দুর্নীতি যেন আষ্টেপৃষ্ঠে ঘিরে ফেলেছে পশ্চিমবঙ্গের সরকারি ব্যবস্থাটাকে। যে কোনও দিকে তাকালেই দুর্নীতি আর দুর্নীতি। এর যেন কোনও শেষ নেই! একের পর এক নেতা মন্ত্রী এবং তাদের নানা সঙ্গী-সাথীর সম্পর্কে প্রতিদিন এবেলা ওবেলা বেরিয়ে পড়ছে বিভিন্ন প্রকার তথ্য। সিন্ডিকেট থেকে টেট পরীক্ষা, গরু পাচার থেকে স্কুলের শিক্ষক অথবা কেরানি নিয়োগ, কিংবা পঞ্চায়েতের নানা কাজ, সবকিছু নিয়েই জড়িয়ে যাচ্ছেন সরকারের বাঘা বাঘা পদাধিকারীরা। এর মধ্যে এখন সব কিছুছাপিয়ে রাজ্যে হইচই চলছে আবাস যোজনার কাজে দুর্নীতি নিয়ে। চলছে রাজনৈতিক চাপান উতোর। প্রকৃত চিত্র যাচাই করার নামে কেন্দ্রীয় সমীক্ষক দলও রাজ্যে এসে পড়েছে। আমাদের দেশে কেন্দ্র হোক আর রাজ্য হোক কোনও সরকারি সমীক্ষাই সরকারে ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক দলের অঙ্গুলিহেলন ছাড়া এক পা চলে না। ফলে স্বাভাবিকভাবেই আবাস যোজনা দেখাতে আসা কেন্দ্রীয় দলের নিরপেক্ষতা নিয়েও প্রশ্ন উঠছে। তারা যে বিজেপিকে আসন্ন পঞ্চায়েত নির্বাচনে কিছুটা অি’জেন দিতে তৎপর এটাও অনেক ক্ষেত্রে দেখা যাচ্ছে।
এমনিতেই আবাস যোজনায় বরাদ্দ মাত্র ১ লক্ষ ৩০ হাজার টাকা দিয়ে শৌচাগার সহ কোনও পাকা বাড়ি বানানো যে কতটা কঠিন তা ভুক্তভোগী মাত্রেই জানে। এটুকু বরাদ্দেও কোপ বসাতে তৎপর গ্রামে গ্রামে রাজ্যের শাসকদল তৃণমূলের নেতারা। প্রচুর হইচই উঠতে প্রকাশ্যে রাজ্য স্তরের তৃণমূল নেতারা দুর্নীতির বিরুদ্ধে মাঝে মাঝে হুমকি দিলেও এই দুর্নীতির দাগ তাঁদের গা থেকে সহজে মুছবে কী করে? অসংখ্য অযোগ্য ব্যক্তির নাম কী ভাবে এই সরকারি যোজনার তালিকায় ঢুকে গেল তার উত্তর তৃণমূল নেতাদের কাছ থেকে রাজ্যের মানুষ চাইবেই। পরিস্থিতি এমনই দাঁড়িয়েছে যে, দুর্নীতির দায় এড়াতে এবং যাদের নাম বাদ গেছে তাদের রোষের থেকে বাঁচতে তৃণমূলের পঞ্চায়েত সদস্যরা বহু জায়গায় দলবেঁধে পদত্যাগ করেছেন। ২০১৫ সালে পুরনো কেন্দ্রীয় সরকারের পরিচালিত ইন্দিরা আবাস যোজনার নাম পাল্টে প্রধানমন্ত্রীর নামে হয়। তারপর এই প্রথম কেন্দ্রীয় সরকার আবাস প্রাপকদের নাম যাচাই করতে বলেছে। এই প্রথম যাচাইতেই দেখা যাচ্ছে তালিকার ১৪ লক্ষ নাম বাদ গেছে। সংখ্যাটা মূল তালিকার এক চতুর্থাংশ। এর পরেও উঠে আসছে অসংখ্য ধনী প্রভাবশালীর নাম যারা এই আবাস যোজনার প্রাপক হিসাবে থেকেই গেছেন। এর থেকেও বড় সমস্যা হল দেখা যাচ্ছে প্রকৃত অর্থে প্রয়োজন যাঁদের, তেমন অসংখ্য মানুষের নাম বাদ পড়েছে। কিন্তু কেন্দ্রীয় নীতি অনুযায়ী এই স্তরে সরকারি অফিসারদের