এস ইউ সি আই (কমিউনিস্ট)-এর পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য সম্পাদকমণ্ডলীর সদস্য এবং এ আই ইউ টি ইউ সি-র সর্বভারতীয় সম্পাদকমণ্ডলীর সদস্য কমরেড অচিন্ত্য সিংহ ১৬ এপ্রিল রাতে ক্যালকাটা হার্ট ক্লিনিক অ্যান্ড হসপিটালে শেষনিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। মৃত্যুকালে তাঁর বয়স হয়েছিল ৭৬ বছর। কোভিড-আক্রান্ত কমরেড সিংহকে সুস্থ করে তুলতে চিকিৎসক ও স্বাস্থ্যকর্মীদের অক্লান্ত প্রচেষ্টা সত্ত্বেও রক্ষা করা গেল না বহু আন্দোলনের অভিজ্ঞতায় সমৃদ্ধ সর্বহারার মহান নেতা কমরেড শিবদাস ঘোষের আদর্শে উদ্বুদ্ধ আমৃত্য বিপ্লবী, দলের কর্মী সমর্থক সহ অসংখ্য সাধারণ মানুষের অত্যন্ত প্রিয় অসাধারণ চরিত্রের এই মানুষটিকে। ১৭ এপ্রিল হাসপাতালে তার মরদেহে দলের সাধারণ সম্পাদক কমরেড প্রভাস ঘোষের পক্ষে এবং পলিটবুরো সদস্য কমরেড অসিত ভট্টাচার্যের পক্ষে মাল্যদান করে শ্রদ্ধা জানানো হয়। পলিটবুরো সদস্য ও এআইউটিইউসি-র সর্বভারতীয় সভাপতি কমরেড শঙ্কর সাহা এবং কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য ও এআইইউটিইউসি-র সাধারণ সম্পাদক কমরেড শঙ্কর দাশগুপ্তের পক্ষেও মাল্যদান করা হয়। এ ছাড়াও মাল্যদান করে শ্রদ্ধা জানান। দলের পলিটবুরো সদস্য কমরেড সৌমেন বসু, কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য ও পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য সম্পাদক কমরেড চণ্ডীদাস ভট্টাচার্য এবং এআইইউটিইউসি-র রাজ্য সম্পাদক কমরেড অশোক দাস।
কমরেড অচিন্ত্য সিংহের জন্ম বীরভূম জেলার মুরারই-১ ব্লকের কনকপুর গ্রামে। যদিও ছাত্রাবস্থা থেকেই তিনি মুর্শিদাবাদের রঘুনাথগঞ্জের বাসিন্দা। অত্যন্ত মেধাবী ছাত্র অচিন্ত্য সিংহ জঙ্গিপুর কলেজ থেকে বহরমপুরের কৃষ্ণনাথ কলেজে পড়তে এসেছিলেন। ক্ষুরধার বুদ্ধি ও যুক্তিধারায় কলেজের অধ্যাপক ও ছাত্রদের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছিলেন। জঙ্গিপুরেই কমরেড শিবপূজন সোনারের মাধ্যমে তিনি কমরেড শিবদাস ঘোষের চিন্তাধারা তথা এস ইউ সি আই(সি) দলের সংস্পর্শে আসেন। মার্কসবাদ-লেনিনবাদ-কমরেড শিবদাস ঘোষের চিন্তাধারায় উদ্বুদ্ধ তরুণ কমরেড অচিন্ত্য সিংহ ছাত্রাবস্থাতেই সিদ্ধন্ত নেন দেশের শোষিত নিপীড়িত গরিব মেহনতি মানুষের শোষণমুক্তির লক্ষ্যে বিপ্লবের স্বার্থে নিজের জীবন সম্পূর্ণ ভাবে নিয়োজিত করবেন এবং এই সময় থেকেই তিনি সংগঠন বিস্তারের কাজে আত্মনিয়োগ করেন।
