আমেরিকায় ছাত্র বিক্ষোভ ভাঙার জন্য পুলিশি অত্যাচারের একটি ছবি দেখে শিউরে উঠেছে গোটা বিশ্ব। আটলান্টার ইমোরি বিশ্ববিদ্যালয়ের এক অধ্যাপিকা বিক্ষোভরত ছাত্রদের উপর পুলিশের হামলার প্রতিবাদ করতেই তাঁকে মাটিতে উল্টো করে ফেলে পা দিয়ে পিঠ চেপে ধরেছে দুই পুরুষ পুলিশ। তাঁর দুই হাত জোর করে মুচড়ে পিছনে নিয়ে গিয়ে হাতকড়া পরিয়ে দিয়েছে পুলিশ। তিনি চিৎকার করে বলছিলেন, ‘আমি একজন অধ্যাপিকা’–কিন্তু কোনও কিছুই শোনেনি পুলিশ।
সারা আমেরিকা জুড়ে একটার পর একটা বিশ্ববিদ্যালয়ে ছড়িয়ে পড়ছে প্যালেস্টাইনের মুক্তির দাবিতে ছাত্র বিক্ষোভ। এর শুরু গত ১৭ এপ্রিল কলম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে। একে একে বিক্ষোভ ছড়িয়ে পড়েছে টেক্সাস বিশ্ববিদ্যালয়, জর্জিয়ার ইমোরি বিশ্ববিদ্যালয়, বোস্টনের এমারসন কলেজ, ইন্ডিয়ানা বিশ্ববিদ্যালয়, প্রিন্সটন বিশ্ববিদ্যালয়, ইউনিভার্সিটি অফ সাদার্ন ক্যালিফোর্নিয়া, হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয় সহ আমেরিকার বিস্তীর্ণ অঞ্চলে। প্রায় সর্বত্রই ছাত্ররা তাঁবু খাটিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্যেই অবস্থান শুরু করেছেন। এই বিক্ষোভ সরাসরি প্রশ্ন তুলছে মার্কিন সরকারের ইজরায়েল নীতির বিরুদ্ধে। বিক্ষোভ ভাঙতে মার্কিন পুলিশ শত শত ছাত্রকে গ্রেপ্তার করেছে। পুলিশ লাঠি চালিয়ে আহত করেছে বহু ছাত্রকে, ইমোরি বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রদের গায়ে রাসায়নিক স্প্রে করার অভিযোগ উঠেছে। একের পর এক প্রদেশের সরকার এবং বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ ছাত্রদের হুমকি দিয়ে চলেছে। তাদের সাময়িকভাবে বহিষ্কার করা হচ্ছে। মার্কিন শাসকদলের নেতারা হুমকি দিচ্ছেন, প্রতিবাদী ছাত্রদের কড়া শাস্তির ব্যবস্থা হবে। তবু ছাত্ররা আন্দোলনে অটল। ছাত্রদের পাশে এসে দাঁড়িয়েছেন অধ্যাপক এবং গবেষকরা। দেখা যাচ্ছে মার্কিন সরকার যতই এই আন্দোলনকে ইহুদি বিরোধী বলে চিহ্নিত করার চেষ্টা করুক না কেন, ইহুদি অধ্যাপক এবং ছাত্ররা অন্যদের সাথে এক যোগেই ‘ফ্রি প্যালেস্টাইন’ স্লোগানে গলা মেলাচ্ছেন। তাঁদের অনেকের হাতে প্ল্যাকার্ড–‘জিউস অলসো ডিম্যান্ড ফ্রি প্যালেস্টাইন’। এই আন্দোলনের দাবি একটাই–প্যালেস্টাইনে ইজরায়েলের ভয়াবহ গণহত্যা বন্ধ করতে হবে। মার্কিন সরকারকে ইজরায়েলি যুদ্ধে অর্থ ও অস্ত্র জোগানো বন্ধ করতে হবে, ইজরায়েলি সামরিক বাহিনীর সঙ্গে সম্পর্কিত কোনও কোম্পানির যন্ত্র বা সরঞ্জাম বিশ্ববিদ্যালয়ে ব্যবহার করা চলবে না, মার্কিন বিশ্ববিদ্যালয়ের কোনও গবেষণা ইজরায়েলের সামরিক বাহিনীকে সাহায্য করলে তা বন্ধ করতে হবে।
