পশ্চিমবঙ্গে প্রায় ৫৫ হাজার আশাকর্মী রয়েছেন। গ্রামবাংলার তৃণমূল স্তরের জনস্বাস্থ্যের ভার এঁদের ওপর। কার জ্বর হয়েছে, কোন মায়ের কী অবস্থা, কে কুষ্ঠরোগে আক্রান্ত, শিশুদের আয়রন খাওয়ানো, টিকার ব্যবস্থা করা, গর্ভবতী মহিলাদের দিনে রাতে যখনই দরকার হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া, সুগার, প্রেশার, হার্টের রোগী শনাক্ত করা, টিবি রোগীকে ওষুধ খাওয়ানো ইত্যাদি নানা পরিষেবা দিয়ে চলেছেন আশাকর্মীরা। গত বছর থেকে বাড়তি যুক্ত হয়েছে করোনা চিকিৎসার দায়িত্ব। প্রতিদিন বাড়ি বাড়ি গিয়ে সার্ভে করা, কারও জ্বর হলে করোনা টেস্টের ব্যবস্থা করা, করোনা পজিটিভ হলে ওষুধ বাড়ি পৌঁছে দেওয়া, প্রতিদিন অক্সিজেন মাপা, ভ্যাকসিনের জন্য তালিকা প্রস্তুত করা এবং সমস্ত রিপোর্ট প্রতিদিন সেন্টারে গিয়ে জমা দেওয়া। এক কথায় স্বাস্থ্য পরিষেবার বিরাট দায়িত্ব এঁদের উপর। তবুও কেন্দ্র ও রাজ্য সরকার এঁদের সরকারি কর্মীর স্বীকৃতি দিচ্ছে না।
পুরুলিয়ার বান্দোয়ান সেন্টারের আশাকর্মী দ্রৌপদী মাহাতো। নিজে সুগারের রোগী, এইসব কাজ করতে করতেই একদিন জ্বরে পড়লেন। এর মধ্যেও কাজ করে যেতে হয়েছে। ছ’দিন পর খাওয়া বন্ধ হয়ে যায়। শয্যাশায়ী অবস্থায় হাসপাতালে ভর্তি করার চার দিনের মাথায় শ্বাসকষ্টে মৃত্যু হয় তাঁর। বাড়িতে দুই নাবালক সন্তান। তাঁর স্বামীর প্রশ্ন, ‘সরকারি কোনও সাহায্য পাওয়া যাবে কি’? কিন্তু বৃথা তাঁর আবেদন, কারণ, কর্মরত অবস্থায় আশাকর্মীর মৃত্যু হলে তার পরিবারের জন্য সরকারের কোনও ক্ষতিপূরণের ব্যবস্থা নেই।
হাওড়া জেলার আশাকর্মী রেহানা কাজি। ব্রেন স্ট্রোক হয় তাঁর। দিনের পর দিন অক্লান্ত পরিশ্রম করার পরেও সরকার পাশে থাকেনি। চিকিৎসা চলাকালীন অসুস্থতার জন্য কাজ করতে পারেননি বলে তাঁর সাম্মানিক ভাতাটুকুও বন্ধ করে দেওয়া হয়। এরপর বলা হয় কাজ ছেড়ে দেওয়ার কথা। রেহানা একা নন। এরকম অনেক রেহানা দিনের পর দিন চরম সরকারি বঞ্চনা সহ্য করে চলেছেন।
