৪ জুনই জানা যাবে কারা আগামী পাঁচটা বছর লোকসভা আলো করে বসে থাকবেন। প্রশ্নটা হল নতুন লোকসভাও কি বিগত লোকসভার মতো বিনা আলোচনায় বিল পাশের রেকর্ডের ট্র্যাডিশন চালিয়ে যাবে? বদলের বিশেষ কোনও আশা কি মানুষের আছে?
২০১৪-তে সংসদ ভবনকেগণতন্ত্রের মন্দির বলে তার সিঁড়িতে নরেন্দ্র মোদির সাষ্টাঙ্গ প্রণামের দৃশ্যটা মনে পড়ে? তিনি প্রধানমন্ত্রীর গদিতে ১০টা বছর কাটিয়ে ফেলেছেন। নতুন সংসদভবনও তৈরি হয়েছে। তা নাকি বিশেষ রকম তন্ত্র-মন্ত্র, বাস্তুশাস্ত্র দ্বারা সমস্ত ‘অশুভ শক্তি’ ও ‘কুনজর’ থেকে একেবারে সুরক্ষিত! বেড়েছে তার ঠাটবাট, জাঁকজমক। বহুমূল্য ‘সেঙ্গল’ সেখানকার পাহারাদার। আছে অনেক কিছু। কিন্তু গণতন্ত্র? তার অস্তিত্ব আছে কি?
রবীন্দ্রনাথের ভাষা ধার করে যদি ধরেও নিই ‘দেবতা নাই ঘরে’, তা হলে– ‘যেথায় মাটি কেটে করছে চাষা চাষ’– সেখানে কি পাওয়া যাবে প্রধানমন্ত্রী কথিত গণতন্ত্রের দেবতাকে? আন্দোলনরত কৃষকদের উপর মোদি সরকারের পুলিশের লাঠি, ড্রোন থেকে টিয়ার গ্যাস ছোঁড়ার ধুম দেখে তাও তো বলা যাবে না! অন্য কোনও ক্ষেত্রেও কি গণতান্ত্রিক পরিবেশের কোনও খোঁজ এ দেশে পাওয়া যাবে? বরং আজকের ভারতে চাষি, মজুর, সাধারণ মানুষ তো দূরের কথা, প্রতিষ্ঠিত সংবাদমাধ্যমের সাংবাদিকরা পর্যন্ত সরকারের সামান্য সমালোচনা করতে গেলেও পেয়াদায় তা শুনছে কি না বুঝতে চারপাশ দেখে নেন।
আর যাঁরা গণতন্ত্রের ‘মন্দির’ সংসদে বসে কথা বলার অধিকারী, সেই সাংসদরা? তাঁরাও কি অবাধে কথা বলতে পারছেন? এমনিতেই আজকের সাংসদ যাঁরা তাঁদের অধিকাংশকেই আর যাই হোক এ দেশের হতদরিদ্র জনসাধারণের প্রতিনিধি বলা যায় না। তাঁরা অধিকাংশই বহু কোটি টাকার মালিক, বিত্তবান মানুষ। ভোটের প্রচারের সময়টুকু ছাড়া তাঁরা সাধারণ মানুষের নাগালের অনেক বাইরে। আর এ দেশে এখন ভোট ব্যবস্থা যা, তাতে গরিব-মধ্যবিত্তের পক্ষে ভোটে দাঁড়ানোই দুষ্কর। কিন্তু, সে প্রসঙ্গ ছেড়ে দিয়ে আপাতত শুধু সংসদের মধ্যে সাংসদদের কথা বলার অধিকারটুকুতেই আলো ফেলা যাক।
রেকর্ড বলছে ১৯৫২ থেকে ১৯৯০ পর্যন্ত সংসদে কিছুটা অন্তত বিস্তারিত আলাপ আলোচনা, বিতর্ক, বিলের খুঁটিনাটি নিয়ে বিচারের সুযোগ ছিল। এই সময়কালে বছরে গড়ে ৬৫টি করে বিল সংসদে পাশ হয়েছে। কিন্তু তারপর সেই গড় নেমে এসেছে ৪৮-এ। আর নরেন্দ্র মোদির দ্বিতীয় দফায় ২০১৯-২০২৪-এর সপ্তদশ লোকসভা নেমেছে এই নিরিখে সবচেয়ে