১২ মে টেলিভিশনের পর্দায় প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী তাঁর পরিচিত নাটকীয় ভঙ্গিতে গোটা দেশকে জানালেন, করোনা মহামারিতে দুর্দশাগ্রস্ত জনগণের জন্য তিনি কুড়ি লক্ষ কোটি টাকার বিপুল আর্থিক প্যাকেজের বন্দোবস্ত করেছেন৷ এর মধ্য দিয়ে নাকি তাঁর সরকার দেশকে আত্মনির্ভর করে তুলতে চাইছে৷ দেশের মোট আভ্যন্তরীণ উৎপাদন বা জিডিপি–র দশ শতাংশ হবে এই প্যাকেজ৷ তাতে কী কী থাকছে, কোথায় কত টাকা বরাদ্দ হবে– সে সব অর্থমন্ত্রী সীতারমন–ই ঘোষণা করবেন৷ তারপর, টানা পাঁচ দিন অর্থমন্ত্রী সাংবাদিক বৈঠক করে জানালেন, তাদের ত্রাণ প্যাকেজে কোথায় কত কী থাকছে৷ দেশের মানুষ আশা–ভরসায় বুক বাঁধছিল, জিডিপি–র দশ শতাংশ যদি বাজারের চাহিদা বাড়াতে খরচ করা হয় তবে এই করোনা কবলিত মহা সঙ্কটের আবর্ত থেকে দেশকে টেনে তুলতে এই প্যাকেজকে এক কথায় বলা যায় একটি ইতিবাচক প্রয়াস৷ আবার বিজেপি সরকারের ধোঁকা দেওয়ার পারদর্শিতা সম্বন্ধে অভিজ্ঞ বহু সাধারণ মানুষ সন্দেহ করেছিলেন, ‘ডাল মে কুছ কালা হ্যায়’৷ হলও ঠিক তাই৷ দেখা গেল, প্রায় সবই জুমলা, সবই প্রায় ভাঁওতা৷
এই অতিমারি সঙ্কটে সকলেই যখন বাঁচার কার্যকরী পথ খুঁজছে, একমাত্র কেন্দ্রীয় সরকার ও ‘হাত পা ভেঙে দেওয়া ঠুঁটো’ রিজার্ভ ব্যাঙ্ক ছাড়া আর প্রায় সকলেই একমত– মানুষের হাতে এখন নগদ টাকা তুলে দেওয়াটাই একমাত্র পথ৷ প্রথম সারির আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন অর্থনীতিবিদরা সকলেই মানুষের ক্রয়ক্ষমতা বাড়াতে সোজা–সাপটা নগদের ব্যবস্থার কথা বলেছেন৷
করোনা ভাইরাসের গায়ে যেমন অনেক কাঁটা বা স্পাইক, এই ‘ঐতিহাসিক’ কুড়ি লক্ষ কোটি টাকার প্যাকেজও কুৎসিত মিথ্যাচার, প্রতারণা, সংখ্যাতত্ত্বের চোখ ধাঁধানো কৌশল ইত্যাদি বহুমুখী স্পাইক সমৃদ্ধ৷ কী বলে একে ব্যাখ্যা করা যায়? ফিসক্যাল (রাজস্ব সংক্রান্ত) প্যাকেজ? ত্রাণ প্রকল্প? সহজ–ঋণ প্যাকেজ? না সংস্কারের কার্যক্রম? কোনটা?
কুড়ি লক্ষ কোটি টাকার রূপকথার সংখ্যাটি কোনও মতেই দাঁড়াচ্ছে না৷ কোনও হিসাবেই অঙ্ক মেলানো যাচ্ছে না৷ লক্ষ করলে স্পষ্টতই দেখা যাবে, কেন্দ্রীয় সরকারের কোষাগার থেকে নেহাতই দুই লক্ষ কোটির মতো টাকা খরচ হতে পারে৷ খাতায় কলমে দেখানো হয়েছে খরচ জিডিপি–র দশ শতাংশ৷ কিন্তু বাস্তবে সরকারের ঘর থেকে যে টাকাটা খরচ হবে তা জিডিপি–র এক শতাংশের মতো, কমতেও পারে আরও৷ এ সব নিয়ে সরাসরি সাংবাদিকরা প্রশ্নও তুলেছিলেন, অর্থমন্ত্রী নীরব থাকা অথবা প্রশ্ন এড়িয়ে যাওয়াটাই শ্রেয় মনে করেছেন৷
কী সেই প্যাকেজ?
