দিল্লিতে কৃষক আন্দোলন এক মাস পার হয়ে গেল। শীত যত বাড়ছে পাল্লা দিয়ে বাড়ছে কৃষকদের মনোবল। সরকার যত নানা ছলে আন্দোলনে বিভেদ তৈরি করার এবং আপসের রাস্তায় টেনে আনার চেষ্টা করছে আন্দোলন ততই ছড়িয়ে পড়ছে রাজ্যে রাজ্যে– অর্জন করেছে সর্বভারতীয় রূপ। উত্তরাখণ্ডের কৃষকরা পুলিশি ব্যারিকেড গুঁড়িয়ে দিয়ে অন্দোলনে যোগ দিয়েছেন। মহারাষ্ট্রের কৃষকরা যোগ দিয়েছেন দিল্লির ধরনায়। যোগ দিয়েছেন রাজস্থানের কৃষকরা। পাঞ্জাব-হরিয়ানার মতো রাজ্যগুলিতে বিজেপি নেতারা সামাজিক বয়কটের মুখে পড়েছেন। সরকার একই প্রস্তাব ঘুরিয়ে ফিরিয়ে কৃষকদের সামনে উপস্থিত করলে আন্দোলনের নেতারা তা ফিরিয়ে দিয়ে আইন প্রত্যাহারের দাবিতে অনড়। এআইকেকেএমএস ধরনায় অংশগ্রহণের পাশাপাশি গোটা দেশ জুড়ে আন্দোলনের বিস্তার ঘটাতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নিচ্ছে। অন্য দিকে বিজেপি সরকার কর্পোরেটের স্বার্থ রক্ষাকারী চরিত্র ক্রমাগত দেশের মানুষের সামনে স্পষ্ট হয়ে উঠছে। এই পরিপ্রেক্ষিতে কৃষি আইনের নানা জনবিরোধী দিক প্রশ্ন-উত্তরের আকারে তুলে ধরা হল।
প্রশ্ন : ২৬ নভেম্বর ২০২০ থেকে দিল্লিতে যে কৃষক আন্দোলনের বিস্ফোরণ ঘটেছে, এমন আন্দোলন স্মরণকালের মধ্যে ঘটেনি। লক্ষ লক্ষ কৃষক প্রবল ঠাণ্ডা সহ্য করে আন্দোলনে সামিল। ৪০ জনেরও বেশি আন্দোলনকারী ইতিমধ্যেই মারা গেছেন। সাড়া ফেলে দেওয়া এই আন্দোলন কি শুধু কৃষকদেরই আন্দোলন, নাকি তা সর্ব সাধারণের আন্দোলন?
উত্তর : একথা ঠিক, আন্দোলনটা কৃষকরাই শুরু করেছেন। সেই অর্থে কৃষক আন্দোলন। কৃষি আন্দোলনের চরিত্র নিয়েই এটা গড়ে উঠেছে। কিন্তু যত দিন যাচ্ছে সরকারের অনড় মনোভাবের কারণে এই আন্দোলনের তীব্রতাও বাড়ছে এবং দিল্লির রাজপথ শুধু নয়, সারা দেশে এই আন্দোলন ছড়িয়ে পড়েছে। কয়েকশো কৃষক সংগঠনের যুক্ত মঞ্চ এসকেএম (সংযুক্ত কিসান মোর্চা)-র শরিক সংগঠনগুলি, বিশেষ করে এআইকেকেএমএস বিভিন্ন রাজ্যে প্রতিদিনই বিক্ষোভ, ধরনা, অনশন, অবস্থান চালিয়ে যাচ্ছে। কৃষি আইন বাতিলের দাবিতে একবার কৃষক সংগঠনগুলির ডাকে গ্রামীণ ভারত বনধ হল, দু’বার সারা ভারত সাধারণ ধর্মঘট হল। কয়েক কোটি মানুষ ধর্মঘট সফল করতে সক্রিয়ভাবে সামিল হয়েছে। দেশের শ্রমিক কর্মচারীরা এই আন্দোলনের পাশে দাঁড়িয়েছে। ছাত্র-যুব-মহিলারাও আন্দোলনের সমর্থনে রাস্তায় নেমেছে। অভিনেতা থেকে গায়ক, ক্রিকেটার– একের পর এক বিশিষ্ট ব্যক্তিত্বরা আন্দোলনকে সমর্থন করছেন প্রকাশ্যে। পদক ফিরিয়েছেন অনেকেই। এই আন্দোলনকে শুধুমাত্র কৃষক আন্দোলন বললে খণ্ড দর্শন হবে। কৃষক অন্নদাতা। সে আজ বিপন্ন– এটা উপলব্ধি করে সমাজের বাকি অংশের মানুষ আন্দোলনের পাশে এসে দাঁড়িয়েছেন। তাঁরা আন্দোলনকারীদের আর্থিক এবং বেঁচে থাকার রসদ জোগাচ্ছেন। চিকিৎসকরা দিচ্ছেন স্বেচ্ছায় চিকিৎসা পরিষেবা। এ এক সামাজিক আন্দোলন, সর্ব সাধারণের আন্দোলন। আক্ষরিক অর্থেই গণআন্দোলন।
প্র : একটা প্রচার চলছে, তা হল– এটা ধনী কৃষকের আন্দোলন। আরও প্রচার হচ্ছে, শুধুমাত্র পাঞ্জাব এবং হরিয়ানার কৃষকরাই এই আন্দোলনে রয়েছে। বাস্তবটা কি তাই?