মাসে মাত্র ২০০০ টাকা বেতন দিয়ে হাসপাতালে ‘দিশা’ ডিউটি চালু করেছে রাজ্য সরকার। আশাকর্মীদের বাধ্যতামূলক একমাস ব্লক হাসপাতালে কাজ করতে হয়। সদ্যোজাত শিশু ও মায়েদের পরিষেবা দেওয়া, হাসপাতালে নার্সদের ফাইফরমাশ খাটা- এই রকম সব কাজ করতে হয়। আট ঘণ্টা ডিউটি, লকডাউনে যানবাহন বন্ধ। হৃদরোগী হয়েও গত বছর লকডাউনে ৫২ বছর বয়সী ঝালদার এক আশাকর্মীকে প্রতিদিন ২২-২৩ কিলোমিটার সাইকেল চালিয়ে হাসপাতালে ডিউটি করতে যেতে আসতে হয়েছে। এক বছর আগে পুরুলিয়ার কোটশিলা ব্লকের আশাকর্মী সুভদ্রা মাহাতো হাসপাতালে ডিউটি করতে আসার পথে দুর্ঘটনায় মারা যান। উচ্চমাধ্যমিকের ছাত্রী তাঁর ১৮ বছরের মেয়ে কাঁদতে কাঁদতে আশাকর্মী ইউনিয়নের এক সংগঠককে বলেছিল ‘‘মাসি, মায়ের উপার্জনের টাকাতেই আমাদের পরিবার চলত। আমার আর ছোট ভাইয়ের পড়াশোনাও চলত ওই টাকাতেই। এখন কী করে চলবে? যদি মায়ের চাকরিটা পাওয়া যায় একটু দেখো।” বোকা মেয়ে জানত না, দায়িত্ব অস্বীকার করার জন্য নিয়োগের সময়ই আশাকর্মীদের ‘ভলান্টিয়ার’ করে দিয়েছে কেন্দ্রীয় সরকার। চাকরি তো দূরের কথা, মৃত্যুকালীন ক্ষতিপূরণ পর্যন্ত এক পয়সাও নেই।
কর্মরত অবস্থায় এরকমভাবে পশ্চিমবঙ্গের বহু আশাকর্মীর মৃত্যু হয়েছে। পিচমবঙ্গ আশাকর্মী ইউনিয়নের পক্ষ থেকে স্বাস্থ্য দপ্তরে বারবার প্রত্যেকটা ডেপুটেশনে কর্মরত অবস্থায় মৃত্যুর জন্য পরিবারকে ক্ষতিপূরণ দেওয়ার দাবি তোলা হয়, কিন্তু কি কেন্দ্র কি রাজ্য, কোন সরকারই কর্ণপাত করে না।
কেন্দ্রীয় সরকারের এনআরএইচএম-এর অন্তর্গত আশা প্রকল্প চালু হয় ২০০৫ সালে কেন্দ্রের কংগ্রেস নেতৃত্বাধীন প্রথম ইউপিএ সরকারের আমলে। প্রসূতি ও শিশুর মৃত্যুতে ভারত তখন বিশ্বে প্রথম সারিতে। গ্রামীণ ভারতের বেশিরভাগ মা তখনও বাড়িতেই শিশুর জন্ম দিতেন। মা ও শিশুকে হাসপাতালমুখী করা, আধুনিক চিকিৎসা পদ্ধতির তত্ত্বাবধানে নিয়ে আসাই ছিল মূল উদ্দেশ্য। ২০০৫ সাল থেকে ধাপে ধাপে ২০১১ সালের মধ্যে পিচমবঙ্গের সমস্ত ব্লকে আশাকর্মী নিয়োগ করা হয়। রাজ্যে এখন প্রতি ১২০০ জনে একজন, সবমিলিয়ে ৫৪,৮৪৮ জন আশাকর্মী কাজ করেন। এঁরা সকলেই গ্রামাঞ্চলের অভাবী সংসারের মেয়ে বউ, অনেকেই বিধবা। অনেকের পরিবারেই আশাকর্মীরাই একমাত্র রোজগেরে সদস্য। শুরুতে মা ও শিশুদের নিয়ে ৫-৬ ধরনের কাজ করতে হত। সাম্মানিক ভাতা ছিল ৮০০ টাকা, দৈনিক ভাতা মাত্র ২৬ টাকা। নিয়োগের সময় থেকেই আশাদের ‘স্বেচ্ছাসেবিকা’ আখ্যা দিয়ে শ্রমিকদের প্রাপ্য অধিকার থেকে বঞ্চিত করে কেন্দ্রের সরকার। সিপিএম পরিচালিত তৎকালীন রাজ্য সরকারও সম্পূর্ণ উদাসীন থাকে।