নিচে। ১৯৯০-এর আগে সংসদে পেশ করা ৭০ শতাংশ বিলই পাশ করানোর আগে খুঁটিয়ে যাচাই করার জন্য নানা সংসদীয় কমিটিতে পাঠানো হত। ফলে শাসক এবং বিরোধী উভয় পক্ষের সদস্যরাই বিল নিয়ে পর্যাপ্ত আলোচনার সুযোগ পেতেন। কিন্তু সপ্তদশ লোকসভায় ৮৪ শতাংশ বিলই সংসদীয় কমিটিতে কোনও পর্যালোচনা ছাড়াই পাশ হয়েছে। অর্থাৎ সরকারের মর্জিই আইন, তা খুঁটিয়ে বিচার করার সুযোগ সাংসদদেরও নেই! অবশ্য নরেন্দ্র মোদির নেতৃত্বে সপ্তদশ লোকসভা রেকর্ড করেছে কোনও আলোচনা ছাড়া কয়েক মিনিটে একাধিক বিল পাশ করার কৃতিত্বে।
কমেছে সংসদে আলাপ আলোচনার সময়। ১৯৫২ থেকে ১৯৯০ পর্যন্ত প্রতিটি লোকসভার মেয়াদে ৫৫০দিন করে অধিবেশন বসেছে, বিতর্ক-আলোচনার় গড় সময় ৩৫০০ ঘণ্টা। পরে তা কমতে কমতে ১৭তম লোকসভার পাঁচ বছরে মাত্র ২৭৪ দিনে দাঁড়িয়েছে। ১৯৫২ থেকে ধরলে এটিই সর্বনিম্ন। দৃষ্টি আকর্ষণী প্রস্তাব, মুলতুবি প্রস্তাব, নোটিস ইত্যাদি যা কিছুর মাধ্যমে সাংসদরা তাঁদের বক্তব্য তুলে ধরতে পারেন, তার প্রত্যেকটির সুযোগ দিনে দিনে কমেছে। দৃষ্টি আকর্ষণী নোটিসের ভিত্তিতে সরকারের কাছে জবাবদিহি চেয়ে আলোচনা ১৯৫৭ থেকে ১৯৯০ পর্যন্ত ছিল প্রতি লোকসভার মেয়াদকালে গড়ে ৩০০টি। তারপর তা কমতে কমতে হয়েছিল ৪০, সপ্তদশ লোকসভায় মাত্র ১টি। জরুরি ভিত্তিতে কোনও বিষয় আলোচনার জন্য মুলতুবি প্রস্তাব গত পাঁচ বছরে একটিও গৃহীত হয়নি।
রাজ্যসভায় বিরোধী সাংসদদের কোনও ধরনের নোটিসই গৃহীত হয়নি। বিরোধীদের আনা ৩০০টি প্রশ্ন বাতিল করে দেওয়া হয়েছে। যত দিন গেছে কেন্দ্রীয় বাজেট নিয়ে আলোচনার সময় ক্রমাগত কমেছে। কেন্দ্রীয় মন্ত্রকগুলির বাজেট ধরে ধরে নির্দিষ্ট আলোচনা ১৯৯০-এর আগে কোনওদিন বাদ যায়নি, তার পর থেকে মন্ত্রক ধরে কোনও আলোচনা বন্ধ। গলার জোরেই বাজেট পাশই রীতি দাঁড়িয়েছে। সপ্তদশ লোকসভার পাঁচ বছরে কোনও ডেপুটি স্পিকার ছিলেন না, কারণ রীতি অনুযায়ী একজন বিরোধী দলের সদস্যকে এই পদে নির্বাচিত করতে হয়। নরেন্দ্র মোদির গণতন্ত্রের মন্দিরে তা অসম্ভব। বিরোধী সদস্যরা প্রধানমন্ত্রীর নাম করে কিছু বললেই রাজ্যসভার চেয়ারম্যান তা কার্যবিবরণী থেকে বাদ দিয়েছেন। প্রধানমন্ত্রী-ঘনিষ্ঠ শিল্পপতিদের নিয়ে সংসদের প্রশ্ন তোলায় বিরোধী সাংসদের সদস্য পদ গেছে। দেশবাসী দেখেছে এই সংসদে সমস্ত বিরোধী সাংসদকে বহিষ্কার করে দিয়ে সরকার কী ভাবে একের পর এক বিল পাশ করিয়ে