হাতে নাম বাদ দেওয়ার ক্ষমতা থাকলেও নাম যুক্ত করার কোনও ক্ষমতা দেওয়া হয়নি। ফলে বহু দরিদ্র গৃহহীন পরিবার এর থেকে বঞ্চিতই থেকে যাচ্ছেন। এর মধ্যে আবার কেন্দ্রীয় সরকার গ্রামে গ্রামে প্রকৃত যাচাইয়ের থেকে বেশি জোর দিয়েছে উপগ্রহ যোগাযোগ নির্ভর ‘জিও ট্যাগিং’ ইত্যাদি প্রযুক্তির ওপর। তার ফলে আরও বেশি করে দরিদ্র মানুষরা সরকারি সুবিধা থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন। কারণ এই সব প্রযুক্তি তাদের নাগালের অনেক বাইরে। বহু ক্ষেত্রেই নিজের কোনও বাড়ি না থাকা দরিদ্র মানুষ নানা কারণে নিজের প্রকৃত পরিস্থিতি প্রযুক্তির সাহায্যে নথিভুক্ত করতে অপারগ। অথচ ক্ষমতার বৃত্তের কাছাকাছি থাকা অনেকেই সহজে এই প্রমাণ হাজির করে দিচ্ছে যোগ্যতা না থাকা সত্তে্বও। কেন্দ্রীয় সরকার প্রকৃত পরিস্থিতির বদলে প্রযুক্তিকে বেশি গুরুত্ব দেওয়ার ফলে দুর্নীতিবাজদের কোনও অসুবিধা হয়নি। মোদি সরকারের বহুল প্রচলিত ‘ডিজিটাল ইন্ডিয়া’-র এটাই প্রকৃত চিত্র। যে প্রযুক্তি তৈরিই ক্ষমতাশালীদের জন্য, তার সুযোগ দরিদ্র মানুষ নেবেন কী করে? এ ছাড়াও প্রশ্ন উঠছে, আবাস যোজনার নামগুলি যাচাই করার কথা কেন্দ্রীয় সরকারের এত দেরিতে মনে পড়ল কেন? পঞ্চায়েত নির্বাচনের আগে বিজেপিকে একটু জায়গা করে দিতেই নাকি! অন্যদিকে রাজ্য সরকারও প্রকৃত প্রাপকদের নাম তালিকা থেকে বাদ দেওয়ার দায় নিজের ঘাড় থেকে ঝেড়ে ফেলতে ব্যস্ত। আবাস যোজনা থেকে শুরু করে সমস্ত সরকারি সুবিধা পেতে গেলে শাসকদলের প্রতি আনুগত্য এবং কাটমানির জোগান দিতে পারার জোরটাই যে প্রধান যোগ্যতা, তা আজ পরিষ্কার।
এই দুর্নীতির পচা গন্ধ ঢাকতে খোদ রাজ্য সরকার সম্পূর্ণ বেআইনি এবং অন্যায় ভাবে এর তালিকা যাচাইয়ের দায় চাপিয়ে দিয়েছে আশা ও আইসিডিএস কর্মীদের উপর। অথচ এই কর্মীদের একমাত্র দায়িত্ব মা ও শিশুর স্বাস্থ্য বিষয়ক পরিষেবা দেওয়া। বহু জায়গায় আশা, আইসিডিএস কর্মীরা সরকারি রক্তচক্ষু উপেক্ষা করে এই অন্যায় সরকারি অর্ডার প্রত্যাখ্যান করেছেন। অবাস যোজনার তালিকা যাচাই করতে গিয়ে যাদ যাওয়া লোকেদের রোষের মুখে পড়ছেন এই কর্মীরা। নানা জায়গায় তাঁদের হেনস্তা করা হয়েছে। বহু জায়গায় তাঁদের ঘরবাড়ি তছনছ, চাষাবাদ নষ্ট করে দিচ্ছে গ্রামের কায়েমি স্বার্থবাদীরা। গ্রামে পঞ্চায়েতে দুর্নীতিচক্র জানে সরাসরি সরকারি মদত রয়েছে তাদের পক্ষে। তাই তারা বেপরোয়া। এমনকি পঞ্চায়েত অফিসে দপ্তর খুলে টাকা ঘুষ নিচ্ছে রীতিমতো রসিদ দিয়ে। সংবাদপত্রে প্রকাশ পেয়েছে, পূর্ব মেদিনীপুরের ভগবানপুর দু’নম্বর ব্লকের তৃণমূল পরিচালিত গড়বাড়ি-২ পঞ্চায়েতের প্রধান টাকা নেওয়ার কথা প্রকাশ্যে স্বীকার করে নিয়েছেন।
