নতুন কৃষি আইন এনে বিজেপি সরকার এ দেশে আজ যা করতে চাইছে ৪০ বছর আগে সেটাই করা হয়েছিল আমেরিকায়। আমেরিকার সরকার কর্পোরেট পুঁজির মালিকদের সামনে হাট করে খুলে দিয়েছিল কৃষিক্ষেত্রের দরজা। কী হয়েছে তার পরিণতি? কেমন আছেন বিপুল সংখ্যক মার্কিন ছোট চাষি? খতিয়ে দেখতে গত জানুয়ারিতে আমেরিকার ১০ হাজার কিলোমিটার গ্রামীণ অঞ্চল সফর করেছেন লস এঞ্জেলেসের বাসিন্দা আইআইটি-প্রাক্তনী,নাসার প্রাক্তন বিজ্ঞানী জাতীয় পুরস্কারপ্রাপ্ত ফিল্ম পরিচালক বেদব্রত পাইন ও তাঁর তিন সহযোগী। ৮ মার্চ টাইমস অফ ইন্ডিয়ায় প্রকাশিত হয়েছে তাঁদের লিখিত অভিজ্ঞতা, গা শিউরে ওঠা ছবি।
ছোট চাষিদের জীবনে আজ শুধুই অন্ধকার
ভারতের মতোই আমেরিকাতেও ছোট চাষির সংখ্যাই বেশি। মোট কৃষক সংখ্যার ৯০ শতাংশই ছোট চাষি। কিন্তু ফসল বিক্রি করে দেশের মোট যে আয় হয়, তার মাত্র ২৫ শতাংশের দাবিদার তাঁরা। আমেরিকার গ্রামীণ জীবনের সংকটের চেহারা বুঝতে এই পরিসংখ্যানটুকুই যথেষ্ট। সে দেশে গত কয়েক দশক ধরে ছোট চাষিদের আয় ক্রমাগত কমেই চলেছে। ২০ বছরে আমেরিকায় গম চাষের খরচ বেড়েছে তিন গুণ। অথচ বিক্রির সময় ছোট চাষির জোটে সেই ১৮৫৬ সালের গৃহযুদ্ধের সময়কার মতো যৎসামান্য দাম। স্বাভাবিক ভাবেই ধারদেনায় গলা পর্যন্ত ডুবে আছে মার্কিন ছোট চাষিদের। তাঁদের মোট ঋণের পরিমাণ সাড়ে ৪২ হাজার কোটি ডলার ছুঁয়েছে। বেড়ে চলেছে ব্যাঙ্কের ধার শোধ করতে না পারা ‘দেউলিয়া’চাষির সংখ্যাও। সমাধানের দিশা খুঁজে না পেয়ে আত্মহত্যার পথ বেছে নিচ্ছেন নিরুপায় মানুষগুলি। দিনে দিনে দীর্ঘ হচ্ছে আত্মঘাতী চাষির মিছিল। সাহায্য চেয়ে মনোবিদের চেম্বারে ভিড় করছেন চরম হতাশাগ্রস্ত এই চাষিরা। আত্মহত্যা করেছেন স্থানীয় এক ব্যাঙ্ককর্মীও। নিঃস্ব হয়ে পড়া ছোট চাষিদের কাছ থেকে ধারের টাকা আদায়ের দায়িত্ব দিয়েছিল ব্যাঙ্ক। ঘনিষ্ঠ প্রতিবেশীদের অসহায় জীবনযন্ত্রণা মেনে নিতে পারেননি তিনি।
মার্কিন গ্রামগুলি আজ প্রায় জনমানবহীন। ছোট চাষ প্রায় বন্ধ। সাথে সাথে বন্ধ হয়ে যাচ্ছে ছোটখাট গ্রামীণ ব্যবসাপত্রও। বন্ধ হয়ে পড়ে থাকছে বীজের দোকান,শস্য রাখার শূন্য গোলাঘর,কৃষি-যন্ত্রপাতি সারাইয়ের ছোট কারখানা এমনকি স্থানীয় হাসপাতালগুলিও। প্রতি বছরই আমেরিকার গ্রামগুলিতে প্রায় হাজারখানেক করে স্কুল বন্ধ হয়ে যাচ্ছে ছাত্রছাত্রীর অভাবে। সব মিলিয়ে চরম দারিদ্র ও দুর্দশা গ্রাস করেছে গ্রামীণ আমেরিকার আকাশ।
দায় কার
গ্রামসফরে গিয়ে ছোট চাষিদের অনেকের সঙ্গে কথা বলেছেন সমীক্ষকরা। প্রত্যেকেই বলেছেন, প্রেসিডেন্ট রোনাল্ড রেগানের হাত ধরে মার্কিন ছোট চাষিদের দুর্দশার শুরু। মার্কিন কৃষিতে বৃহৎ কৃষি-ব্যবসায়ী বড় পুঁজির মালিকদের অবাধ প্রবেশের ছাড়পত্র দিয়েছিলেন প্রেসিডেন্ট রেগান। ছোট চাষিদের জীবন-জীবিকা উচ্ছেদ করে হাতে-গোনা বড় কৃষি-ব্যবসায়ীরাই আজ মার্কিন কৃষিক্ষেত্রের প্রায় পুরোটা দখল করে নিয়েছে।