উ : অসৎ উদ্দেশ্য থেকে এই প্রচারটা তুলছে সরকার পক্ষ। বাস্তবে অবস্থাপন্ন কৃষক, মাঝারি ও প্রান্তিক কৃষক, ভূমিহীন খেতমজুর সকলেই এই কৃষি নীতিতে উদ্বিগ্ন। সকলেই কর্পোরেটদের আগ্রাসনের মুখে। ফলে অস্তিত্ব রক্ষার জন্যই তারা এই আন্দোলনে সামিল। এ কথা ঠিক, শুরুর দিকে পাঞ্জাব হরিয়ানার কৃষকরাই ব্যাপক সংখ্যায় আন্দোলনে ছিল। এখন রাজস্থান, উত্তরাখণ্ড, উত্তরপ্রদেশ, মধ্যপ্রদেশ, মহারাষ্ট্র, তামিলনাড়ু প্রভৃতি রাজ্য থেকে কৃষকরা যেমন আন্দোলনে যোগ দিয়েছেন তেমনই এই আন্দোলনের সমর্থনে প্রতিটি রাজ্যে কৃষক ধরনা মঞ্চ, অবস্থান, সভা, মিছিল, প্রচার চলছে এবং তা দিন দিন বাড়ছে। ফলে আন্দোলন সর্বভারতীয় রূপ নিয়েছে এবং সকল স্তরের সাধারণ মানুষ এতে সামিল।
প্র : প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি বলছেন এই কৃষিনীতি ‘যুগান্তকারী’, ‘ঐতিহাসিক’। তাঁর রেডিও অনুষ্ঠান ‘মন কি বাত’-এ তিনি বলেছেন, এই আইনে কৃষকদের দীর্ঘ দিনের শৃঙ্খল মোচন ঘটেছে। সত্যিই কি তাই?
উ : এই কৃষিনীতি সত্যিই যুগান্তকারী। কিন্তু তা কৃষকের স্বার্থে যুগান্তকারী নয়, আম্বানি-আদানিদের মতো কর্পোরেটদের স্বার্থে যুগান্তকারী। এই কৃষিনীতিকে প্রধানমন্ত্রী বলেছেন শৃঙ্খল মোচনকারী।
বাস্তবে কৃষকরা কোথায় শৃঙ্খলিত এবং সেই শৃঙ্খলটিই বা কী? শৃঙ্খলটা আজ প্রকাশ্যে এবং তা হল– পুঁজির শোষণের শৃঙ্খল, কর্পোরেটদের কাছে যে শৃঙ্খলে কৃষক ইতিমধ্যেই বাঁধা পড়েছে। যে সার, বীজ, কীটনাশক দিয়ে কৃষক চাষ করে তার কোনওটির উপর কৃষকের নিয়ন্ত্রণ নেই, নিয়ন্ত্রণ রয়েছে বড় বড় কর্পোরেটদের। তারা যে দাম নির্ধারণ করবে কৃষক সেই দামে কিনতে বাধ্য। আবার ফসল বিক্রির সময় কর্পোরেটরা যে ন্যূনতম দাম দেবে সেই দামেই কৃষককে বিক্রি করতে হবে। দাম ঠিক করার অধিকার বা স্বাধীনতা কিছুই কৃষকের নেই। সরকারি উদ্যোগে কেনার ব্যবস্থা অত্যন্ত দুর্বল বলে বৃহৎ ব্যবসায়ী বা তাদের এজেন্টরা কৃষদের এভাবে শোষণ করেই চলেছে। নতুন কৃষি আইনে সরকারি উদ্যোগে কেনার ব্যবস্থা আরও দুর্বল হবে, মান্ডিগুলো অকার্যকরী হয়ে যাবে। ন্যূনতম সহায়ক মূল্যও (এমএসপি) উঠে যাবে। ফলে শৃঙ্খল মোচনের পরিবর্তে কৃষকরা কর্পোরেটদের শোষণের শৃঙ্খলে আরও বেশি বেশি করে বাঁধা পড়বে। কাজেই প্রধানমন্ত্রীর কথা সম্পূর্ণ অসত্য।