এদিকে কেন্দ্রীয় সরকার স্থায়ী কাজের বদলে প্রকল্পভিত্তিক কাজ শুরু করে। এই প্রকল্পভিত্তিক কর্মচারীদের একেবারে নামমাত্র সাম্মানিক ভাতা দিয়ে ওই সংক্রান্ত সরকারি সমস্ত কাজ তাদের ওপর চাপিয়ে দেওয়া শুরু হয়। ন্যাশনাল রুরাল হেলথ মিশনের অন্তর্গত আশাও এই ধরনের একটা প্রকল্প। এই আশাকর্মীদের প্রভিডেন্ট ফান্ড, গ্র্যাচুইটি, পেনশন, মেডিকেল ভাতা, ছুটি, মেডিকেল ছুটি, ইএসআই কোনকিছুই নেই। ‘নো ওয়ার্ক নো পে’ নিয়মে কাজ করতে হয়।
২০১১ সালে আশাকর্মীদের জন্য চালু হয় ফরম্যাট সিস্টেম। এই ফরম্যাটে ৪২ ধরনের পরিষেবার কাজ করতে বলা হয়। এর মধ্যে আছে মা ও শিশুর পরিষেবা সংক্রান্ত ২৬ রকমের কাজ ছাড়াও যক্ষ্মা, কুষ্ঠ, ম্যালেরিয়া, কালাজ্বর, প্রেশার, সুগার, হার্টের রোগ ইত্যাদি ১৬ রকমের কাজ। এ ছাড়াও রয়েছে পালস পোলিও, ফাইলেরিয়া, ব্লক হাসপাতালে ডিউটি, ভোটের ডিউটি, মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষার ডিউটি, সরকারি মেলায় ডিউটি, দুয়ারে সরকারের ডিউটি, কোভিড সংক্রান্ত নানা ডিউটি। এছাড়াও হঠাৎ হঠাৎ বিএমওএইচ বা বিডিও অফিস থেকে তাঁদের বিভিন্ন কাজ করার জন্য বলা হয়। না করলেই জবাবদিহি করতে হয়। অথচ এই বাড়তি সরকারি কাজের জন্য আশাকর্মী কোনও পারিশ্রমিক পান না। উপরন্তু এই সমস্ত কাজের জন্য নিজস্ব ফরম্যাটের কাজ করতে না পারলে ফরম্যাটের টাকা কাটা যায়। না পারলে কিংবা প্রশ্ন করলেই আধিকারিকরা কাজ চলে যাওয়ার হুমকি দেন।
এত ধরনের কাজের সঙ্গে যুক্ত থাকলেও আশাকর্মীদের পারিশ্রমিক মাসে ছয় সাত হাজার টাকার বেশি হয় না। তার প্রধান কারণ, ফরম্যাট সিস্টেমে এমন কিছু নিয়ম আছে যার ফলে আশাকর্মীদের কাজের ফলাফল ১০০ শতাংশ নিশ্চিত না হলে ফরম্যাটের টাকা দেওয়া হয় না। নানা ধরনের সার্ভে লিস্ট আশাদের তিনটে রেজিস্টারে প্রতিদিন নথিভুক্ত করতে হয়। কিন্তু যতক্ষণ পর্যন্ত রোগী পরিষেবা পেয়ে ১০০ ভাগ সুস্থ না হচ্ছে, ততক্ষণ আশাকর্মী কোনও টাকা পান না। মা ও শিশুর পরিষেবার কাজগুলি নির্দিষ্ট দিনে করতে হয়। কোনও কারণে ওই নির্দিষ্ট দিনে না করতে পারলে অথবা সাতটার মধ্যে একটা টিকা না দিতে পারলে বাকি টাকা কাটা যায়। প্রসবের পর নতুন মা বাপের বাড়ি চলে গেলে আশার কাজ সম্পূর্ণ হয় না। কাটা যায় মায়ের পরিষেবার সমস্ত টাকা। এ যেন সেই দাসযুগের দাসশ্রমিকের দশা, বিশ্বের ‘বৃহত্তম গণতন্ত্রের দেশে!