১৯৮১ সালে প্রেসিডেন্ট হন বিনিয়ন্ত্রণ ও অবাধ বাণিজ্যের অন্যতম প্রবক্তা রেগান। যাবতীয় সরকারি নিয়ন্ত্রণ তুলে নিয়ে দেশের কৃষি-অর্থনীতির দরজা তিনি হাট করে খুলে দিয়েছিলেন বড় পুঁজির মালিকদের সামনে। নতুন কৃষি আইনে চাষি ও সাধারণ ক্রেতাদের সুবিধা হবে বলে নরেন্দ্র মোদি যেভাবে ঢাক পেটাচ্ছেন,ঠিক তেমন ভাবেই কৃষিকে কর্পোরেট পুঁজির হাতে তুলে দেওয়ার সুফল নিয়ে ব্যাপক প্রচার করেছিলেন প্রেসিডেন্ট রেগান।
১৯২৯ সালের বিশ্বজোড়া মহামন্দা থেকে বাঁচতে কৃষি-ফসলের দামে সরকারি ভরতুকি, কম সুদে কৃষিঋণের ব্যবস্থা, নূ্যনতম সহায়ক মূল্যের ধাঁচে ‘প্যারিটি প্রাইসিং’ ইত্যাদি যে সব ব্যবস্থা চালু করা হয়েছিল আমেরিকায়, বিনিয়ন্ত্রণের পথে হেঁটে ধীরে ধীরে সে সব তুলে নেওয়া হল। এরই মধ্যে ২০০৮ নাগাদ আবার বিশ্ব জুড়ে আঘাত হানে ভয়ঙ্কর অর্থনৈতিক মন্দা। ফসল বিক্রি করতে গিয়ে আমেরিকার ছোট চাষিরা হঠাৎ দেখলেন,দাম ব্যাপক কমে গেছে। পাশাপাশি কমে যায় জমির মূল্য এবং ব্যাপক চড়ে যায় সুদের হার। সরকারি সহায়তা হারিয়ে বন্ধ হয়ে যায় আড়াই লক্ষ ছোট কৃষিক্ষেত্র। ১০ লাখেরও বেশি চাষি পরিবার,চাষবাসই বংশানুক্রমে যাঁদের পেশা,বাস্তুচ্যুত হয়ে পড়েন। আমেরিকার মানচিত্রে এখন জনমানবহীন অসংখ্য গ্রামের ভিড়।
সর্বনাশা চুক্তিচাষ
পুঁজির নিয়মেই ধীরে ধীরে গ্রামীণ আমেরিকায় চাষের জমির অধিকাংশই চলে গেছে বড় কৃষি-ব্যবসায়ীদের গ্রাসে। জমিহারা অসংখ্য মার্কিন চাষি এখন চুক্তিচাষের কড়া শর্ত মেনে কৃষি-ব্যবসায়ীদের অধীনে হাড়ভাঙা খাটনি খেটে দু’মুঠো খাবারের বন্দোবস্ত করছেন। এখন হাতে গোনা কয়েকটি বৃহৎ কৃষি কোম্পানি নিয়ন্ত্রণ করছে আমেরিকার কৃষিপণ্যের গোটা বাজারটা। নিতান্ত অল্প সংখ্যক যেসব ছোট চাষি এখনও চাষের কাজে যুক্ত আছেন,নেহাত অল্প দামে তাদের ফসল কিনে নিচ্ছে বড় কোম্পানিগুলি। কৃষিক্ষেত্রের গোটা পরিকাঠামোটাই এখন বড় ব্যবসায়ীদের হাতের মুঠোয়। চাষের খরচ তারা এমন জায়গায় নিয়ে গেছে যে ছোট চাষিরা কোনও মতেই তাদের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে উঠতে পারছে না।
আমেরিকার কৃষি চিত্রনাট্যে এক ট্র্যাজিক চরিত্র জিম গুডম্যান। সমীক্ষকরা কথা বলেছেন তাঁর সঙ্গে। গো-পালনের কাজটিকে অন্তর থেকে ভালবাসতেন গুডম্যান। নিজের ডেয়ারি ফার্মের ৪৫টি গোরুর প্রতিটিকে আলাদা করে চিনতেন,নাম জানতেন। ফার্মটিকে বাঁচিয়ে রাখতে ৪০ বছর ধরে বড় ব্যবসায়ীদের সঙ্গে লড়াই করেছেন তিনি। কিন্তু শেষরক্ষা হয়নি। গোরুগুলি বিক্রি করে দিয়ে ডেয়ারি ফার্মটি শেষ পর্যন্ত বন্ধ করে দিতে বাধ্য হয়েছেন গুডম্যান। এমনই এক গো-পালক জোয়েল গ্রিনো এখন একটি কারখানায় ১২ ঘন্টার দিনমজুরি করেন। ছোট চাষিদের একটা বড় অংশ ভাগচাষি হয়ে গেছেন। ট্রাক্টর ভাড়া করে চাষ করতে হয় তাঁদের। এঁদেরই একজন ধারের কিস্তি শোধ করতে পারেননি বলে মরশুমের মাঝখানে কোম্পানি নিয়ে চলে গেছে তাঁর ট্রাক্টরটি। এখন তিনি অথৈ জলে।