প্র : প্রথম কৃষি আইনটি মুক্ত বাণিজ্য সম্পর্কিত। এতে মান্ডির বাইরেও কৃষিপণ্য বিক্রির অধিকার দেওয়া হয়েছে। সেখানে কর্পোরেটরা সরাসরি কৃষকের কাছ থেকে কিনবে। কোনও মধ্যসত্বভোগী থাকবে না। প্রধানমন্ত্রী বলছেন, এতে কৃষক ন্যায্য দাম পাবে।
উ : প্রধানমন্ত্রীর এই বক্তব্যের সাথে বাস্তবের কোনও মিল নেই। বর্তমানে মান্ডি এবং মান্ডির বাইরে দু’জায়গাতেই বেচাকেনার ব্যবস্থা আছে। যেখানে মান্ডি নেই, সেখানে কি এখন কৃষকরা ন্যায্য দাম পাচ্ছে? বৃহৎ ব্যবসায়ী ও তাদের এজেন্টদের চক্র দাম নামিয়ে দিচ্ছে। মান্ডি থাকলে সেখানে ন্যূনতম সহায়ক মূল্য পাওয়ার একটা সুযোগ থাকে। নতুন কৃষি আইনে মান্ডির বাইরে বিক্রির বৈধতা দেওয়া হয়েছে এবং সেখানে বড় বড় কর্পোরেটরা কৃষিপণ্য কিনবে। কিন্তু তারা ন্যায্য দাম দেবে– এই বিশ্বাসের কোনও ভিত্তি নেই।
মান্ডির বাইরে বিক্রির অধিকার দিতে হবে– এটা কোনও দিনই কৃষকের দাবি ছিল না। কৃষকের দাবি ছিল, সরকার সরাসরি ন্যায্য মূল্যে কৃষকের কাছ থেকে ফসল কিনুক। কারণ যুগযুগ ধরে সে প্রতারিত হচ্ছে বৃহৎ ব্যবসায়ী ও তার এজেন্টদের দ্বারা। মান্ডির বাইরে বিক্রির অধিকার দেওয়ার দাবি তুলেছে কর্পোরেটরা। তীব্র বাজার সংকটে জর্জরিত কর্পোরেটরা খাদ্য পণ্যের ব্যবসায় ঢুকতে দীর্ঘ দিন ধরে সরকারের উপর চাপ বাড়াচ্ছিল যাতে সরকার পুরনো আইন বাতিল করে একটা নতুন আইন করে দেয়। এদের চাপেই সরকার নতুন কৃষি আইন এনেছে।
কৃষিপণ্য কেনার অধিকার কর্পোরেটদের দিয়ে দিলে বিপদটা দু’জায়গায়। প্রথমত, সে মুনাফা সর্বোচ্চ করতে প্রভাব খাটিয়ে কৃষককে কম দাম দেবে। দ্বিতীয়ত, সে খাদ্য পণ্যের উপর একচেটিয়া নিয়ন্ত্রণ কায়েম করে ইচ্ছা মতো দাম বাড়াবে। এতে কৃষক-অকৃষক নির্বিশেষে সমস্ত ক্রেতার জীবন তীব্র মূল্যবৃদ্ধিতে জেরবার হবে। অনাহারে মরার উপক্রম হবে।
প্র : দ্বিতীয় কৃষি আইনটি মজুতদারি সম্পর্কিত। এতে মজুতের ঊর্ধ্বসীমা তুলে দেওয়া হয়েছে। অত্যাবশ্যক পণ্য তালিকা থেকে বাদ দেওয়া হয়েছে চাল, ডাল, গম, তৈলবীজ, আলু, পেঁয়াজ– এইসব নিত্য প্রয়োজনীয় পণ্যকে। এতে মজুতদারি বাড়বে। এই আইনটি বেশি করে আলোচিত হচ্ছে না। যাঁরা কৃষি নীতির পক্ষে বলছেন, তাঁরাও এ বিষয়ে খুব একটা বলছেন না। এর কারণ কী?