প্যাকেজ ঘোষণার মধ্য দিয়ে যে স্টিমুলাস বা প্রণোদনার কথা এখানে বলা হচ্ছে তার মানেটা ঠিকঠাক বুঝে নেওয়া বড় মুশকিল৷ কিছু মাস আগে অর্থমন্ত্রী লগ্নীকারীদের দেড় লক্ষ কোটি টাকা স্টিমুলাস বা প্রণোদনা দিয়েছিলেন, এ বিষয়টা বুঝতে অসুবিধা হয় না৷ অর্থাৎ লগ্নিকারীদের দেড় লক্ষ কোটি টাকা কর মকুব করে তাদের সরাসরি খুশি করতে বা প্রণোদনা দিতে পেরেছিলেন৷ সেসব বুঝতে কোনও অসুবিধে হয় না৷ কিন্তু বর্তমান প্যাকেজটির মধ্য দিয়ে সাধারণ মানুষের আর্থিক পরিস্থিতিকে চাঙ্গা করার বিষয়টি আসলে কী, সেটাই পরিষ্কার হচ্ছে না৷ ধরে নেওয়া যাক, সরকারের উদ্দেশ্য সারা দেশ জুড়ে নানা অর্থনৈতিক ক্রিয়াকাণ্ড বাড়ানো এবং তার ফলে বাজারে চাহিদা ও কর্মসংস্থান ইত্যাদি বাড়ানো হবে৷ তার প্রভাব জিডিপি–র উপর পড়বে এবং তার হারও বাড়বে৷
‘গ্রস ডোমেস্টিক প্রোডাক্ট’ বা জিডিপি হল দেশের মোট অভ্যন্তরীণ উৎপাদন৷ অর্থাৎ মানুষ ভোগ বাবদ যা ব্যয় করেন, উদ্যোগপতি ও ব্যবসায়ীরা যত টাকা মোট লগ্নি করেন, সরকার মোট যা খরচ করে এবং আমদানি ক্ষেত্রে খরচের তুলনায় রপ্তানি ক্ষেত্র থেকে পাওয়া টাকার মোট পরিমাণ যতটা বেশি হবে সব কটি পরিসংখ্যান যোগ করলে মোট জিডিপি–র পরিমাণ পাওয়া যাবে৷ সেন্ট্রাল স্ট্যাটিস্টিক্যাল অফিস অর্থাৎ সিএসও থেকে হিসেবটা চাইলেই জানা যায়৷ নিখুঁত হিসেব পাওয়া মুশকিল, সময় লাগে৷ কারণ প্রাকৃতিক দুর্যোগ, মরশুমি ওঠা–পড়া, বছরে কিছু সময়ে রাজনৈতিক ওঠা–পড়া ইত্যাদি রয়েছে৷ তবু একটা সুনির্দিষ্ট হিসেব করা যায়৷ এই জিডিপি–র ক্ষেত্রগুলি ধরে, অথবা কোনও একটি ক্ষেত্রে সরকারি ঘোষিত প্যাকেজ যতক্ষণ পর্যন্ত আর্থিক সুবিধা দিতে না পারছে, সেই প্যাকেজে স্টিমুলাস বা প্রণোদনা বলে নির্দিষ্টভাবে কিছু পাওয়া যাবে না৷
স্টিমুলাস বলতে প্রধানমন্ত্রী ও অর্থমন্ত্রী উভয় মিলে যা বরাদ্দ প্রথমে ঘোষণা করেছিলেন, তা পরে গিয়ে দাঁড়ালো মাত্র দু লক্ষ কোটি টাকা, ঘোষিত প্যাকেজের দশ ভাগের এক ভাগ৷ কেন এমন হল? এটা কি ভুল করে? আসলে টাকার অঙ্ককে বাড়িয়ে দেখানোর ঝোঁকে সরকার বাহাদুর ফিসক্যাল অর্থাৎ রাজস্ব ক্ষেত্র আর মানিটরি অর্থাৎ আর্থিক ক্ষেত্রকে জুড়ে এক করে ফেলেছে৷ দুটো শব্দ আলাদা, অর্থও আলাদা, দুটো ক্ষেত্রেও আলাদা৷ অর্থশাস্ত্রে ফিসক্যাল ও মানিটরি ক্ষেত্রকে এক করা চলে না৷ এই দুটিকে দক্ষতার সঙ্গে খিচুড়ি পাকাতে অর্থনীতির স্কুলে পড়তে হয় না, মোদী–শাহর ‘জুমলা’–র পাঠশালাতে তালিম নিতে হয়৷