দুর্গতিতে পশুপালকরাও
শুধু ছোট চাষিরাই নয়,আমেরিকার পশুপালক মানুষগুলিও আজ চরম দুর্দশায়। বড় কোম্পানির মালিকরা জোট বেঁধে কেমন করে বন্ধ করতে বাধ্য করেছে মাইক ক্যালিক্রেটের পশুখামার, সেই করুণ কাহিনী সমীক্ষকদের শুনিয়েছেন তিনি। আমেরিকায় এখন হাতে গোনা কয়েকটি বড় কোম্পানি গোটা পশুমাংসের বাজার কব্জা করে নিয়েছে। মুরগি,গোরু কিংবা শুয়োর চাষিরা এখন ঠিক যেন সেইসব কোম্পানির ক্রীতদাস। চুক্তির ভিত্তিতে কোম্পানির বেঁধে দেওয়া দামে কোম্পানির হয়ে পশুপাখি পালন করেন এঁরা। একসময়ে যাঁরা ছিলেন স্বাধীন ব্যবসায়ী, আজ তাঁরা মালিকের অধীনস্থ– দরদাম করার উপায় পর্যন্ত নেই তাঁদের।
বর্তমানে আমেরিকার ৭৫ শতাংশ মুরগিপালক রয়েছেন দারিদ্রসীমার নিচে। কৃষিক্ষেত্রের সঙ্গে যুক্ত প্রতিটি খুঁটিনাটি বিষয় এখন হাতে গোনা বৃহৎ কৃষি ব্যবসায়ীদের নিয়ন্ত্রণে। বীজ ব্যবসার তিনভাগের দু’ভাগ, রাসায়নিক সার ব্যবসার ৮০ শতাংশ, শস্য বিক্রি, ডেয়ারি-পণ্য ও মাংস উৎপাদন এবং চাষের জন্য প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতি উৎপাদনের প্রায় পুরোটাই এখন মাত্র চারটে বড় একচেটিয়া কৃষি-কোম্পানির দখলে।
কৃষি-কোম্পানির মাথায় সরকারি আশীর্বাদের হাত
বড় পুঁজির মালিক এইসব কৃষি কোম্পানিগুলির প্রতি দৃষ্টিভঙ্গির ক্ষেত্রে মোদি সরকারের সঙ্গে অদ্ভূত মিল মার্কিন সরকারের। ঠিক আমাদের দেশের মতোই আমেরিকার সরকারও বড় পুঁজির এই মালিকদের দিকে দেদার অর্থসাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিয়েছে। ফসল বিক্রির ক্ষেত্রে নানা ধরনের সুবিধা, ঋণে বিপুল ছাড়, ফসল বিমা ইত্যাদির মধ্য দিয়ে কৃষি কোম্পানিগুলির মুনাফার বিশ্বস্ত পাহারাদারের ভূমিকা চমৎকার ভাবে পালন করে চলেছে মার্কিন সরকার। ছোট চাষিদের জীবন অন্ধকারে ভরে যায় যাক, মার্কিন সরকার ভরতুকির ৫ হাজার কোটি ডলারের ৭০ শতাংশেরও বেশি ঢেলে দেয় কৃষি-ব্যবসায়ী সংস্থাগুলির ওপরতলার ২০ শতাংশের পায়ে। বুঝতে অসুবিধা হয় না, শাসক দলগুলির প্রত্যক্ষ পৃষ্ঠপোষকতা রয়েছে এর পিছনে। কৃষিপণ্যের উৎপাদক ও ক্রেতা, উভয়েরই কল্যাণ হবে– এই ধুয়া তুলে প্রেসিডেন্ট রেগান একচেটিয়া কারবারিদের ক্ষমতা বৃদ্ধিতে সাহায্য করেছিলেন। বলেছিলেন, ‘‘ক্ষমতার কেন্দ্রীভবনের অনুমতি দিতে চলেছি আমরা। কারণ, এর ফলে দক্ষতা বাড়বে…। জিনিসপত্রের দাম কমাতে এঁরা (একচেটিয়া কারবারিরা) এর সুযোগ নিতে চলেছেন।” মাঝে মাঝে ঠিক এমনই সুরে ভারতের বৃহৎ শিল্পপতিদের গুণকীর্তন শোনা যায় না নরেন্দ্র মোদিদের গলায়?