১৯৬৬ সালে কৃষ্ণনাথ কলেজ থেকে গ্র্যাজুয়েশনের পর একের পর এক শ্রমিক ও চাষি আন্দোলন গড়ে তোলার কাজে যুক্ত হন কমরেড অচিন্ত্য সিংহ। সেই সময় ফারাক্কা থেকে ফিডার ক্যানেল তৈরির কাজ করছিল তারাপুর কোম্পানি। সেখানে শ্রমিকদের ওপর মালিকি জুলুমের বিরুদ্ধে আন্দোলনে ঝাঁপিয়ে পড়েন তিনি। পালন করেন নেতৃত্বের ভূমিকা। জঙ্গিপুরে খাদ্য আন্দোলনে যোগ দিয়ে পুলিশের ঘেরাটোপে চলে গিয়েছিলেন একবার। আন্দোলনকারী ছাত্ররা তাঁকে পুলিশের হাত থেকে ছিনিয়ে আনে। রঘুনাথগঞ্জে ম্যাকেঞ্জি সাহেবের নামাঙ্কিত বিশাল এক মাঠে পূর্ববঙ্গ থেকে আসা উদ্বাস্তুদের বসবাসের ব্যবস্থা করেছিলেন তিনি। দুষ্কৃতীবাহিনী উঠেপড়ে লাগে সেই ‘ম্যাকেঞ্জি কলোনি’ উচ্ছেদ করতে। প্রতিরোধে ঝাঁপিয়ে পড়েন কমরেড অচিন্ত্য সিংহ। নেতৃত্ব দেন দীর্ঘস্থায়ী আন্দোলনে। বহরমপুর শহরে সেইসময়কার এক কুখ্যাত দুষ্কৃতী তথা রাজনৈতিক নেতার হুমকি ও সন্ত্রাসের মুখে দাঁড়িয়ে অসমসাহসী লড়াই করে কমরেড অচিন্ত্য সিংহ সংগঠিত করেন দর্জি শ্রমিকদের। মালিকি জুলুমের বিরুদ্ধে কমরেড সিংহের নেতৃত্বে আওয়াজ তোলে দর্জি শ্রমিক সংগঠন। তীব্র আন্দোলনের চাপে প্রশাসন নড়েচড়ে বসে। ত্রিপাক্ষিক বৈঠকে মালিকরা বাধ্য হয় শ্রমিকদের দাবি-দাওয়া মেনে নিতে। মালিকের অমানুষিক শশাষণের বিরুদ্ধে কমরেড অচিন্ত্য সিংহ সংগঠিত করেন বিড়ি শ্রমিকদের।
মুর্শিদাবাদে গড়ে ওঠে বিড়ি শ্রমিক আন্দোলন। বিড়ি শ্রমিকদের জন্য হাসপাতাল তৈরির দাবিতে শক্তিশালী আন্দোলন শুরু হয়। সরকার দাবি মেনে বহরমপুর শহরে হাসপাতাল গড়ার নির্দেশ দেয়। কমরেড অচিন্ত্য সিংহের নেতৃত্বে বিড়ি শ্রমিকরা দাবি তোলেন তাঁদের কর্মস্থল ঔরঙ্গাবাদেই হাসপাতাল তৈরি করতে হবে। তীব্র আন্দোলনের চাপে সেই দাবি আদায় হয়—ঔরঙ্গাবাদেই তৈরি হয় হাসপাতাল। সংগঠিত করেন মোটর শ্রমিকদের।