রাজস্ব নীতি (ফিসক্যাল পলিসি) আর আর্থিক নীতি (মানিটরি পলিসি)–র পার্থক্যটা একটু ভেঙে বুঝে নেওয়া দরকার৷ ধরা যাক সরকার পরিকল্পনা করল পাঁচশো করে টাকা খরচ করা হবে৷ সত্যই তা যদি করা হয় দেখা যাবে এই দুটি ক্ষেত্রে টাকার চলমানতা পুরোপুরি ভিন্ন পথে কাজ করবে৷ রাজস্ব নীতিতে তা সরাসরি খরচ হবে সরকারি কোষাগার থেকে, যাবে মানুষের হাতে৷ আর্থিক নীতিতে তা ঋণের মাধ্যমে লগ্নির আকারে ঘুরপথে বাজারে পৌঁছাবে৷ এই নীতি দুটিকে, ক্ষেত্রদুটিকে এক করে ফেললে সেটা জাম আর জামরুলের মধ্যে গুলিয়ে ফেলা হবে৷
রিজার্ভ ব্যাঙ্ক অনেকগুলো সংস্কার বা ব্যবস্থা গ্রহণ করেছে৷ বর্তমান পরিস্থিতিতে রেপো রেট (রিজার্ভ ব্যাঙ্ক যে সুদের হারে ব্যাঙ্কগুলিকে ধার দেয়) এবং রিভার্স রেপো রেট (রিজার্ভ ব্যাঙ্কে টাকা রেখে ব্যাঙ্ক যে সুদ পায়) ক্রমাগত কমানো হয়েছে৷ হার দুটির হিসেব দাঁড়িয়েছে যথাক্রমে চার ও সাড়ে তিন শতাংশ৷ ভারতবর্ষের ইতিহাসে সুদের হার উভয় ক্ষেত্রে কোনও দিন এতটা কমে যায়নি৷ খুব সহজ হিসেবেই দেখা যাচ্ছে সুদের হার কার্যত মূল্যবৃদ্ধির হারের চেয়েও কম হয়ে যাচ্ছে৷ এর ফলে সঞ্চয় অলাভজনক হয়ে পড়ছে৷ দেশের অর্থনীতির এ এক অভূতপূর্ব পরিস্থিতি৷ সব কিছু মিলিয়ে মানুষ ভাবিত এবং দিশেহারা৷ কেন্দ্রীয় অর্থমন্ত্রক ও রিজার্ভ ব্যাঙ্ক উভয়ের উর্ধ্বতন মহল তথা পরিচালকমণ্ডলী মনে করে সহজলভ্য ঋণের ব্যবস্থা হলেই অর্থনীতির চাকা ঘুরবে৷ অর্থমন্ত্রী তাই ঋণের সহজলভ্য হিসেবের ফিরিস্তিতে তার ত্রাণ প্যাকেজ ভরিয়ে দিয়েছেন– এই বিশ্বাসে যে কম সুদে বা সস্তায় ঋণ পেলে লোকজন তা দিয়ে ভোগ্যপণ্য কিনতে রাস্তায় নেমে পড়বেন৷ অর্থাৎ ভোগ ব্যয় বাড়বে, বাজার গরম হবে৷ বাজারের চাহিদা বাড়বে৷ তখন ব্যবসায়ীরা হাত গুটিয়ে বসে থাকতে পারবে না৷ বাজার চাহিদার অভিঘাতে ব্যবসায়ী–উদ্যোগপতি সস্তায় সরকারের ওই একই প্যাকেজ থেকে ঋণ নিয়ে শিল্পের ‘মরা গাঙে বান’ আনবে৷ কিন্তু বাস্তব যুক্তি–বুদ্ধি বলে, দারিদ্রসীমার নিচে থাকা বিরানব্বই কোটি নিরন্ন, কাজ হারানো অসহায় সম্বলহীন মানুষ একটা খড়কুটাকে আঁকড়ে ধরে বাঁচতে চাইছেন৷ তাঁরা ঋণ পাবেনই বা কী করে? আর