আবারও এক কেলেঙ্কারিতে মোদি সরকার৷ এবার সাপের ছুঁচো গেলার অবস্থা৷ না যাচ্ছে গেলা, না যাচ্ছে উগরানো৷ বিজেপির সাথে দেশের একচেটিয়া পুঁজিপতিদের ঘনিষ্ঠতা যে নিখাদ পারস্পরিক স্বার্থরক্ষার, অর্থাৎ লেনদেনের, যাকে অর্থনীতির ভাষায় স্যাঙাততন্ত্র বলে, তারই টাটকা উদাহরণ রাফাল যুদ্ধবিমান কেনা নিয়ে বিরাট কেলেঙ্কারি৷
৩৬টি বিমান কেনা নিয়ে বিজেপি সরকারের বিরুদ্ধে অভিযোগ উঠেছে অনিল আম্বানিকে ২১ হাজার কোটি টাকার বরাত পাইয়ে দেওয়ার৷ বিজেপি নেতারা ‘দুর্নীতি হয়নি’, এ কথাও জোর দিয়ে বলতে পারছেন না, আবার হয়েছে তা স্বীকার করারও নৈতিক জোর নেই এই নেতাদের৷ ফলে প্রধানমন্ত্রী যত এ ব্যাপারে ‘স্পিকটি নট’ হচ্ছেন, অনিল আম্বানি তত গলা চড়াচ্ছেন– আমার নামে কিছু বললে ভাল হবে না, আমার কোনও দোষ নেই, সরকার নয়, ফরাসি কোম্পানিই আমাকে যা দেওয়ার দিয়েছে৷
২০১২ সালে ইউপিএ সরকার ফরাসি সরকারের সাথে দুই ইঞ্জিন বিশিষ্ট বহুমুখী ফাইটার বিমান কেনার চুক্তি করে৷ চুক্তি অনুযায়ী, ফ্রান্সের বিমান প্রস্তুতকারক ডসাল্ট কোম্পানির থেকে রাফাল নামের ১২৬টি যুদ্ধ–বিমান কেনার কথা হয়৷ এর মধ্যে ১৮টি তৈরি অবস্থায় দেবে কোম্পানি এবং বাকি ১০৮টি রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থা হিন্দুস্তান অ্যারোনটিক্স লিমিটেডের (হ্যাল) সাথে ডসাল্ট ভারতে যৌথভাবে তৈরি করবে৷
কিন্তু মোদি সরকার ২০১৫ সালে এই চুক্তি বাতিল করে দেয় এবং নতুন আর একটি চুক্তি করে৷ এবার ৩৬টি বিমান কেনার সিদ্ধান্ত হয়৷ চুক্তি অনুযায়ী সবগুলি বিমানই তৈরি হবে ফ্রান্সে এবং দাম পড়বে মোট ৫৯ হাজার কোটি টাকা৷ অভিযোগ উঠেছে, আগের চুক্তিতে বিমান পিছু খরচ যেখানে ছিল ৫২৬ কোটি টাকা, সেখানে বর্তমান চুক্তিতে বিমান পিছু খরচ পড়ছে ১৬৭০ কোটি টাকা৷ তা ছাড়া চুক্তিতে হ্যালের সাথে যৌথভাবে ভারতে নির্মাণের দ্বারা যুদ্ধ বিমানের উন্নত প্রযুক্তি আয়ত্ত করার যে সুযোগ ছিল এই চুক্তির দ্বারা তাকে বিসর্জন দেওয়া হল৷ প্রধানমন্ত্রী এতদিন ধরে যে ‘মেক ইন ইন্ডিয়া’র ঢাক পিটিয়ে আসছেন, এই চুক্তি তো তাঁর সেই নীতিরই বিরোধী৷ স্বাভাবিক ভাবেই প্রশ্ন উঠছে, কী এমন কারণ যার জন্য প্রধানমন্ত্রী তাঁর ঘোষিত নীতির বিরুদ্ধে গিয়ে এমন সিদ্ধান্ত নিলেন, যেখানে অভিযোগ উঠেছে, নতুন চুক্তিতে প্রতিটি বিমানের দাম আগের চুক্তির থেকে তিন গুণ বেশি পড়েছে?