জেলার মোটর শ্রমিক ইউনিয়নগুলির সমন্বয় কমিটি গঠনের উদ্যোগ নেন। ফারাক্কা ব্রিজ তৈরির জন্য হাজার হাজার একর ফসলি জমি জলমগ্ন হয়ে পড়েছিল, আটকে গিয়েছিল নদীপথ। এর বিরুদ্ধে গ্রামে গ্রামে ঘুরে অক্লান্ত পরিশ্রম করে কমরেড অচিন্ত্য সিংহ গড়ে তুলেছিলেন কয়েকশো গ্রাম কমিটি। সংগঠিত করেছিলেন উত্তাল গণআন্দোলন।পরবর্তী সময়ে জোতদারদের হাত থেকে ভাগচাষি ও ছোটচাষিদের রক্ষা করতে তিনি অসাধারণ সাহসের সঙ্গে নেতৃত্ব দিয়েছেন জেলার চাষি আন্দোলনগুলিতে। জেলার জঙ্গিপুর মহকুমায় তাঁর নেতৃত্বে সেই সময় একের পর এক উত্তাল চাষি-আন্দোলন গড়ে উঠেছিল। শহিদের মৃত্যু বরণ করেছিলেন আনসারুল আহসান ও সীতারাম মণ্ডল নামে বংশবাটি ও ধনপতনগর গ্রামের দুই কৃষক। দীর্ঘস্থায়ী ঐতিহাসিক সেই আন্দোলনে শেষপর্যন্ত পরাজিত হয় জোতদাররা। এছাড়াও মুর্শিদাবাদ জেলার ছোট-বড় অসংখ্য গণআন্দোলনের পাশাপাশি কমরেড অচিন্ত্য সিংহ বাসভাড়া প্রতিরোধে দীর্ঘস্থায়ী রক্তক্ষয়ী সংগ্রামে নেতৃত্ব দিয়েছেন। সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি রক্ষাতেও তাঁর ভূমিকা ছিল অত্যন্ত উল্লেখযোগ্য। কাটরা মসজিদ ভাঙার সময় তিনি পালন করেন এক ইতিহাসিক ভূমিকা।
দলের সংগঠন বিস্তার এবং শ্রমিক আন্দোলন গড়ে তুলতে তুলতেই জেলার লেখক-কবিদের নিয়ে কমরেড অচিন্ত্যসিংহ পত্তন করেন ঝড় গোষ্ঠীর। প্রকাশ শুরু হয় ‘ঝড়’পত্রিকার। ১৯৬৮ সালের ১১ জুন জঙ্গিপুর সদরঘাটে শ্রমমন্ত্রী কমরেড সুবোধ ব্যানার্জী ১০ পয়সা দিয়ে প্রথম সংখ্যাটি কিনে পত্রিকাটির উদ্বোধন করেন। প্রথম দুটি সংখ্যার সম্পাদক ছিলেন শিশির সাহা, প্রধান উদ্যোক্তা ছিলেন কমরেড অচিন্ত্য সিংহ। তার পর থেকে আমৃত্যু কমরেড সিংহই ছিলেন পত্রিকাটির সম্পাদক। শুরুর দিনটি থেকে আজ পর্যন্ত ঝড় পত্রিকা কায়েমীস্বার্থের বিরুদ্ধে আমজনতার স্বার্থরক্ষায় অক্লান্ত ভূমিকা নিয়ে চলেছে। এ প্রসঙ্গে তাঁর অনবদ্য লেখনীর কথা বলতে হয়। কাব্য ও সাহিত্যপ্রেমী এই মানুষটির সাহিত্য জগতে ছিল অবাধ বিচরণ। তার লেখায় ক্ষুরধার যুক্তির সঙ্গে মিশে থাকত শোষিত মেহনতি মানুষের জন্য অন্তরের দরদ।
