স্বাস্থ্যদপ্তর বলছে, ওষুধ সরবরাহকারী সংস্থাগুলির কাছে বিপুল অর্থ বাকি পড়ে যাচ্ছে৷ বিশেষ করে ক্যান্সার, ডায়াবেটিসের মতো রোগের দামি ওষুধের সরবরাহ ব্যাহত হচ্ছে৷ তার জন্য নাকি দায়ী ‘ফ্রি চিকিৎসা’ নীতি, যাতে লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়ছে রোগীর সংখ্যা৷ তার জন্য স্বাস্থ্যদপ্তর ‘তামিলনাড়ু মডেল’ তুলে ধরছে৷
তামিলনাড়ুর প্রকল্পটি কী? এতে সরকারি হাসপাতালে ওষুধের তালিকায় দু’ভাগ থাকবে– জরুরি ও বিশেষ৷ হাসপাতালের স্তর অনুযায়ী তা সরবরাহ করা হবে৷ বহু ওষুধ ও অস্ত্রোপচারের সামগ্রী ছাঁটাই করা হবে৷
প্রশ্ন উঠেছে, সরকার কি ফ্রি তে চিকিৎসা পরিষেবা দিতে চায় না? তাহলে এই ঘোষণা কি শুধুই লোক ঠকানোর উদ্দেশ্যে? নাহলে ২০১২ সালে বিনামূল্যে চিকিৎসা পরিষেবার ঘোষণা করে, যা মেডিকেল কলেজগুলিতে চালু হয়েছে ২০১৫ সালে৷ ২০১৭ সালে তাতে ইতিই বা টানা হচ্ছে কেন?
সরকার এ ক্ষেত্রে অর্থসংকটের দোহাই দিচ্ছে৷ সত্যিই কি সরকারের অর্থের অভাব? অর্থ সাশ্রয়ের চেষ্টা কি সরকারের কাজকর্মে কোথাও দেখা যাচ্ছে? সরকারি কোষাগার ফাঁকা করে মেলা–খেলা–কার্নিভালে তো সরকারের টাকার কোনও অভাব কখনওই ঘটছে না সাধারণ মানুষ প্রশ্ন তুলছে, সারা বছর ধরে মানুষকে উৎসবে মাতিয়ে রাখার দায়িত্ব তো সরকারকে কেউ দেয়নি৷ মুখ্যমন্ত্রীর এক দিনের জেলা সফরে প্রায় দু’কোটি টাকা খরচ হচ্ছে, সুদৃশ্য অত্যাধুনিক মঞ্চ করে একটা জেলায় মিটিং করতে কোটি টাকার বেশি খরচ হচ্ছে, সেই অর্থ গরিব মানুষের ওষুধ ও চিকিৎসার জন্য ব্যয় করলে কি ভাল হত না?
সরকারের বক্তব্য, ‘অনেক জায়গায় ওষুধের, বিশেষ করে দামি ওষুধের অপব্যবহার হচ্ছে৷ পর্যাপ্ত ওষুধ থাকা সত্ত্বেও ভাঁড়ার খালি দেখিয়ে নতুন করে ওষুধ চাওয়া হচ্ছে৷ এ ভাবে তো অনন্তকাল চলতে পারে না৷’ কী অদ্ভুত বক্তব্য এ সব তো সরকার তথা প্রশাসনের ব্যর্থতা৷ এই ব্যর্থতার দায়ে জনগণের চিকিৎসা বন্ধ হবে কেন? সরকার অবিলম্বে এই সব ক্ষেত্রে নজরদারি বাড়াক, দুর্নীতি বন্ধ করুক৷ এ তো মাথাব্যথার দায়ে মাথাই উড়িয়ে দেওয়া৷ তা ছাড়া ড্রাগনীতি বদলানোর জন্য যে বিশেষজ্ঞ কমিটি করা হয়েছে, তাতে রয়েছেন শুধু কয়েকজন আমলা এবং সরকারের ‘কাছের লোক’৷ এমন হবে কেন? এটা তো শুধু প্রশাসনিক সিদ্ধান্ত নয়, বরং রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত৷ নাকি আমলা ও কিছু স্বাস্থ্যকর্তাকে সামনে রেখে মুখ্যমন্ত্রী জনগণের ক্ষোভের আঁচ এড়াতে চান? বরং এ ক্ষেত্রে সরকারের উচিত ছিল, রাজ্যের নানা সক্রিয় রাজনৈতিক দল, নানা চিকিৎসক সংগঠন– সকলকে ডেকে তাদের মতামত নিয়ে এর সমাধানে উদ্যোগী হওয়া৷
এমনিতেই সরকারি হাসপাতালে বিনামূল্যে চিকিৎসা পাওয়ার আশায় দীর্ঘ লাইনে দাঁড়িয়ে ঘন্টার পর ঘন্টা অসহনীয় অবস্থায় অপেক্ষা করতে হয় রোগী ও তাঁর পরিজনদের৷ এক বিভাগ থেকে আর এক বিভাগে টিকিট করানো, নানা পরীক্ষা, শেষে ডাক্তার দেখানোর সুযোগ মেলে৷ তারপরে বিনামূল্যে ওষুধ নেওয়ার লাইনে দাঁড়াতে হয় আরও কয়েক ঘন্টা৷ এত কিছুর পরেও মেলে না সব ওষুধ৷ অপারেশনের ডেট পেতে মাসের পর মাস অপেক্ষা করতে হয় এমনকী মরণাপন্ন রোগীকেও৷ এ সবের পরেও দরিদ্র মানুষ নিরুপায় হয়ে ছোটেন সরকারি হাসপাতালেই৷ বেসরকারি হাসপাতালে চিকিৎসা করার অর্থের জোর নেই তাঁদের৷ এর উপর সরকারের নয়া চিকিৎসা নীতিতে এঁরা পড়েছেন আরও সমস্যায়৷
ফলে নামমাত্র কিছু ওষুধ বিনামূল্যে দেওয়ার কথা বলা হলেও বাস্তবে চিকিৎসা থেকে বঞ্চিত হবে সাধারণ মানুষ৷ ফ্রি চিকিৎসার সামান্য হলেও যতটুকু সুযোগ ছিল, তার অকালমৃত্যু ঘটবে৷ বেসরকারি হাসপাতাল ও নার্সিংহোম থেকে চড়াদামে চিকিৎসা পরিষেবা কিনতে পারবেন শুধুমাত্র সমাজের উচ্চবিত্ত মানুষ৷ সরকারের এই দৃষ্টিভঙ্গিতে গরিব–মধ্যবিত্তরা চিকিৎসা পরিষেবা থেকে দূরে সরে যেতে বাধ্য হবে, অন্যদিকে মুনাফালোভী স্বাস্থ্যব্যবসায়ীরা এই সুযোগে অসহায় রোগীদের নিংড়ে ব্যবসা ফুলিয়ে–ফাঁপিয়ে নেবে৷ আর গরিবকে চিকিৎসা পরিষেবা দেওয়ার নামে সরকারের ‘বিনামূল্যে চিকিৎসা’ কর্মসূচি শুধুমাত্র প্রচারের অলঙ্কারই থেকে যাবে৷