গ্রামীণ আমেরিকা আজ ধুলোয় লুটাচ্ছে
একচেটিয়া কারবারের রমরমা হয়েছে আমেরিকার কৃষিক্ষেত্রে। কিন্তু প্রেসিডেন্ট রেগানের প্রেসক্রিপশন অনুযায়ী খাদ্যপণ্যের দাম কি কমেছে সেখানে? একেবারেই না। বরং দেখা যাচ্ছে গত ৪০ বছরে আমেরিকায়় খাদ্যপণ্যের গড় দাম ২০০ শতাংশেরও বেশি বেড়েছে। বিপরীতে, আর্থিক ভাবে পিছিয়ে থাকা মার্কিন নাগরিকদের ৯০ শতাংশের রোজগার বেড়েছে খুব বেশি হলে মাত্র ২৫ শতাংশের মতো, যাকে মূল্যবৃদ্ধির সাপেক্ষে বৃদ্ধি বলা চলে না।
গোটা কৃষিক্ষেত্রটি বৃহৎ পুঁজির মালিকদের হাতে তুলে দিয়ে দেশের অসংখ্য খেটে-খাওয়া সাধারণ মানুষকে পথে বসিয়েছে মার্কিন সরকার। গ্রামীণ আমেরিকার মানুষ আজ চূড়ান্ত গরিবিতে ধুঁকছে। বেড়েছে খেতে-না-পাওয়া শিশু ও অনাহারী পরিবারের সংখ্যা। বিশ্বের সবচেয়ে শক্তিধর দেশ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বড় বড় শহরগুলির তাক-লাগানো চাকচিক্যের নিচে চাপা পড়ে রয়েছে পরিত্যক্ত দুর্দশাগ্রস্ত অন্ধকার গ্রামগুলি। বৃহৎ কর্পোরেট পুঁজির মুনাফার নির্মম ফাঁসে দম বন্ধ হয়ে আজ ছটফট করছে গ্রামীণ আমেরিকা।
অনেকে প্রশ্ন করেন,আমাদের দেশের চাষিরা নতুন কৃষি আইনগুলি প্রতিরোধে দিল্লিতে এভাবে মরণপণ আন্দোলনে মাসের পর মাস ধরে অনড় রয়েছেন কেন। আসলে আমেরিকার পথ অনুসরণ করে নরেন্দ্র মোদি সরকার আম্বানি-আদানিদের সামনে রেখে ভারতেও যে এ জিনিস করতে চায়, সে কথা ধরে ফেলেছেন দেশের কৃষিজীবী মানুষ। নতুন কৃষি আইনগুলি চালু হলে তাঁদেরও যে আমেরিকার ছোট চাষিদের মতো চূড়ান্ত দুরবস্থায় পড়তে হবে– বুঝে ফেলেছেন তাঁরা। তাই তাঁরা বদ্ধপরিকর, কোনও মতেই আম্বানি-আদানিদের মতো বৃহৎ পুঁজিপতিদের গিলে খেতে দেবেন না ভারতের কৃষিক্ষেত্রটিকে, আমেরিকার চাষিদের মতো ভারতের চাষিদেরও ছুঁড়ে ফেলতে দেবেন না সর্বনাশের অতল গহ্বরে। হাজারো বাধা বিপত্তি আসুক, সরকার সর্বশক্তি নিয়োগ করে যতই আন্দোলন ভাঙার অপচেষ্টা চালাক, কৃষি আইনগুলি বাতিল না হওয়া পর্যন্ত লড়াইয়ের ময়দান ছাড়বেন না তাঁরা– এই তাঁদের অঙ্গীকার। দেশের মানুষকে সর্বশক্তি নিয়ে দাঁড়াতে হবে সংগ্রামরত এই মানুষগুলির পাশে।