পেলেও তা নিয়ে কী করবেন? তাঁদের দরকার এখন খাদ্য, দরকার নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিস কেনার মতো কিছু অর্থ৷ তাছাড়া নানা ধরনের নথিপত্র, সার্টিফিকেট ইত্যাদি নিয়ে গিয়ে ঋণ করতে হয়, তাঁদের কাগজপত্র কোথায় যে ব্যাঙ্ক থেকে ধার পাবেন? শোধ করবার ক্ষমতা নেই বলে ব্যাঙ্ক তাদের টাকা দেবেও না৷ আর খামোখা ধার করতে যাবেনই বা কেন তাঁরা? সব হারিয়ে নতুন করে বাঁচবার জন্য চাই নগদ টাকা, ঋণ নয় অথবা কাগজ, সার্টিফিকেটও নয়, ঋণের প্যাকেজও নয়৷
ফলে ঘোষিত আর্থিক নীতির মাধ্যমে ধরা যাক কেউ পাঁচশো টাকা ঋণ–প্রণোদনা পেলেন৷ সেই টাকা ব্যাঙ্কের অ্যাকাউন্টেই থেকে যাওয়ার সম্ভাবনা বেশি৷ অর্থনীতিতে, লগ্নি বা উৎপাদনে এর কোনও প্রভাব নাও পড়তে পারে৷ যতক্ষণ না কেউ ধার করে (ব্যাঙ্ক থেকে) নিজের ভোগ ব্যয় বা লগ্নির পরিমাণ বাড়াচ্ছেন, ততক্ষণ পর্যন্ত এই স্টিমুলাস প্যাকেজে অর্থনীতির চাকা ঘুরবে না৷ ভোগব্যয় বা বিনিয়োগের ক্ষেত্রে বাস্তব পরিস্থিতি হল, অনিশ্চয়তা মানুষকে উল্টোপথে ঠেলবে৷ মানুষ ভোগব্যয় কমিয়ে দুর্দিনের জন্য যতটুকু বাঁচাতে পারে টাকা–পয়সা হাতে রেখে দেবে, আর লগ্নিকারীরা ব্যাঙ্ক থেকে ধার না করে বাজারের অবস্থা বুঝে বিনিয়োগের পরিমাণ কমিয়ে লোকসান ঠেকাবার আপ্রাণ চেষ্টা চালাবে৷ বাজারের পরিস্থিতিটাই এমন জায়গায় এসে পৌঁছেছে৷ অর্থমন্ত্রী কী এভাবে ভাবছেন, সুদের হার কম বা সস্তা বলে মানুষ ঋণ নিয়ে প্যাকেজ প্রণোদনে পাগল হয়ে গিয়ে গাড়ি–বাড়ি বা টিভি–ওয়াশিং মেশিন–এসি ইত্যাদি নতুন নতুন জিনিসপত্র কিনতে থাকবেন– এ সব এখন বিনিয়োগকারীরাও বিশ্বাস করেন না৷ বিনিয়োগকারীরা বাজারের হাল–হকিকত ভালোই বোঝেন৷ এর জন্য শিকাগো সুক্লে তাদের পাঠ নিতে হয়নি৷
বেশি দিনের কথা নয়, ২০ সেপ্ঢেম্বর ২০১৯, বিনিয়োগকারীদের কর ছাড় দিয়ে অর্থমন্ত্রী ১.৪৫ লক্ষ কোটি টাকার স্টিমুলাস দিয়েছিলেন৷ লগ্নিকারীদের দাবি ছিল এক লক্ষ কোটি টাকা৷ তাদের দাবি ছাপিয়ে আরও পঁয়তাল্লিশ লক্ষ কোটি টাকা বেশিই দিল বিজেপি সরকার৷ মজার ব্যাপার হল বিনিয়োগকারীরা কর ছাড়ের টাকাটা পুরোপুরি চেটেপুটে খেয়ে নিল, কিন্তু চেষ্টা করেও তাদের তেমনভাবে গেলানো গেল না লগ্নি বাড়ানোর বিষয়টি৷