নিয়েছে। বুর্জোয়া সংসদীয় ব্যবস্থার প্রবক্তারা তো বটেই, এ দেশের স্বাধীনতার সময়েও সংসদে যাঁরা বসেছিলেন তাঁরা বোধহয় এমন দৃশ্য কল্পনা করতে পারতেন না। আজ নরেন্দ্র মোদি সাহেব এমন এক প্রধানমন্ত্রী, যিনি কোনও দিন সাংবাদিক সম্মেলনে কোনও প্রশ্নের উত্তর দেননি। শুধু তাই নয়, তিনি ১০ বছরে কোনও দিন রাজ্যসভা বা লোকসভাতে কোনও প্রশ্নোত্তর পর্বে অংশ নেননি, তাঁর হাতে থাকা কোনও দপ্তরের সম্বন্ধে কোনও প্রশ্নের উত্তর দেননি। তিনি বলতে দড়, শুনতে নন। সংসদে বসে ‘জয় শ্রীরাম’ ধ্বনিতে বিরোধী কণ্ঠস্বর চাপা দেওয়া নরেন্দ্র মোদির অনুচর বাহিনীর কাছে তথ্য-যুক্তি-বিতর্ক– এ সব অন্য গ্রহের বিষয়। ফলে ভারতীয় সংসদে এখন গলাবাজিই সত্য। সেখানে মানুষের ব্যথা-বেদনা-অভাব-সঙ্কট নিরসনের দাবি নিয়ে আলোচনার প্রশ্নই ওঠে না।
সংসদীয় ব্যবস্থার বিশেষজ্ঞ এবং লোকসভার প্রাক্তন সেক্রেটারি জেনারেল ডঃ সুভাষ কশ্যপের বহু পরিশ্রমে সংকলিত তথ্য (দ্য হিন্দু, ১৪.০২.২০২৪) এবং গবেষণা একটা সরল সত্যকে তুলে ধরেছে, ১৯৯০-এর পর থেকে ভারতে সাংসদদের মুখ খোলার সুযোগ ক্রমাগত কমে চলেছে। নরেন্দ্র মোদির প্রধানমন্ত্রিত্ব তাকে একেবারে তলানিতে নামিয়ে দিয়েছে।
কেন এমনটা হল? বুর্জোয়া সংসদীয় ব্যবস্থায় গণতন্ত্রের ভাগ ক্রমাগত ক্ষয়ের পথে যেতে শুরু করেছে বহু দিন থেকেই। কিন্তু ডঃ কশ্যপ দেখিয়েছেন, তার ক্ষয় আরও দ্রুত শুরু হয়েছে ১৯৯০-এর পর থেকে। কেন? তা বুঝতে গেলে তাকাতে হবে আর একটা দিকে। ১৯৯০-এর আগে দুনিয়াতে সমাজতান্ত্রিক শিবির় ছিল। তার ফলে বুর্জোয়া শাসকদের উপরেও চাপ থাকত তাদের নিজ নিজ দেশের জনগণকে অন্তত একটু নিঃশ্বাস ফেলার পরিসর দেওয়ার। সমাজতান্ত্রিক ব্যবস্থা জনগণকে যে ধরনের গণতান্ত্রিক অধিকার দিত তার সাথে বুর্জোয়া ব্যবস্থার নিতান্ত খণ্ডিত অধিকারের পার্থক্য জনগণের চোখে ধরা পড়তই। পুঁজিবাদী দেশগুলির শাসকদের আশঙ্কা ছিল এতে সমাজতন্ত্রের প্রতি মানুষের স্বাভাবিক আকর্ষণ আরও বেড়ে যেতে পারে। ফলে কিছু কিছু অধিকার তারা জনগণকে দিত, যাতে নিজেদের আসল চেহারা ঢেকে রাখা গণতন্ত্র নামক আলখাল্লাটার ফুটোগুলো তারা আড়াল করতে পারে। সমাজতান্ত্রিক শিবিরের অনুপস্থিতিতে বুর্জোয়া শাসকদের আর সে ভয় নেই। সাম্রাজ্যবাদী-পুঁজিবাদী শাসকদের ভরসা ছিল বিশ্বায়ন, উদারিকরণের ওপর। যদি এর মাধ্যমে সর্বগ্রাসী সংকট থেকে পুঁজিবাদী ব্যবস্থা