শোষিত মানুষের মুক্তির লড়াইয়ে নিবেদিতপ্রাণ কমরেড অচিন্ত্য সিংহ ব্যক্তিগত জীবনের সুখ স্বাচ্ছন্দ্য, ভালো থাকা-মন্দ থাকার বিষয়ে ছিলেন অত্যন্ত উদাসীন। এ নিয়ে তাঁর কাছ থেকে কোনও অনুযোগ-অভিযোগ কখনও কেউ শোনেননি। তরুণ বয়সে শ্রমিক আন্দোলনে নেতৃত্ব দিতে দিতেই চোখে পড়ে গিয়েছিলেন এক কোম্পানি-মালিকের। তাঁর মেধা, দক্ষতা ও কর্মনিষ্ঠা দেখে মুগ্ধ মালিক বিরাট অঙ্কের বেতন দিয়ে কাজে যোগ দেওয়ার অনুরোধ করেন। দিতে চান গাড়িও। সেইসব প্রলোভন হেলায় জয় করে কমরেড অচিন্ত্য সিংহ সারা জীবন শ্রমিক কৃষক দলীয় কর্মী সাধারণ মানুষের মাঝে নিতান্ত সাধাসিধে জীবন কাটিয়েছেন হাসিমুখে। নিদারুণ দারিদ্র্যে বহুসময় অনাহারে অর্ধাহারে থেকেছেন স্ত্রী, পুত্র ও কন্যারা। কষ্ট পেয়েছেন, কিন্তু দলের কাজ ছেড়ে পরিবার প্রতিপালনের জন্য অর্থ রোজগারের পথে হাঁটেননি কমরেড অচিন্ত্য সিংহ।
মানুষ হিসেবে কমরেড অচিন্ত্য সিংহ ছিলেন অত্যন্ত উদার মনের। কোনও কারণে নেতৃত্বের কিংবা ছোট-বড় যে কোনও কমরেডের প্রবল সমালোচনার সামনে পড়লেও তার মুখের মিষ্টি হাসিটি মিলিয়ে যেতে দেখা যায়নি কখনও। তাঁদের কারও প্রতি বিরূপ মানসিকতা প্রকাশ, মনঃক্ষুন্ন হওয়া বা পাল্টা সমালোচনা করা— কোনও দিনই এ সব তাঁর কাছ থেকে পাওয়া যায়নি। অসাধারণ বাগ্মী ছিলেন। বাংলা ছাড়াও ইংরেজি এবং হিন্দিতে অত্যন্ত মনোগ্রাহী ভাষণ দেওয়ার দক্ষতা ছিল তাঁর আয়ত্তে। তিনি ছিলেন দলের কর্মী-সমর্থকদের নিতান্ত আপনজন। যে কেউ তাঁর কাছে গিয়ে মন খুলে কথা বলতে পারত, মুখের ওপরে বিনা বাধায় সমালোচনা করতে পারত তার। অক্লান্ত পরিশ্রমী এই মানুষটি সংগঠিত করেছিলেন সরকারি কর্মচারীদেরও। তাঁদের সংগঠন জেপিএ-র সর্বভারতীয় সভাপতি ছিলেন তিনি। এছাড়াও অঙ্গনওয়াড়ি কর্মী ও স্কিম ওয়ার্কারদের বিভিন্ন সংগঠনের নেতৃত্ব দিয়েছেন কমরেড অচিন্ত্য সিংহ। সংগঠিত করেছেন চা শ্রমিকদের। মৃত্যুর মাত্র কয়েকদিন আগেও জলপাইগুড়িতে গিয়েছিলেন চা-শ্রমিক সংগঠনের কাজে।
শারীরিকভাবে বিরাট এক প্রতিবন্ধকতা ছিল তাঁর ধীরে ধীরে দৃষ্টিশক্তি প্রায় সম্পূর্ণই হারিয়ে ফেলেছিলেন। কিন্তু কাজকর্ম বা চলাফেরায় সেই প্রতিবন্ধকতার এতটুকু ছাপ পড়তে দেননি আজীবন সংগ্রামী এই মানুষটি।
আমৃত্যু বিপ্লবী কমরেড অচিন্ত্য সিংহের প্রয়াণে দল হারালো একজন দক্ষ সংগঠক এবং উদার মন ও অসাধারণ চরিত্রের অধিকারী এক সংগ্রামী নেতাকে। দেশের মানুষ হারালো তাদের আন্দোলনগুলির নির্ভরযোগ্য এক পথপ্রদর্শককে।
কমরেড অচিন্ত্য সিংহ লাল সেলাম