তদন্তের দায়িত্ব নেওয়ার পর সুপ্রিম কোর্টে রিপোর্ট দেওয়া পর্যন্ত সিবিআইয়ের আট দিনের তদন্ত আপাতত মূষিক প্রসব করল। অথচ দেশের মানুষ অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছিল এই সিবিআই রিপোর্টের জন্য। তদন্তে পুলিশের পদে পদে গাফিলতি, ঘটনাকে ধামাচাপা দেওয়াই আসল উদ্দেশ্য বলে জনমনে যখন প্রায় নিশ্চিত ধারণা তৈরি হয়েছিল তখন হাইকোর্টের দেওয়া সিবিআই তদন্তের নির্দেশ কিছুটা হলেও আশার সঞ্চার করেছিল। সুপ্রিম কোর্টের স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে এগিয়ে আসা, আর জি করের ঘটনার বিচার পেতে ব্যগ্র মানুষের মনে বাড়তি আগ্রহ তৈরি করেছিল। কিন্তু আট দিন পরে যখন সিবিআই সুপ্রিম কোর্টে রিপোর্ট জমা দিল এবং তাতে তদন্তের অগ্রগতি সম্পর্কে একটি শব্দও উচ্চারণ করা হল না, তা জনমনে হতাশাকে গভীর করে তুলল। আদালত এবং সিবিআইয়ের আচরণ থেকে মনে হবে যেন ব্যাপারটা শুধু তাদের নিজেদের দুই পক্ষেরই, যে লক্ষ লক্ষ জনতা এই ধর্ষণ ও মৃত্যুর যথাযথ তদন্ত ও বিচার চেয়ে বিক্ষোভে ফেটে পড়েছে, রাত জেগেছে, শত-সহস্র মিছিল করেছে গভীর আবেগে, উদ্বেগে উদ্বেলিত হয়েছে, যেন তারা কিছুই নয়, তাদের উদ্বেগ, আগ্রহ, চাওয়ার যেন কোনও মূল্যই নেই। জনগণের এই আবেগকে অগ্রাহ্য করার, অবজ্ঞা করার এমন মনোভাব গণতান্ত্রিক ভাবনার সঙ্গে মেলে কি? দেশের সাধারণ মানুষ অন্তত তা মনে করে না।
সিবিআই রিপোর্টের পরদিন আর জি করের আন্দোলনরত চিকিৎসকরা গিয়েছিলেন তাদের দপ্তরে তদন্তের অগ্রগতি জানতে। জানাতে রাজি হননি সিবিআই অফিসাররা। ফলে চিকিৎসকরা তাঁদের আন্দোলন অব্যাহত রাখার কথা ঘোষণা করেছেন। খুবই স্বাভাবিক তাঁদের এই প্রতিক্রিয়া। হাইকোর্ট যে প্রবল গণআন্দোলনের চাপে পড়েই সিবিআই তদন্তের নির্দেশ দিয়েছিল, এ নিয়ে সন্দেহের কোনও অবকাশ নেই। তাই চিকিৎসকরা সারা দেশের উদ্বিগ্ন জনগণের মনোভাবের প্রতিফলন ঘটিয়ে ঘোষণা করেছেন, আন্দোলনের চাপ যদি না থাকে, কোনও পুলিশ, কোনও সিবিআই, কোনও বিচারালয়– কারও তদন্ত, দোষীদের চিহ্নিত করা এবং শাস্তি দেওয়ার কাজ এক ইঞ্চিও এগোবে না।
মনে রাখা দরকার, পুলিশ, সিবিআই কিংবা বিচারব্যবস্থা সবই এই পুঁজিবাদী ব্যবস্থার অঙ্গ। এই ব্যবস্থা দুর্নীতির যত গভীর পাঁকেই ডুবুক, মহিলাদের উপর অত্যাচার যতই ভয়াবহ আকার নিক, তবুও জনসাধারণ তার বিরুদ্ধে মাথা তুলে দাঁড়াক, সরকারের অপদার্থতা, বেআইনি কার্যকলাপ, দুর্নীতি, অনাচারের বিরুদ্ধে আন্দোলনে উত্তাল হয়ে উঠুক, এই ব্যবস্থার দিকে আঙুল তুলুক– এরা কেউই তা চায় না। যে ভাবে ‘আর জি করের বিচার চাই’ আন্দোলন কলকাতা মহানগরীর সীমানা ছাড়িয়ে রাজ্যের গ্রাম-শহরে দাবানলের মতো