উ : এই আইনের পক্ষে জোরালো সওয়াল খুব একটা লক্ষ করা যাচ্ছে না। কারণ মজুতদারি কালোবাজারি জনমনে অত্যন্ত ঘৃণার। তবুও কর্পোরেটভক্ত কেউ কেউ বলছেন, মজুতদারির সুযোগ থাকলেই কি ইচ্ছামতো মজুতদারি হবে? প্র হল, যদি ইচ্ছামতো মজুতদারি নাই হবে, তা হলে মজুতদারি বৈধ করতে আইন করা হল কেন? কেন মজুতের ঊর্ধ্বসীমা তুলে দেওয়া হল? কেনই বা রিলায়েন্সের মতো দৈত্যাকার কর্পোরেটগুলো বড় বড় গোডাউন বানিয়ে মজুতদারির পরিকাঠামো গড়ে তুলেছে? মজুতদারিতে লাভ পুঁজিপতিশ্রেণির। তারা পণ্য মজুত করে বাজারে কৃত্রিম অভাব সৃষ্টি করে জিনিসপত্রের দাম বাড়ায়। এই মজুতদারির জন্যই গত সেপ্টেম্বর-অক্টোবরে পেঁয়াজ হয়ে গেল ৭০-৮০ টাকা কেজি, আলু হল ৪০-৫০ টাকা কেজি। এভাবেই জনগণের পকেট কাটল তারা। সেই মজুতদারি আইন সাধারণ মানুষ মেনে নিতে পারেন?
প্র : কিন্তু দেশের বহু পণ্যের বাজারই তো কর্পোরেটদের নিয়ন্ত্রণে। তার দ্বারা কি সাধারণ মানুষের বিশাল কিছু ক্ষতি হয়েছে?
উ : প্রথমত, কর্পোরেট নিয়ন্ত্রিত প্রতিটি জিনিসের দাম লাগাম ছাড়া। দ্বিতীয়ত, খাদ্যের সাথে অন্যান্য পণ্যের একটা মৌলিক পার্থক্য আছে। খাদ্য ছাড়া চলে না, কিন্তু বিলাসদ্রব্য ঠিক সেই রকম নয়। খাদ্যের নিয়ন্ত্রণ মুনাফাখোরদের হাতে ছেড়ে দিলে তারা মুনাফা লুটতে ইচ্ছামতো দাম বাড়াবেই এবং মানুষ স্থাবর-অস্থাবর সম্পত্তি বিক্রি করে হলেও তা কিনতে বাধ্য থাকবে। কারণ খাদ্য ছাড়া বাঁচা যায় না। কিন্তু যারা কর্পোরেটদের স্বার্থের কথা ভাবে তারা বলছে, অন্য পণ্যের মতো খাদ্যের বাজারও মুক্ত করে দাও। কারণ খাদ্যের বাজারের একটা আপেক্ষিক স্থায়ীত্ব আছে। তীব্র মন্দায় হাবুডুবু খাওয়া পুঁজিপতিরা বাজারের স্থায়ীত্ব খুঁজছে। তাই খাদ্য ব্যবসায় ঢুকতে চাইছে। এর পরিণাম ভয়াবহ। ফলে সাধারণ মানুষের স্বার্থের দিক থেকে বিচার করলে খাদ্যের ব্যবসা হওয়া উচিত সম্পূর্ণ রাষ্ট্রীয় তদারকিতেই। তাছাড়া খাদ্যের ব্যবসায় কর্পোরেটরা ঢুকলে দেশের লক্ষ লক্ষ খুচরো ব্যবসায়ী বিপন্ন হবে। ফলে মানুষের জীবন-জীবিকার উপর এ এক মারাত্মক আক্রমণ।
প্র : এটাও খুব প্রচলিত ধারণা যে বাজারে বহু কর্পোরেটের নিয়ন্ত্রণ কায়েম হলে প্রতিযোগিতায় দাম কমার তো একটা সুযোগ থাকেই।
উ : এটা একেবারেই ভুল ধারণা। ওষুধের বাজারে বহু কর্পোরেটেরই তো নিয়ন্ত্রণ রয়েছে। তাতে কি দাম কমেছে? নাকি বেড়েই চলেছে? বাস্তবে বহু কর্পোরেট প্রতিযোগিতার বদলে একজোট হয়ে নিজেরা বোঝাপড়া করে পণ্যের দাম একযোগে বাড়ায়। এরাই চাষির কাছ থেকে কেনার ক্ষেত্রে প্রতিযোগিতায় দাম বাড়ানোর পরিবর্তে একজোট হয়ে অবিশ্বাস্য রকম দাম কমাবে এবং কমায়। তা না হলে যে টম্যাটো কিছু দিন আগেও ৭০-৮০ টাকা কেজি দরে বিক্রি করল ব্যবসায়ীরা সেই টম্যাটো ১ টাকা, ২ টাকা কেজি দরে বিক্রি করতে বাধ্য হবে কেন কৃষক? প্রতিযোগিতায় দাম কমে– এটা পুঁজিবাদী অর্থনীতির বস্তাপচা, অতি সরলিকৃত একটা তত্ত্ব। কৃষকরা বারবার ঠকতে ঠকতে এই তত্তে্বর অন্তঃসারশূন্যতা সহজেই বোঝেন। তাই তারা আন্দোলনে।