কোভিড চিকিৎসার দায়িত্ব পালন করতে হলেও আশাকর্মীদের জন্য সরকার কোনও সুরক্ষার ব্যবস্থা করেনি। এ পর্যন্ত পশ্চিমবঙ্গের এক হাজারের বেশি আশাকর্মী কোভিডে আক্রান্ত হয়েছেন। গত বছর এই কাজের জন্য কেন্দ্র মাসে ১০০০ টাকা বরাদ্দ করেছিল। ছ মাস পর বন্ধ করে দেয়। রাজ্য সরকার গত বছর করোনা পজিটিভ স্বাস্থ্যকর্মীদের এক লক্ষ টাকা দেওয়ার কথা ঘোষণা করেছিল, কিন্তু আজ পর্যন্ত এ টাকা অধিকাংশ আশাকর্মীই পাননি।
২০১৪ সালে কেন্দ্রের বিজেপি সরকার এলে তাদের কাছেও বারবার আশাকর্মী ইউনিয়নের পক্ষ থেকে আশাকর্মীদের সরকারি স্বাস্থ্যকর্মীর স্বীকৃতি দেওয়ার দাবি জানানো হয়, কিন্তু সরকার কর্ণপাত করেনি। ২০১৯-এর ২৮ জানুয়ারি সারা ভারতবর্ষের আশাকর্মীরা দিল্লি অভিযান করেন। তার পাঁচদিন পর বাজেটে আশাকর্মীদের জন্য বেতন দ্বিগুণ করা ও পেনশন প্রকল্প চালু করার কথা ঘোষণা করা হয়। বলা হয় ওই বছর মার্চ মাস থেকে অনলাইনে পেনশন প্রকল্পে নাম নথিভুক্ত করা হবে। কিন্তু আজ পর্যন্ত তা কার্যকর করা হয়নি।
২০১১ সালে পশ্চিমবঙ্গে সরকার পরিবর্তন হয়ে ক্ষমতায় আসে তৃণমূল কংগ্রেস। তারপর থেকে আরও কাজের বোঝা বেড়ে যায় আশাকর্মীদের। ২০১৭ সালের ১৭ ডিসেম্বর পশ্চিমবঙ্গ আশাকর্মী ইউনিয়নের নেতৃত্বে প্রায় ৪০ হাজার আশাকর্মী কলকাতার ধর্মতলার রানী রাসমণি রোডে বিক্ষোভ দেখান। এই বিক্ষোভ দমন করার জন্য পরদিনই স্বাস্থ্য দপ্তর আশাকর্মীদের এবং সমস্ত আশা আধিকারিকদের অগণতান্ত্রিকভাবে শোকজ করে। আধিকারিকরা আশাকর্মীদের নানারকম হয়রানি করে এবং ভয় দেখাতে থাকে, কিন্তু আশাকর্মীরা– যাঁদের জীবনে বঞ্চনা ছাড়া প্রাপ্তি কিছু নেই, অদম্য মনোবলে আন্দোলন চালাতে থাকে। বাধ্য হয়ে রাজ্য সরকার ২০১৮-১৯ সালে আশাদের সাম্মানিক ভাতা দুই ধাপে দেড় হাজার টাকা বাড়ায়।
বাড়তি কাজের চাপে আশাদের এমনিতেই হিমশিম অবস্থা, তার উপর গত বছর থেকে করোনা অতিমারির বিপুল কাজের ভার আশাকর্মীদের ওপর চাপিয়ে দেওয়া হয় কোনরকম সুরক্ষা ব্যবস্থা ছাড়াই। আশাকর্মীদের বিক্ষোভের আগুন আবার জ্বলে ওঠে। শুরু হয় ধর্মঘট, কর্মবিরতি, জেলায় জেলায় বিক্ষোভ প্রদর্শন। রাজ্য সরকার আশাকর্মীদের কিছু কিছু দাবি মেনে নেয়। দীর্ঘদিনের দাবি মেনে বোনাস ২০০০ টাকা, অবসর ভাতা তিন লক্ষ টাকা এবং সাম্মানিক ভাতা ১০০০ টাকা বাড়ানো হয়। কিন্তু সরকারি কর্মী হিসাবে স্বীকৃতির মূল দাবি সরকার আজও মানছে না। এই অবস্থায় আন্দোলন তীব্রতর করা ছাড়া আশাকর্মীদের কোনও উপায় নেই।