ফিসক্যাল বা রাজস্ব প্যাকেজ কাজ করে অনেকটা সোজাসুজি৷ যে খাতে টাকা ধার্য, সেই খাতেই লোকজন টাকাটা সরাসরি হাতে পাবে৷ ধরে নেওয়া যাক সরকার পাঁচশো টাকা খরচ করল পিএম কিষাণ বা মনরেগা প্রকল্পে৷ কৃষকদের হাতে টাকাটা সরাসরি গেল, বাড়তি আয় হিসেবে তাঁদের হাতে টাকাটা এল৷ এই টাকাটা অন্য কোনও বরাদ্দ থেকে তাঁদের হাতে কখনও আসেনি৷এখন তাঁরা সেই পাঁচশো টাকার একটা অংশ তিনশো টাকা ভবিষ্যতে দুর্দিনের কথা ভেবে জমা রেখে বাদবাকি অংশ অর্থাৎ দুশো টাকা ভোগব্যয় বাবদ খরচ করলেন৷ এই খরচের টাকায় আবার যেসব ভোগ্যপণ্যের উৎপাদকদের আয় বাড়ল, তারাও সেই আয়ের অতিরিক্ত একটা অংশ খরচ করলেন ভোগব্যয়ে৷ ফিসক্যাল প্যাকেজ এভাবে কিছুটা হলেও অর্থনীতির চাকা ঘোরাতে পারে– একেই অর্থশাস্ত্রে বলা হয় ‘মাল্টিপ্লায়ার এফেক্ট’৷ অর্থাৎ প্রাথমিকভাবে যে দুশো টাকা খরচ করা হয়েছিল, সেই টাকায় মোট অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড বাড়ে তার চেয়ে বেশ কিছুটা বেশি৷ এ কথা তত্ত্বাকারে এসেছিল ‘জন কেইনস্ মাল্টিপ্লায়ার’ নাম নিয়ে৷ এসব এখন অতীত, ইতিহাসের পাঠ্যবস্তু৷ উদারনীতি বা বিশ্বায়নের স্টিমরোলার ও সুপার প্রফিটের পথে চলা বেপরোয়া পুঁজিবাদ দুনিয়ার সাবেকি অর্থশাস্ত্রের তাত্ত্বিক কাঠামোটাই অনেকটা বদলে দিয়েছে৷
আগের বরাদ্দই নতুন করে দেখানো হল
গুরুত্বপূর্ণ একটি বিষয় উল্লেখ করা প্রয়োজন৷ ফিসক্যাল বা রাজস্ব প্যাকেজে সরকার পাঁচশো টাকা খরচ করলে টাকাটা সরাসরি মানুষের হাতে আসে৷ কিন্তু দেখা যাচ্ছে সরকারি এইসব প্যাকেজে ‘ইধার কা মাল উধার’ করে দিয়ে এই পাঁচশো টাকার প্রণোদনা একশো দিনের কাজের প্রকল্পের থেকে সরিয়ে পিএম কিষাণ খাতে দিলে অর্থনীতির হিসেবের খাতে কোনও ফারাক হবে না৷ প্রশ্নটা হল পাঁচশো টাকাটা বরাদ্দ ছিল আগের বাজেটের একশো দিনের প্রকল্পে৷ কিন্তু কী করে ওই টাকাটা নতুনভাবে অন্য প্রকল্পের নামে খরচ হয়ে গেল? এই আর্থিক কারচুপির মধ্য দিয়ে পুরনো প্রকল্পের প্যাকেজের টাকা রিপ্যাকেজিং হয়ে নতুন প্রকল্পে খরচ করা হচ্ছে৷ এই ধরনের কারচুপি বিজেপি সরকারের সংস্কৃতির সাথে অঙ্গাঙ্গিভাবে যুক্ত৷