একটু রেহাই পায়! কিন্তু এর ফলে এই ব্যবস্থার সামগ্রিক সংকট আরও বেড়েছে। পুঁজি ক্রমাগত বেশি বেশি করে মুষ্টিমেয় একচেটিয়া মালিকের হাতে পুঞ্জীভূত হয়েছে। পুঁজি যত কেন্দ্রীভূত হয়েছে রাষ্ট্র ততই তার গণতান্ত্রিক চরিত্র বেশি বেশি করে হারিয়ে একচেটিয়া পুঁজির লেজুড়ে পরিণত হয়েছে। একচেটিয়া পুঁজির সেবা করাই এখন রাষ্ট্রের একমাত্র কাজ। বুর্জেয়া প্রজাতন্ত্রের প্রজারা নিছক মজুরি-দাস মাত্র। আজ একচেটিয়া পুঁজির শক্তিতে বলীয়ান তাদের সেবাদাস দলগুলির প্রবল দাপটে ক্ষুদ্র-মাঝারি পুঁজি, আঞ্চলিক পুঁজির স্বার্থরক্ষাকারী রাজনৈতিক দলগুলি প্রবল চাপে। তারাও বৃহৎ পুঁজি-মালিকদের প্রসাদের আশায় সব নীতি জলাঞ্জলি দিয়ে নানা আপস করছে। বুর্জোয়া শ্রেণি চায় তাদের সেবাদাস একটি দল নিরঙ্কুশভাবে শাসন চালাক। আর গণতন্ত্রের নাম করে অন্য একটি তাদেরই সেবাদাস দল অথবা একই ধরনের দলগুলির জগাখিচুড়ি জোট বিরোধী হিসাবে থাকুক। শাসক শ্রেণি তার প্রয়োজন অনুযায়ী কখনও এই দলকে, কখনও ওই দলকে গদি পাইয়ে দেবে, এর নামই হল নির্বাচন এবং পবিত্র সংসদীয় গণতন্ত্র! আজ পুঁজিবাদের সংকট এত গভীর যে, পুঁজিবাদের সামগ্রিক স্বার্থের খাতিরেও জনগণের প্রকৃত দাবি শোনার মতো একটু গণতান্ত্রিক পরিসর ছেড়ে রাখতে পুঁজিপতি শ্রেণি নারাজ। ফলে আজকের সংসদীয় ব্যবস্থাটা টিকে আছে এই বুর্জোয়া ব্যবস্থার একটা প্রাণহীন খোলসের মতো। তার গণতান্ত্রিক প্রাণসত্তা প্রতিদিন প্রতি মুহূর্তে চলেছে মৃত্যুর পথে। ফলে, দেশে সাধারণ মানুষের কথা ছেড়েই দিন, সংসদের ভিতরেও গণতান্ত্রিক পরিবেশ অধিষ্ঠান করবে, সাংসদরা কার্যকরী বিতর্ক, আলোচনার মধ্য দিয়ে সরকারি নীতির চুলচেরা বিশ্লেষেণে সক্ষম হবেন– এ বড়ই দুরাশা।
১৯৪৭-এর ১৫ আগস্টের মধ্যরাত্রিতে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী জহরলাল নেহেরু সংসদে তাঁর বিখ্যাত বত্তৃতায়বলেছিলেন, ‘নিয়তির অভিসারে’ এগিয়ে চলেছে ভারতীয় গণতন্ত্র। দেখা যাচ্ছে, নিয়তি নয়, ভারতের সংসদীয় গণতন্ত্র ক্রমাগত এগিয়ে চলেছে সেই পথেই– যা তার জন্য অবধারিত বলে ঘোষণা করেছে মার্ক্সবাদী বিজ্ঞান। এই গণতন্ত্র চলেছে তার অবধারিত বিলোপের দিকে। যথার্থ গণতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থা কায়েম করার মতো তাকত নিয়ে সঠিক নেতৃত্বে কবে শ্রমিক শ্রেণি উঠে দাঁড়াতে পারবে, অপেক্ষা শুধু সেই ক্ষণটির।