এইখানেই উঠছে আম্বানি ভাইকে ‘পাইয়ে দেওয়া’র প্রশ্নটি৷ নতুন চুক্তি অনুযায়ী, বিমান কেনার জন্য মোট খরচের অর্ধেক পরিমাণ অর্থ, অর্থাৎ প্রায় ৩০ হাজার কোটি টাকা ভারতের প্রতিরক্ষা ক্ষেত্রে বিমান সংক্রান্ত গবেষণা এবং যন্ত্রাংশ উৎপাদনে বিনিয়োগ করবে ডসাল্ট কোম্পানি৷ দেখা যাচ্ছে, ডসাল্ট এই কাজ করার জন্য যে ভারতীয় কোম্পানিগুলির সঙ্গে চুক্তি করেছে, তাতে এই ৩০ হাজার কোটির সিংহভাগ অর্ডারই হস্তগত করেছে অনিল আম্বানির ‘রিলায়েন্স অ্যারোস্ট্রাকচার’৷ পরিমাণটা প্রায় ২১ হাজার কোটি টাকা৷ আম্বানির এই রিলায়েন্স অ্যারোস্ট্রাকচারের সাথে ডসাল্ট কোম্পানি মিলে তৈরি হয়েছে ‘ডসাল্ট রিলায়েন্স অ্যারোস্পেস’৷ স্বাভাবিক ভাবেই অভিযোগ উঠেছে, রিলায়েন্সের বিমান তৈরি সংক্রান্ত কোনও অভিজ্ঞতাই নেই৷ কোম্পানিটি তৈরি হয়েছে মাত্র বছর খানেক আগে এই চুক্তি নিয়ে কথাবার্তা শুরুর পর৷ তা সত্ত্বেও ষাট বছরের অভিজ্ঞতা সম্পন্ন সরকারি সংস্থা হ্যাল–কে বাতিল করে তাদের এই চুক্তিতে যুক্ত করা হল কেন?
এখানেই গুরুত্বপূর্ণ হিসাবে দেখা দিয়েছে স্যাঙাততন্ত্রের প্রশ্নটি৷ না হলে এই চুক্তির মধ্যে হ্যালকে বাদ দিয়ে হঠাৎ আম্বানি ভাইয়ের ঢুকে পড়ার আর কী কারণ থাকতে পারে? গুজরাটে নরেন্দ্র মোদির রাজত্বকালে ‘গুজরাট মডেলে’ যারা সবচেয়ে বেশি লাভবান হয়েছিল তাদের মধ্যে অন্যতম আম্বানিরা৷ ২০১৪ সালে বিজেপির উত্থানের পিছনে আম্বানিরা যে দেদার টাকা ঢেলেছিল সে কথা সবারই জানা৷ গত চার বছরে নরেন্দ্র মোদি সেই ঋণ শোধ করতে ভোলেননি৷ সম্প্রতি প্রকাশিত এক রিপোর্টে দেখা যাচ্ছে, দেশের ১ শতাংশ ধনকুবেরের সম্পদ শুধু গত এক বছরে বেড়েছে ২০.৯ লক্ষ কোটি টাকা, যা দেশের ২০১৭–১৮ অর্থবর্ষের মোট বাজেটের সমান৷ এই ধনকুবেরদের প্রথম সারিতেই রয়েছেন আম্বানি ভাইরা৷ অর্থাৎ মোদি রাজত্বে এঁদের জন্য অবাধ লুঠের ব্যবস্থা করে দেওয়া হয়েছে৷ সেই লুঠেরই সাম্প্রতিক উদাহরণ রাফাল কেলেঙ্কারি৷
বিজেপির দুই প্রাক্তন মন্ত্রী যশবন্ত সিনহা এবং অরুণ শৌরি–ও এই চুক্তিতে বিরাট দুর্নীতির অভিযোগ করে প্রকাশ্যে প্রশ্ন তুলেছেন, আগের সরকারের চুক্তি বদলানোর আগে মন্ত্রিসভার নিরাপত্তা বিষয়ক কমিটি, প্রতিরক্ষা মন্ত্রক, বিদেশ মন্ত্রক, বায়ুসেনা প্রধানের সঙ্গে আলোচনা করেননি প্রধানমন্ত্রী৷ প্রাক্তন প্রতিরক্ষামন্ত্রী মনোহর পর্রীকরও বলেছেন, তিনি কিছু জানতেন না৷ অভিযোগ উঠেছে, এ সব রীতির লঙঘন আম্বানিদের পাইয়ে দেওয়ার জন্যই৷ তাঁরা তিন মাসের মধ্যে সিএজির ‘ফরেন্সিক অডিট’ করানোর দাবি তুলেছেন৷