ইজরায়েলের আক্রমণে ইতিমধ্যে প্যালেস্টাইনের গাজা ভূখণ্ডে সরকারি হিসাবেই ৩৪,২৬২ জন মানুষ প্রাণ হারিয়েছেন। এর একটা বড় সংখ্যা হল শিশু-কিশোর। একটার পর একটা হাসপাতাল, শরণার্থী শিবির, স্কুল, আবাসিক এলাকা মার্কিন মদতপুষ্ট ইজরায়েলি সেনা ধ্বংস করে দিয়েছে। রাষ্ট্রসংঘ সহ গোটা বিশ্বের জনমত বলেছে এটা মার্কিন মদতপুষ্ট ইজরায়েলের চালানো গণহত্যা ছাড়া কিছু নয়। একটা জাতিকে নিশ্চিহ্ন করে দিয়ে প্যালেস্টাইনকে পুরোপুরি দখল করাই ইজরায়েলের উদ্দেশ্য।
এই সত্য আজ সারা বিশ্ব জানে যে, মার্কিন শাসকদের প্রত্যক্ষ মদত ছাড়া ইজরায়েল এই গণহত্যা চালাতে পারত না। পশ্চিম ও মধ্য এশিয়ায় তেলসমৃদ্ধ বিস্তীর্ণ ভূখণ্ডে নিজেদের সামরিক কৌশলগত শক্তিবৃদ্ধির জন্যই মার্কিন সাম্রাজ্যবাদীরা ইজরায়েলের বকলমে প্যালেস্টাইনের মানুষের বেঁচে থাকার অধিকারকে পর্যন্ত কবর দিতে বদ্ধপরিকর। একটা সাম্রাজ্যবাদী দেশের শাসক আর সাধারণ জনগণের স্বার্থবুদ্ধি যে এক নয় তা এই মার্কিন ছাত্রদের প্রবল বিক্ষোভ আবার প্রমাণ করছে। কিছুদিন আগেই মার্কিন বায়ুসেনা কর্মী অ্যারন বুসনেল ইজরায়েলি দূতাবাসের সামনে গায়ে আগুন লাগিয়ে আত্মাহুতি দেন। আগুনে পুড়তে পুড়তেও তিনি জোর গলায় বলে গিয়েছিলেন, প্যালেস্টাইনকে মুক্ত করো। সারা বিশ্বেই বিশেষত ইউরোপের নানা দেশে যুদ্ধবিরোধী মানুষ গাজায় ইজরায়েলের এই গণহত্যা বন্ধের দাবি নিয়ে রাস্তায় নেমেছেন। সাম্রাজ্যবাদী-পুঁজিবাদী শাসকরা সর্বত্রই সাম্রাজ্যবাদী পুঁজির স্বার্থকেই দেশের স্বার্থ হিসাবে দেখিয়ে তাদের জঘন্য দস্যুবৃত্তির জন্য মানুষের সমর্থন আদায় করতে চায়। জনগণ যখন বলে, ‘নট ইন মাই নেম’–তুমি আমার নামে নরহত্যা করতে পারো না, সাম্রাজবাদীদের অভিসন্ধি মানুষের চোখে ধরা পড়ে যায়। সে দিক থেকে দেখলে আমেরিকার বিশ্ববিদ্যালয়গুলিতে চলা ছাত্র আন্দোলন সাম্রাজ্যবাদী শাসকদের মেকি দেশভক্তির মুখোশ খুলে দিয়েছে।
