্থা নেই৷ অনেকেই এই বীভৎস যন্ত্রণার মধ্যে পড়ে মানসিক রোগের শিকার হয়ে যাচ্ছেন৷ উপযুক্ত খাদ্য ও চিকিৎসার অভাবে শুরু হয়েছে কার্যত মৃত্যুমিছিল৷ ইতিমধ্যেই ২৮ জন মারা গেছেন৷
১৩ অক্টোবর শোণিতপুর জেলার অলিশিঙ্গা গ্রামের দুলাল চন্দ্র পাল (৬৪) রাষ্ট্রের এই চক্রান্তের বলি হয়েছেন৷ ভারতীয় নাগরিকত্বের প্রমাণ থাকা সত্ত্বেও ‘ফরেনার্স ট্রাইবুনাল’ ২০১৭ সালের অক্টোবরে তাঁকে একতরফা ভাবে ‘বিদেশি’ ঘোষণা করে৷ নিজের বাড়িতে মাটির বাসন তৈরি করে কোনরকমে সংসার চালাতেন হতদরিদ্র দুলালবাবু৷ ট্রাইবুনালে তাঁর নামে মামলা হওয়ার পর টাকার অভাবে দীর্ঘ দিন তিনি মামলা চালাতে পারেননি৷ তাছাড়া, যেসব নথিপত্র তাঁর নেই বা একজন দরিদ্র মানুষের থাকার কথাও নয়, ট্রাইবুনাল সেইসব নথিপত্র দেখানোর দাবি করে৷ তিন ছেলে ও স্ত্রী–কে নিয়ে সংসার চালাতেই যিনি ক্লান্ত তিনি এমন সব নথি পাবেন কোথায়? ফলে, বাপ–ঠাকুরদার ভিটেতেই দুলালবাবুর গায়ে সরকার ‘বিদেশি’ তকমা লাগিয়ে দেয়৷ তারপর থেকে প্রৌঢ় দুলালবাবুর ঠিকানা হয়ে যায় তেজপুরের ডিটেনশন ক্যাম্প৷
দীর্ঘ দিন ক্যাম্পে অমানুষিক যন্ত্রণা ভোগ করে তিনি মারাত্মক অসুস্থ হয়ে পড়েন৷ ২৭ সেপ্টেম্বর প্রথম তাঁকে তেজপুর হাসপাতালে এবং পরে গুয়াহাটি হাসপাতালে ভর্তি করা হয়৷ কিন্তু চিকিৎসার জন্য তত দিনে অনেক দেরি হয়ে গেছে৷ ১৮ অক্টোবর তিনি মারা যান৷ সরকার তাঁর মরদেহ পরিবারের হাতে তুলে দিতে চাইলে দুলালবাবুর ছেলেরা তা প্রত্যাখ্যান করেন৷ গভীর দুঃখ–বেদনা এবং তীব্র ক্ষোভে তারা বলেন, ‘সরকার বাবাকে জোর করে বিদেশি বানিয়ে ডিটেনশন ক্যাম্পে ঢুকিয়েছিল৷ সেখানে বিনা চিকিৎসায় তাঁর মৃত্যু হয়েছে৷ তাহলে বিদেশি নাগরিকের মৃতদেহ আমরা নেব কেন?’ ছেলেরা দাবি করেন, ‘আগে সরকার তাঁকে ভারতীয় ঘোষণা করুক, তারপর দেহ নেব৷’ পরিবারের এই অনড় অবস্থানে সরকার বেকায়দায় পড়ে৷
এই ঘটনাকে কেন্দ্র করে সমগ্র রাজ্যে আলোড়ন তৈরি হয়েছে৷ বিক্ষোভে ফেটে পড়েন সাধারণ মানুষ৷ দুলালবাবুর ছেলেদের অনড়–অটল অবস্থানে ডিটেনশন ক্যাম্পের বিরুদ্ধে পথে নামতে বাধ্য হয়েছেন মানুষ৷ মৃতদেহ বুঝে নিতে সরকার প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ ভাবে প্রবল চাপ সৃষ্টি করার পরও টানা দশ দিন দুলালবাবুর ছেলেরা এই অন্যায়ের প্রতিবাদে লড়াই চালিয়ে যান৷ অবশেষে সরকার দুলালবাবুর ডেথ সার্টিফিকেটে ‘ভারতীয়’ লিখে দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দেওয়ার পর তারা বাবার মৃতদেহ নেয়৷
একই ভাবে মৃত্যু ঘটেছে নলবাড়ি জেলায় বরক্ষেত্রী এলাকার সতেমারি গ্রামের বাসিন্দা ফালু দাসের৷ দরিদ্র এই মানুষটি মাছ ধরে সংসার চালাতেন৷ ২০১৭ সালের জুলাই মাসে সরকার তাঁকে ‘বিদেশি’ এবং ‘ডি–ভোটার’ ঘোষণা করে গোয়ালপাড়ার ডিটেনশন ক্যাম্পে ঢোকায়৷ তাঁর পরিবারকেই হয়রান করা হয়৷ প্রতিবাদে তাঁর পরিজনরাও মৃতদেহ নিতে অস্বীকার করেছেন৷
২১ অক্টোবর এসইউসিআই (সি)–র রাজ্য কমিটির সদস্য কমরেড জিতেন চালিহা ও কমরেড অজয় আচার্য, দুলালবাবুর বাড়িতে গিয়ে পরিবারের সদস্যদের সমবেদনা জানান৷ বিবৃতিতে তাঁরা বলেন, ‘দুলালবাবুর ছেলেদের লড়াকু মানসিকতা রাজ্যের মানুষের বিবেকে প্রবল নাড়া দিয়েছে৷ নিদারুণ শোকের মধ্যেও টানা দশ দিন তারা তাদের দাবিতে যে দৃঢ়তার পরিচয় দিয়েছেন তা ডিটেনশন ক্যাম্প বিরোধী আন্দোলনে প্রেরণা যোগাবে৷’ দলের প্রতিনিধিদের সাথে পরিবারের লোকজনের কথাবার্তার সময় দুলালবাবুর ছেলেরা জানান, ডিটেনশন ক্যাম্পের বীভৎস যন্ত্রণার বিরুদ্ধে যে আন্দোলন গড়ে উঠবে তাতে তারাও অংশ নেবেন৷