‘‘এই যে এখানে বসে যাঁরা আছেন আমার কিছু সহকর্মী, তাঁরা অতীতের অনেক কথা জানেন। আমার নিজের অভিজ্ঞতা হল, প্রথম যখন এই দল শুরু হয়, কী ছিল আমাদের? কিছুই ছিল না। টাকা নেই, পয়সা নেই, লোকজন নেই, থাকার জায়গা নেই, কেউ চেনে না, জানে না। আর আমাদেরও বয়স বা তখন কত? আমি তখন কোয়াইট ইয়ংম্যান, অল্প বয়সের একটি যুবক। সে বলছে ভারতবর্ষে সত্যিকারের কোনও বিপ্লবী দল নেই, দল গঠন করতে হবে। অনেকেই যুক্তি-টুক্তি শুনে বলছে, হ্যাঁ, এটা তো করা উচিত, যুক্তিগুলো তো ভালই। কিন্তু এ একটা পাগলের মতো কথা। একটা দল করা কি সোজা কথা নাকি? এতগুলো বড় বড় দল রয়েছে, তারাই সব ঘায়েল হয়ে যাচ্ছে, ভেঙে যাচ্ছে, কত কী কাণ্ড হচ্ছে। আর যাদের কেউ চেনে না, জানে না, অভিজ্ঞতাসম্পন্ন লোক নেই, নাম করা নেতা নেই, প্রেস পাবলিসিটি নেই তারা কী করবে? কিছু বললেই লোকে ঠাট্টা করত, হাসত, বাঙাল ভাষায় বলতো–দেখ, বলা নাই, কওয়া নাই, কি সব পোলাপান হইছে আমাগো দ্যাসে, কি সব পাগল পোলা হইছে দেখো দিহি। এরা দল গঠন করবে! এ অসম্ভব ব্যাপার! এ হতে পারে না। পার্টি গড়া কি একটা সহজ কথা? এসব অবাস্তব কল্পনা, ও সব হবে না। হ্যাঁ আপনি যা বলছেন তা ঠিক, কিন্তু কিছু হবে না। আমিও সঙ্গে সঙ্গে বেশি তর্ক করিনি। আমি তাদের উত্তর করেছি পাল্টা। হ্যাঁ হবে না মেনে নিলাম।
তর্কের মধ্যে না গিয়ে একেবারে সোজা মেনে নিলাম, হ্যাঁ কিছু হবে না তো বুঝলাম, কিছু করতে পারব না। তাহলে, কী করতে হবে বলুন। গোলামি করব? দালালি করতে হবে? বিবেক বিক্রি করতে হবে? যা বুঝেছি তা না করে অন্যরকম আচরণ করতে হবে? আমি পারব না। আমার কথা ছিল, তোমরা যারা পারবে তারা আমার সঙ্গে থাকো, আর যারা পারবে না সরে পড়। বিকজ ইফ আই ডাই স্টার্ভিং ইন দ্য স্ট্রিট, আই স্যাল ডাই উইথ অনার রেইজিং মাই হেড হাই। আমি যেদিন রাস্তায় না খেয়ে মরব, সেদিনও আমি যেকোনও অন্যায়ের প্রতিবাদ করতে পারব। যে কোনও অন্যায়কারী মানুষের গালে দরকার হলে চড় বসিয়ে দিতে পারব, আমার হাত কাঁপবে না। কারণ আমাকে গুলি করে মারা যাবে, কিন্তু আমাকে কেনা যাবে না। হোয়াট এলস ক্যান আই ডু? আমি তো দালালি করতে পারব না। আমার এত সব বুঝেই তো বিপদ হয়ে গেছে। আমার ঠাকুরমার কোনই অসুবিধা ছিল না। আমার বাবারও কোনও অসুবিধা ছিল না, মারও অসুবিধা ছিল না। কারণ তারা ছেলে-মেয়ে, নাতি-পুতির বিয়ে দিয়েছে, ঘর সংসার করেছে, পুজোআচ্চা করেছে, কালীবাড়ি গিয়েছে, সেখানে বারবার মাথা ঠুকে প্রণাম করেছে, বাবা সর্বসময় ভাবছেন, এই বুঝি স্বর্গের রথ সুর সুর করে নেমে এল এবং তিনি স্বর্গে গিয়ে আমাদের জন্য বসে থাকবেন। এ তাঁর পক্ষে কত সুবিধে।