ছড়িয়ে পড়েছে, রাজ্যের সীমানা ছাড়িয়ে সারা দেশে এবং দেশের সীমানা ছাড়িয়ে সারা বিশ্বে ছড়িয়ে পড়েছে এবং ক্রমাগত স্বতঃস্ফূর্ত চরিত্র নিয়ে আরও বেশি বেশি করে ছড়িয়ে পড়ছে, তা দেখে আতঙ্কিত হয়ে পড়েছে শাসক শিবির। তাই সেই আন্দোলনকে স্তিমিত করে দিতে, বিক্ষোভের আগুনে জল ঢেলে দিতেই কি এই তদন্ত তদন্ত খেলা, তদন্তের নামে এই দীর্ঘসূত্রতা! তারা জানে এই দুর্নীতি চক্রের শিকড় কেন্দ্র-রাজ্য সহ সব সরকার ও প্রশাসনের রন্ধে্র রন্ধে্র ছড়িয়ে। গোটা ব্যবস্থাটাই দুর্নীতিগ্রস্ত। সঠিক তদন্ত হলে দেখা যাবে এর শিকড় প্রতিটি হাসপাতালের অন্দরে, সরকারের প্রতিটি বিভাগে, এই সরকার ছাড়িয়ে আগের সরকারে ছড়িয়ে রয়েছে। আর দেশের মানুষ যদি শিকড়ের সেই মহাজাল ধরতে পারে, তবে এই বিক্ষোভ শতগুণে ছড়িয়ে পড়বে। মানুষের মধ্যে প্রশ্ন উঠবে, এই সর্বব্যাপক দুর্নীতির জন্ম দেয় যে সমাজব্যবস্থা তার রক্ষক সরকারি দলগুলোর একে অপরের মধ্যে পার্থক্য কোথায়? প্রশ্ন উঠবে, এক দলের বদলে আর এক দলকে সরকারে বসানোর দাবি কি আসলে পচা ক্ষতস্থানে পুলটিস লাগানোর মতো ব্যাপার নয়? এই প্রশ্ন উঠলে উত্তর খুঁজতে গিয়ে মানুষ ধরে ফেলবে দুর্নীতির উৎস এই পচাগলা বুর্জোয়া সমাজব্যবস্থার আসল চেহারাটাকে। তাকে ছুঁড়ে ফেলার আকুতি তৈরি হবে মানুষের মনে।
তাই আজ যদি এই রাষ্ট্রের হাত থেকে ন্যূনতম সুবিচারের দাবি আদায় করতে হয় তবে আন্দোলন প্রবল ভাবে জারি রাখতে হবে শুধু তাই নয়, আন্দোলনকে আরও তীব্র করতে হবে। এবং সেই আন্দোলনকে স্বতঃস্ফূর্ততার জায়গায় ফেলে রাখলে চলবে না। তাকে সংগঠিত রূপ দিতে হবে, আন্দোলনের মধ্যে সমাজ বদলের লক্ষ্যকে অন্তর্ভুক্ত করতে হবে। না হলে প্রবল আন্দোলনের চাপে একটা ধর্ষণ-খুনের বিচার আদায় হলেও ঠিক একই সময়ে আরও বিশটা এমন ঘটনা ঘটে যাবে, ঘটতে থাকবে।
অত্যন্ত আশার কথা, সাধারণ মানুষ, বিশেষত মহিলারা এই আন্দোলনে যে ভাবে অংশগ্রহণ করছেন, শিল্পী-সাহিত্যিক-বুদ্ধিজীবী, অভিনেতা-অভিনেত্রী, আইনজীবী প্রভৃতি সকল ক্ষেত্রের মানুষ যে ভাবে অংশ নিয়েছেন, যে ভাবে তা স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রছাত্রী-শিক্ষক-অধ্যাপকদের মধ্যে ছড়িয়ে পড়েছে, তা যেমন গণআন্দোলনের ইতিহাসে নতুন নজির তৈরি করল, তেমনই তা প্রমাণ করল, রাজ্যে পর পর ক্ষমতাসীন শাসকরা বাংলার সংগ্রামী প্রাণসত্তাকে আজও সম্পূর্ণ ধ্বংস করতে পারেনি। আশার কথা, তাঁরা সকলেই সুবিচারের দাবিতে অনড়, আন্দোলন চালিয়ে যেতে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ। তাই শাসকদের কোনও ছল, কোনও চাতুরিই যে এই আন্দোলনকে দমন করতে, বিপথগামী করতে পারবে না, তা জোর দিয়েই বলা যায়।