সরকারের পক্ষ থেকে এই সব অভিযোগের কোনও উত্তর নেই৷ প্রধানমন্ত্রী যথারীতি নীরব৷ সরকারের কর্তারা কেউ কেউ বলেছেন, প্রতিরক্ষা সংক্রান্ত এই চুক্তি গোপন রাখার সিদ্ধান্ত হয়েছে৷ এমন সিদ্ধান্ত হতেই পারে৷ যেহেতু এই বিমান সেনাবাহিনীর জন্য তাই এর প্রযুক্তিগত বিষয়গুলি গোপন রাখাই উচিত৷ যদিও জানা গেছে, কোম্পানিটি শুধু ভারতকেই এই বিমান বিক্রি করছে এমন নয়, আরও অন্য দেশকেও একই বিমান বিক্রি করেছে৷ ফলে প্রযুক্তিগত গোপনীয়তার বিষয়টিও ধোপে টেকে না৷ কিন্তু দামের বিষয়টি কিংবা রিলায়েন্স কোম্পানির যুক্ত হওয়ার বিষয়টি তো গোপনীয় কোনও বিষয় নয়৷ তা হলে দেশের মানুষের কাছে এ সব গোপন করা হচ্ছে কেন? বিমান কেনার এই বিপুল খরচ তো মোদি সরকার জনগণের দেওয়া করের টাকা থেকেই মেটাবে৷ তা হলে সেই জনগণের কাছে এসব তথ্য তো সরকার জানাতে বাধ্য৷ সরকারকে দেশের মানুষের কাছে প্রকাশ্যে জানাতে হবে, কেন তিনগুণ বেশি দামে এই চুক্তি হল, কেন কোনও অভিজ্ঞতা না থাকা সত্ত্বেও সরকারি সংস্থা হ্যালকে বাদ দিয়ে রিলায়েন্সদের এই চুক্তিতে যুক্ত করা হল? তার জন্য তারা কী পরিমাণ মুনাফা পাবে?
প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি তো সব বিষয়ে স্বচ্ছতার কথা বলেন, দেশের স্বার্থ রক্ষার কথা বলেন৷ তা হলে এমন একটি গুরুতর বিষয়ে স্বচ্ছতা রক্ষায় তাঁদের এত অনীহা কেন? বিজেপির কাছে অনিল আম্বানিদের স্বার্থই কি তা হলে দেশের স্বার্থ? প্রধানমন্ত্রী নিশ্চয় বফর্স কেলেঙ্কারির কথা ভুলে যাননি৷ যে কংগ্রেস এখন হঠাৎ সততার তকমা এঁটে আসরে নেমেছে, গত লোকসভা নির্বাচনে যাদের দেশের মানুষ প্রত্যাখ্যান করেছিল ব্যাপক দুর্নীতির কারণে, সেই কংগ্রেসের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রীর বিরুদ্ধে বোফর্স কোম্পানি থেকে ৬৪ কোটি টাকা ঘুষ নেওয়ার অভিযোগ উঠেছিল৷ অভিযোগের কোনও উত্তর দিতে না পারায় কংগ্রেস সরকারের পতন ঘটেছিল৷ রাফাল–কেলেঙ্কারি নিয়ে ওঠা অভিযোগেরও কিন্তু যথাযথ জবাব দেশের মানুষকে দিতে হবে বিজেপি নেতাদের৷
(৭১ বর্ষ ৫ সংখ্যা ৩১ আগস্ট, ২০১৮)