কিন্তু আমার পক্ষে অসম্ভব, কারণ আমি বুঝে ফেলেছি মানুষ কথাটার মানে কী! মানুষের মূল্যবোধ কী! সত্যিকারের মর্যাদা কী! আর এই দেশে জন্মগ্রহণ করার সাথে সাথে সেই মানুষ হিসাবে আমার কর্তব্য কী! আমি তো জেনেছি যে, ভারতবর্ষের এই সমাজটার পরিবর্তন না হলে আমরা কেউ বাঁচব না। আমি বাঁচব না, আমার বিবেক বাঁচবে না, নীতিনৈতিকতা বাঁচবে না, সংস্কৃতি বাঁচবে না, চরিত্র বাঁচবে না, কোনও কিছু বাঁচবে না। আমি যদি একটা সুখের সংসার গড়বার চেষ্টা করি সেই পরিবারের ভিতরেই দুষ্টশক্তি ঢুকে আমার স্নেহের সন্তানটিকে নষ্ট করে দেবে। সেটি কোনও ফিল্ম স্টারের চ্যালা হবে, নাকি ওয়াগন ব্রেকারের দলে নাম লেখাবে তার কোনও গ্যারান্টি নেই। সেটি কী করবে না করবে কেউ বলতে পারবে না। প্রাণ দিয়ে ভালবেসে যাকে গড়ে তুলবো সে বিট্রে করে চলে যাবে। সে পয়সার জন্য কোনও কিছু পরোয়া করবে না।
আজকের সমাজ এই জায়গায় এসে দাঁড়িয়েছে। এখান থেকে যদি ভালবাসাকে বাঁচাতে হয়, নীতিনৈতিকতাকে বাঁচাতে হয়, স্নেহপ্রীতিকে বাঁচাতে হয়, দায়িত্ববোধকে ও কর্তব্যবোধকে বাঁচাতে হয়, মানুষকে বড় করতে হয়, নিজেকেও যদি বড় হতে হয়, আমার স্নেহের পাত্রপাত্রীগুলিকে যদি বড় করে গড়ে তুলতে হয় তাদের রাস্তা খুলে দিতে হবে। আর লড়াই করা ছাড়া এর আর কোনও দ্বিতীয় রাস্তা নেই। এটা আমি বুঝে ফেলেছি। আমি কেন এরকম বুঝলাম তা নিয়ে রাগ করব কার ওপর? আমি কি নিজের চুল ছিঁড়ব যে এরকম বুঝলাম কেন? এ নিয়ে তো কারও সাথে আরগুমেন্ট করা যায় না যে, তুমি বোঝোনি, আমি বুঝলাম কেন? আর বুঝলাম বলেই তো আমার বিপদ হয়ে গিয়েছে। এখন আমার সামনে দুটি রাস্তা খোলা আছে। হয় নিজেকে অধঃপতিত করা, নিজের বিবেক বিক্রি করা; আর না হয়, লড়াই করা। এই লড়াইয়ে আমি জিতব কি হারব, সে ইতিহাস বলবে। কিন্তু আমি যা সত্য বলে মনে করি, ভারতবর্ষে নতুন করে একটা বিপ্লবী দল গড়ে উঠতে না পারলে মানুষের মুক্তি আসবে না, তা সে হাজার মানুষ কোরবানি করুক, লক্ষ লক্ষ ছেলে রক্ত ঢেলে দিক, সব বিপথে চলে যাবে। তাই যথার্থ বিপ্লবী দল চাই, যথার্থ আদর্শ চাই।” (‘বিপ্লবী জীবনই সর্বাপেক্ষা মর্যাদাময়‘ পুস্তক থেকে)