অর্থমন্ত্রীর ঘোষিত কুড়ি লক্ষ কোটি টাকার প্যাকেজকে ভেঙে বিচার করে দেখা যাক৷ এর মধ্যে তিন লক্ষ কোটি টাকা ফিসক্যাল স্টিমুলাস, বাকিটা মানিটরি স্টিমুলাস৷ এই তিন লক্ষ কোটি টাকা ফিসক্যাল স্টিমুলাসের মধ্যে বেশ বড় অঙ্ক আগের বাজেটেই বরাদ্দ ছিল৷ আগের বাজেটের বরাদ্দকে নতুন খরচ বলে খরচ করা কারচুপি ছাড়া কিছু নয়৷ বাস্তবে সরকারের ঘোষিত প্যাকেজ জিডিপি–র দশ শতাংশ দূরের কথা এই কারচুপির মধ্য দিয়ে তা এক শতাংশ, কি তার থেকেও নিচে নেমে এসেছে৷ এই হল বিজেপি রাজনীতির মিথ্যাচার আর জুমলা সংস্কৃতির কুৎসিত মুখ৷
ভয়াবহ আর্থিক সঙ্কটের মোকাবিলায় কেন্দ্রের বিজেপি সরকারের ‘কুড়ি লক্ষ কোটি’ টাকার প্যাকেজ আসলে একটি নকল অর্থনৈতিক প্যাকেজ৷ মোদি সরকার পরিষ্কার বুঝিয়ে দিয়েছে তাদের কাছে দেশের নিম্নবিত্ত, গরিব খেটে খাওয়া মানুষের স্বার্থের চেয়ে আন্তর্জাতিক রেটিং–এর গুরুত্ব অনেক বেশি৷ রেটিং সংস্থাগুলি রাজকোষ ঘাটতি বা বাজেট ঘাটতি একেবারেই পছন্দ করে না৷ করোনা পরিস্থিতিতে ভারতের অর্থনীতির হাল যে ক্রমেই খারাপ হচ্ছে, সে সতর্কবার্তা আগেই জানিয়ে দিয়েছে মুডিজ, গোল্ডম্যান স্যাক্সের মতো আন্তর্জাতিক রেটিং সংস্থাগুলো৷ আগামী অর্থবর্ষে সম্ভাব্য আর্থিক বৃদ্ধির হার শূন্যে নেমে যাওয়ার পূর্বাভাসও মিলেছে৷ কিন্তু গত এক মাসে পরিস্থিতি যে আরও কত গুণ খারাপ হয়েছে তা পরিষ্কারভাবে বুঝিয়ে দিল ‘সেন্টার ফর মনিটরিং ইন্ডিয়ান ইকনমি’ বা সংক্ষেপে সিএমআইই–এর রিপোর্ট৷
সেন্টার ফর মনিটরিং ইন্ডিয়ান ইকনমি (সিএমআইই)–এর পরিসংখ্যান বলছে এই এক মাসে দেশে কাজ হারানো মানুষের সংখ্যাটা বারো কোটি কুড়ি লক্ষ, সংখ্যাটা আরো বাড়বে বই কমবে না৷ এই সমীক্ষা চমকে ওঠার মতোই৷ গত এপ্রিলে তারা দেশে সাতাশটি রাজ্যে সমীক্ষা চালিয়েছে৷ তাতে দেখা গেছে লকডাউনের জেরে সবচেয়ে বেশি ধাক্কা খেয়েছে গ্রামীণ অর্থনীতি৷ সেখানে আশি শতাংশ মানুষ কাজ হারিয়েছেন৷ যাঁরা কাজ হারিয়েছেন, তাঁদের অধিকাংশ দিনমজুর, ছোট ব্যবসার সাথে যুক্ত লোকজন, ফুটপাতের, ট্রেনের হকার, নির্মাণকর্মী, রিক্সা ও ভ্যানচালক৷ ডেভেলপমেন্ট কনসালটেন্সি ‘আইপিই গ্লোবাল’–এর ম্যানেজিং ডিরেক্টরের কথায় ‘পরিস্থিতি এমনই, যত মানুষ ভাইরাসে মরবে, তার চেয়ে বেশি মানুষ না খেতে পেয়ে মরবে৷’ কারণ হিসেবে ‘ইউনাইটেড নেশন ইউনিভার্সিটি’–র একটি সমীক্ষা তিনি তুলে ধরেন৷ সেই সমীক্ষা বলছে, বিশ্ব ব্যাঙ্ক নির্ধারিত দারিদ্রসীমার সংজ্ঞা (দৈনিক প্রায় দুশো তেতাল্লিশ টাকায় জীবনধারণ) অনুযায়ী ভারতের ৬০ শতাংশ (প্রায় ৮১ কোটি ২০ লক্ষ) মানুষ তখন দারিদ্রসীমার নিচে বাস করতেন৷ লকডাউনে কাজ হারিয়ে সেই সংখ্যাটি পৌঁছে যেতে পারে ৬৮ শতাংশে (প্রায় ৯২ কোটি মানুষ)৷ অর্থাৎ করোনা লড়াইয়ে সামিল ভারতে ভীষণভাবে বিপন্ন জীবন ও জীবিকা৷