প্র : তৃতীয় কৃষি আইনটি হল চুক্তি চাষ সম্পর্কিত। এই আইনে কর্পোরেটরা চাষির সঙ্গে ফসল কেনায় চুক্তিবদ্ধ হবে। বলা হচ্ছে এটি কৃষকের পক্ষে লাভজনক। কারণ চুক্তিমাফিক সে দাম পাবে। ফড়েদের দ্বারা প্রতারিত হওয়ার কোনও ব্যাপারই নেই। এই আইন নিয়ে চাষিদের আপত্তি কোথায় এবং কেন?
উ : চুক্তি চাষ নিয়ে আপত্তির কারণ বহু। প্রথমত, চাষ করতে হবে কর্পোরেটের চাহিদা মতো। সে যে ফসল চাষ করতে বলবে, কৃষককে সেটাই করতে হবে। অর্থাৎ চাষের ব্যাপারে কৃষকের স্বাধীনতা থাকবে না।
দ্বিতীয়ত, চুক্তি চাষে কৃষক বেশি দাম পাবে– এ যুক্তি ঠিক নয়। বাজারের গড়পড়তা দামের থেকে বেশি দাম কৃষককে কর্পোরেটরা দেবে কেন? বাস্তবে চুক্তি হবে সম্ভাব্য গড়পড়তা দামের থেকে কম দামেই। তাছাড়া চুক্তি অনুযায়ী যে দামে কৃষক ফসল বিক্রি করল, পরে যদি দাম বেশি হয় তা হলে তার লোকসান হবে।
তৃতীয়ত, চুক্তি হবে বিশেষ গুণমানের ফসলের ভিত্তিতে। সেই গুণমানের ফসল যদি না ফলে? যদি বৃষ্টিপাতের তারতম্য, আবহাওয়ার তারতম্য, কীটপতঙ্গের উৎপাত ইত্যাদি নানাবিধ কারণে ফসল সেই গুণমানের না হয়? তাহলে সেই ফসল কর্পোরেটরা নাও কিনতে পারে। কর্পোরেটরা তখন চাষিকে দায়ী করবে চুক্তিভঙ্গকারী হিসাবে। তখন যদি বিশেষ গুণমানের ফসল না দেওয়ার জন্য তার ব্যবসার ক্ষতি দেখিয়ে বিরাট অঙ্কের টাকা ক্ষতিপূরণ দাবি করে কর্পোরেটরা, কৃষক দেবে কোত্থেকে? ফসল চুক্তি অনুযায়ী গুণমানের হয়নি– এই যুক্তি তুলে যদি কর্পোরেটরা চুক্তি অনুযায়ী টাকা দিতে অস্বীকার করে, কী করবে কৃষক? ফলে নানা কারণে চুক্তিভঙ্গের অজুহাত তোলা ও কৃষককে ফাঁদে ফেলার সম্ভাবনা থাকছেই।
চতুর্থত, ফসলের গুণমান সম্পর্কিত বিবাদ শেষ পর্যন্ত আদালত অবধি পৌঁছাবে। সেখানে কি চাষি ন্যায় বিচার পাবে? বিপুল অর্থবলে বলীয়ান কর্পোরেটদের সঙ্গে আইনি লড়াইয়ে কৃষক জিততে পারবে? একটা ভাল আইনজ্ঞ রাখার বিপুল খরচ কৃষক বহন করতে পারবে? ফলে চুক্তি চাষ কৃষককে ফাঁদে ফেলার একটা মারাত্মক কৌশল।
প্র : নীতি আয়োগের বড় কর্তা অমিতাভ কান্ত কৃষি আইন পাশ হওয়ার পরে উচ্ছ্বসিত হয়ে বলেছিলেন, নব্বইয়ের (১৯৯০) আর্থিক সংস্কার এতদিনে কৃষিতেও এসে পৌঁছল। ‘৯০-এর আর্থিক সংস্কারের অভিমুখটা কী ছিল? তার সাথে বর্তমান কৃষি সংস্কারের সম্পর্কটিই বা কী?