মার্কিন ছাত্রসমাজ এর আগেও দেশ জুড়ে আন্দোলনে নেমেছে। ১৯৬০-এ ক্যারোলিনার কৃষি কলেজ থেকে শুরু হয়েছিল সরকারের বর্ণবিদ্বেষী সার্কুলারের বিরুদ্ধে আন্দোলন। সারা আমেরিকায় তা ছড়িয়ে পড়ে। ছাত্রদের জয় হয়। ১৯৬৮-৭০-এ ভিয়েতনামে মার্কিন আগ্রাসন ও গণহত্যার বিরুদ্ধে মার্কিন ছাত্রসমাজ উত্তাল হয়ে ওঠে। কলম্বিয়া এবং হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষকে ছাত্ররা বাধ্য করেছিলেন নাপাম বোমা সরবরাহকারী ডাও কেমিক্যাল এবং পেন্টাগনের সঙ্গে সমস্ত গবেষণার চুক্তি বাতিল করতে। পুলিশের গুলিতে ওহিও, মিসিসিপিতে পাঁচজন ছাত্র নিহত হন, আহত হন বহু। এই ছাত্র আন্দোলন আমেরিকার সমস্ত স্তরের মানুষকে প্রবল নাড়া দিয়েছিল। ফলে মার্কিন সরকার ভিয়েতনাম থেকে হাত ওঠাও–এই দাবি হয়ে ওঠে জনগণের দাবি। পরবর্তীকালে ১৯৮৫ তে দক্ষিণ আফ্রিকা বর্ণবিদ্বেষ বিরোধী আন্দোলনের সমর্থনে ছাত্র বিক্ষোভ, ১৯৯১ ও ২০০৩-এ ইরাকে মার্কিন আগ্রাসনের বিরুদ্ধে সে দেশের ছাত্রদের বিক্ষোভ, ২০১৮-তে ‘ব্ল্যাক লাইভস ম্যাটার’ আন্দোলনে আমেরিকার ছাত্রদের ভূমিকা খুবই গুরুত্বপূর্ণ।
এই ছাত্র আন্দোলন ভারতের ছাত্র সমাজের কাছেও আবেদন রেখে যায়। এ দেশের বিজেপি পরিচালিত কেন্দ্রীয় সরকার মুখে প্যালেস্টাইনের জন্য কিছু সহানুভূতির কথা বললেও ইজরায়েলের জঘন্য যুদ্ধাপরাধকে সাহায্যই করে চলেছে। ভারতে আদানির কারখানায় তৈরি যুদ্ধাস্ত্র ইজরায়েল এই যুদ্ধে ব্যবহার করছে। তাই বিজেপি সরকারও দেশভক্তির মিথ্যা মোহ ছড়িয়ে নিজেদের দেশের একচেটিয়া পুঁজিমালিকদের স্বার্থে যুদ্ধকে চলতেই দিচ্ছে। জি-২০ তে স্বাক্ষরিত চুক্তি অনুযায়ী ভারত থেকে ইজরায়েল পর্যন্ত করিডর তৈরি ভারতীয় একচেটিয়া পুঁজি মালিকদের স্বার্থে দরকার বলেই ভারত সরকার ইজরায়েলের গণহত্যা নিয়ে নীরব। তারা সেখানে সস্তায় শ্রমিক পাঠাচ্ছে ইজরায়েলের হয়ে সিরিয়া বা প্যালেস্টাইনে প্রাণ দিতে। ভারতের সাম্রাজ্যবাদবিরোধী ঐতিহ্য নিয়ে চলা ছাত্রসমাজ এর বিরুদ্ধে কি লড়বে না? এ দেশের বামপন্থী আন্দোলনে সংস্কারবাদীদের প্রাধান্যের জন্য এই আন্দোলন গড়ে ওঠার সম্ভাবনা থাকলেও তা হচ্ছে না। এর ফল ভোগ করতে হচ্ছে বেকারির জ্বালায় জর্জরিত ভারতীয় তরুণদের, যাদের সরকারের সঙ্গে যোগসাজশে নানা কোম্পানি ইজরায়েলে কিংবা ইউক্রেনের যুদ্ধক্ষেত্রে চালান করছে।
আমেরিকার ছাত্রদের এই আন্দোলন গোটা বিশ্বের মানুষের সামনে এ সত্যই আরও একবার তুলে ধরল যে, পুঁজির স্বার্থে সাম্রাজ্যবাদী শাসকদের বর্বরতা দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ সাধারণ মানুষ মুখ বুজে মেনে নিতে রাজি নয়।