কোভিড ১৯–এর ফলে গোটা দেশের অধিকাংশ মানুষ, বিপুল সংখ্যক পরিযায়ী শ্রমিক অন্তহীন সমস্যায় সম্পূর্ণ বিপর্যস্ত ও দিশেহারা৷ সেই সুযোগে মোদির বিজেপি সরকার ’৯০ সালের সংস্কারের পর দ্বিতীয়বার বিরাটাকার সংস্কার কর্মসূচিতে ঝাঁপিয়ে পড়েছে৷ একটা সরকার কত দূর হৃদয়হীন হলে পরিস্থিতির সুযোগ নিয়ে দেশি–বিদেশি কর্পোরেটদের কাছে সীমাহীন শোষণের রাস্তাকে উন্মুক্ত করে দিতে পারে একটার পর একটা দুর্ঘটনা, মালগাড়ি চাপা পড়ে, মাইলের পর মাইল হেঁটে বাড়ি ফেরা, ক্ষুধা–তৃষ্ণা ও ক্লান্তিতে অসহায় পরিযায়ী শ্রমিকদের মর্মান্তিক মৃত্যুতে দেশের মানুষ যখন ভীষণভাবে শোকাহত, বিজেপি পরিচালিত কেন্দ্রীয় সরকার ঠিক সেই সময়টাকেই বেছে নিল প্রতিরক্ষা, কয়লা, বিদ্যুৎ ক্ষেত্রকে কর্পোরেটদের হাতে তুলে দিতে৷ তাদের বিপুল মুনাফালুটের সুযোগ করে দেওয়া হল৷ একইভাবে এই সরকার কৃষক ও সাধারণ ক্রেতাদের শোষণ করার জন্য কৃষিপণ্যের বাজারটাকেও কর্পোরেট ও বৃহৎ ব্যবসায়ীদের হাতে তুলে দিয়েছে৷ রাজ্যে রাজ্যে শ্রম আইন শিথিল করার তাড়া পড়ে গেছে৷ কিছু কিছু রাজ্যে কর্মদিবসের মেয়াদ বাড়িয়ে ৮ ঘন্টার জায়গায় ১২ ঘন্টা করতে চাইছে৷ এভাবে বেয়াড়া শ্রমিকদের আচ্ছা করে জব্দ করতে পারলেই যেন এসে যাবে ‘আচ্ছে দিন’
এক্ষেত্রে দুটি কথা মনে রাখতে হবে৷ এক, দুনিয়া জুড়ে যখন মহামন্দা, মৃত্যুর মিছিল, তখন শ্রমিকদের অধিকার কেড়ে নিলেও দেশে বিনিয়োগ বাড়ার আশা নেই বললেই চলে৷ কেবল শ্রমিকদের লাগামহীন শোষণ করলে বিনিয়োগ বাড়ে– এ ধরনের তত্ত্ব ভিত্তিহীন শুধু নয়, পাগলামিও৷ দ্বিতীয়, শ্রমিকরা পশু কিংবা যন্ত্র নয়৷ তাঁরা রক্ত মাংসে মানুষ, চেতনায় মানুষ৷ একের পর এক শ্রম আইন বাতিল করে, অধিকার কেড়ে নিয়ে পুঁজিপতিদের যথেচ্ছাচার, লাগামহীন শোষণ, শ্রমজীবী মানুষের চেতনায় শুধু অসন্তোষ আর ক্রোধ নয়, আজ অথবা কাল একদিন হূদয়হীন নৃশংস এই পুঁজিবাদের বিরুদ্ধে মানুষের চেতনা বিপ্লবের মন্ত্রে দীক্ষিত হবেই৷ বিপ্লবই একদিন সভ্যতার জঘন্য শত্রু পুঁজিবাদের অবসান ঘটাবে, আনবে শোষণমুক্ত নতুন সমাজ৷