উ : ‘৯০-এর আর্থিক সংস্কারটিকে বলা হয় এক কথায় এলপিজি। লিবারেলাইজেশন প্রাইভেটাইজেশন ও গ্লোবালাইজেশন। কর্পোরেটদের জন্য সব কিছু উদার করে দাও, রাষ্ট্রায়ত্ত সম্পত্তি তাদের হাতে তুলে দাও, আর বিশ্ব পুঁজির হাতে বাজার উন্মুক্ত করে দাও। কংগ্রেসের প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিংয়ের হাত ধরে আসা এই সংস্কারের লক্ষ্য ছিল মন্দায় আক্রান্ত পুঁজিবাদী বাজারকে কিছুটা চাঙ্গা করা। সেদিনও একদল মানুষ বিভ্রান্ত হয়ে এর পক্ষে দাঁড়িয়েছিল। শেষ পর্যন্ত বিশ্বায়নের ফল কী দাঁড়াল? ২০১৫ সাল ছিল বিশ্বায়নের ২৫ বছর। নানা সমীক্ষা দেখাল বিশ্বায়ন ব্যর্থ। পুঁজিবাদী বাজারে কোনও স্থায়ীত্ব এল না। কেন এল না? কারণ পুঁজিবাদী অর্থনীতি প্রতি মুহূর্তে মন্দার জন্ম দিয়ে চলেছে। এখন পুঁজিপতিরা বিনিয়োগের নতুন ক্ষেত্র হিসাবে কৃষির দিকে তাকিয়ে রয়েছে। তাদের চাপেই সরকার কৃষিপণ্যের বাজার পুঁজিপতিদের জন্য খুলে দিয়েছে।
প্র : প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি অভিযোগ করেছেন, অত্যন্ত প্রয়োজনীয় এই সংস্কার কংগ্রেস সরকারও আনতে চেয়েছিল, পারেনি।
উ : ঠিকই তো। কর্পোরেটদের অন্যতম বিশ্বস্ত সেবক হিসাবে কংগ্রেস সরকারও শ্রম আইন, কৃষি আইন সংস্কার করার চেষ্টা করেছে। কিন্তু নানা কারণে পারেনি। বিজেপি সরকার সেটা পারল পার্লামেন্টে নিরঙ্কুশ সংখ্যা গরিষ্ঠতার সুযোগ নিয়ে। এখন ভোট রাজনীতির অঙ্ক কষে কংগ্রেস কৃষিনীতির বিরুদ্ধে বিবৃতি দিচ্ছে এবং তা সংবাদপত্রে ছাপা হচ্ছে। যে কংগ্রেস ‘৯০-এর আর্থিক সংস্কারের উদগাতা, যে কংগ্রেস কৃষি আইন সংস্কারের চেষ্টা করেছে, সেই কংগ্রেস কি আন্দোলনের শক্তি হতে পারে? দুর্ভাগ্য এই কংগ্রেসকেই আন্দোলনের শক্তি বলছে সিপিএম ফ্রন্ট। কংগ্রেস কোথায় কৃষি নীতির বিরুদ্ধে লড়ছে? সিপিএমও কি তার সর্বশক্তি নিয়োগ করে আন্দোলনে নেমেছে? ভোটের স্বার্থে যতটুকু আন্দোলন-আন্দোলন মহড়া দরকার তাই করছে।
প্র : এই কৃষক আন্দোলনকে শাসক শিবির কখনও বলছে খালিস্তানি, কখনও পাকিস্তানি, কখনও বলছে অতিবামদের কবলে। কী তাদের মতলব?
উ : জনস্বার্থে গড়ে ওঠা প্রতিবাদ আন্দোলনকে অতি বাম, খালিস্তানি রূপে দেগে দিয়ে তার গুরুত্বকে খাটো করে দেওয়া শাসকশ্রেণির কৌশল। যেমন নন্দীগ্রামের কৃষক আন্দোলনকে মাওবাদী বলেছিল সিপিএম সরকার। আর প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি যে কোনও প্রতিবাদকেই বলেন দেশদ্রোহীতা। জাতীয় পতাকা হাতে নিয়ে যে কৃষকরা দিল্লিতে শান্তিপূর্ণভাবে একমাস ধরে অবস্থান করছেন তাঁরা দেশদ্রোহী? অবশ্য আম্বানি-আদানিদের দেশ বললে, তাদের স্বার্থে আনা কৃষি আইনের বিরোধিতা তো দেশ বিরোধী হবেই।
প্র : কৃষি আইনের পক্ষে পুঁজিপতিরা, জনগণ বিপক্ষে। তা হলে আইনের চোখে সকলেই সমান– এই ধারণার ভিত্তি কী?
উ : আইনের চোখে সকলেই সমান– এই ধারণাকে কৃষক আন্দোলন জোর ধাক্কা দিয়েছে। শুধু কৃষি আইন কেন, ৪৪টি শ্রম আইন পাল্টে যে চারটি নতুন শ্রম আইন এনেছে মোদি সরকার, তার পক্ষে বাজনা বাজাচ্ছে মালিকরা, আর বিরুদ্ধে লড়ছে শ্রমিকরা। কারণ সেই আইন মালিকের স্বার্থে। আইন সবার জন্য সমান, বাস্তবে এটা একটা মিথ্যা কথা। পুঁজিবাদী সমাজে আইন সবার জন্য সমান– এটা লিখিত-পড়িত থাকলেও বাস্তবে আইন হচ্ছে মালিক শ্রেণির জন্য। পুঁজিবাদী সমাজে যে আইনে শ্রমিক-চাষিদের পক্ষে সামান্য হলেও কিছু উল্লেখ আছে– সেগুলিও মালিকরা ক্রমাগত পাল্টাচ্ছে। এর মধ্য দিয়ে কর্পোরেটদের একচেটিয়া নিয়ন্ত্রণ কায়েম হচ্ছে, যা ফ্যাসিবাদেরই চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য।
প্র : রাষ্ট্রবিজ্ঞানের বইয়ে লেখা আছে সরকার হল– বাই দ্য পিপল, ফর দ্য পিপল, অব দ্য পিপল। দিল্লির কৃষক আন্দোলনের প্রেক্ষিতে এই ধারণা কতটা প্রাসঙ্গিক?
উ : সম্পূর্ণ অপ্রাসঙ্গিক। বাস্তবে সরকার বাই দ্য আদানি, ফর দ্য আদানি, অব দ্য আদানি। পুঁজিপতিদের দ্বারা, পুঁজিপতিদের জন্য, পুঁজিপতিদের সরকার। তাই, এই প্রবল শীতে এক মাস ধরে খোলা আকাশের নীচে কৃষকরা দিল্লিতে অবস্থান করলেও এ সরকার কৃষকদের কোনও দাবিই মানছে না। শ্রমিকদের দাবি মানছে না। জনগণের কোনও অংশেরই দাবি মানছে না। তাদের স্বার্থকে বিপন্ন করে পুঁজিপতিদের স্বার্থে যা যা করণীয় সবই করছে সরকার। একে শ্রমিক-কৃষকের সরকার কে বলবে? বাস্তবে দেশে চলছে কর্পোরেট রাজ। এই রাজে শ্রমিক-কৃষকের স্বার্থ পূরণ হতে পারে না। সে জন্য কায়েম করতে হবে শ্রমিক-কৃষকের রাজ। দিল্লির ঐতিহাসিক আন্দোলন এই শিক্ষাটিই তুলে ধরেছে।