এই ধরনের ঘটনা চারিদিকে প্রকাশ্যে এসে যাওয়ার পর মুখ রক্ষার জন্য কিছু পৌরসভার চেয়ারম্যান, শাসকদলের ব্লক সভাপতি কিংবা পঞ্চায়েত প্রধানকে পদত্যাগ করার জন্য নেতারা জনসভা থেকে ফতোয়া দিচ্ছেন। এটাই নাকি দুর্নীতির বিরুদ্ধে ‘জিরো টলারেন্স’ নীতি! দুর্নীতির ফলে সাধারণ মানুষের মধ্যে ক্ষোভ বিপুল হারে বাড়ার ফলে তাতে একটু প্রলেপ দিতে ঘোষণা করা হয়েছে ‘দিদির রক্ষাকবচ’ নামে কর্মসূচি।
এই কবচ বেঁধে নাকি সাধারণ মানুষ দুর্নীতির হাত থেকে বাঁচবেন! কিন্তু কবচ বাঁধবে কে? আর পঞ্চায়েত থেকে শুরু করে একেবারে মন্ত্রিসভার অন্দর পর্যন্ত দুর্নীতির অভিযোগ এতটাই বিস্তৃত যে ‘শিরে সর্পাঘাত’ হওয়ার দশা, কবচ বাঁধার জায়াগাই তো নেই! মুখ রক্ষার জন্য মুখ্যমন্ত্রীকে নজরুল মঞ্চে নেতাকর্মীদের সভা ডেকে প্রকাশ্যে বলতে হচ্ছে– দুর্নীতিবাজদের ঘাড় ধাক্কা দিয়ে বের করে দেব, দলের পোকা সমূলে বিনাশ করব, ইত্যাদি ইত্যাদি। যেখানে পুরোটাই দুর্নীতিতে পচে ঘা হয়ে গেছে সেখানে এসব মলম লাগিয়ে কি এই রোগ সারানো যাবে?
এই সীমাহীন দুর্নীতি কোনও আকস্মিক ব্যাপার নয়। এর কারণ নিহিত রয়েছে আজকের পুঁজিবাদী সমাজের অভ্যন্তরে। বর্তমানে বিশ্বজুড়ে পুঁজিবাদী সাম্রাজ্যবাদী অর্থনীতি চূড়ান্ত সংকটের মধ্যে নিমজ্জিত। এই অবস্থায় বাঁচবার জন্য বৃহৎ একচেটিয়া ব্যবসায়ীরা একে অপরের বাজার দখলের জন্য সর্বদাই আস্তিনের মধ্যে ছুরি সানিয়ে মুখোমুখি দাঁড়িয়ে আছে। কোনও নৈতিকতার বালাই নেই। এই পুঁজিপতিদের রাজনৈতিক ম্যানেজার হিসাবে কাজ করা সরকারি ক্ষমতাভোগী রাজনৈতিক দলগুলি পুঁজিপতি শ্রেণির আশীর্বাদ পেতে মরিয়া প্রতিযোগিতায় নেমেছে। তারাও আজ নীতিহীনতার চরম শিখরে। এই অনৈতিকতা, স্বার্থপরতা, লোলুপতা পুঁজিপতি শ্রেণির সেবাদাস দলগুলির মধ্যে একেবারে রন্ধ্রে রন্ধ্রে বিস্তার ঘটিয়েছে তাদের নেতারাই। দেখা যাচ্ছে এদের মধ্যে যারাই ক্ষমতার স্বাদ পেয়েছে তারাই দুর্নীতির কাজে পিছিয়ে নেই। এই আবাস যোজনার দুর্নীতির শুরু পশ্চিমবঙ্গে সিপিএম শাসনের সময়েই। সেই সময় বিডিও অফিসে, পঞ্চায়েতে স্বজনপোষণ-দুর্নীতি যে ব্যাপক রূপ নিয়েছিল, তা আজও মানুষ ভোলেনি। কংগ্রেস আমলেই শুরু স্কুলের এবং সরকারি চাকরি নিয়ে দুর্নীতি।
অপরদিকে কেন্দ্রের ক্ষমতাশীল বিজেপি সরকার লক্ষ লক্ষ কোটি টাকা দুর্নীতির পথে পাইয়ে দিয়ে নীরব মোদি কিংবা প্রধানমন্ত্রীর স্নেহের ‘মেহুল ভাই’দের কী ভাবে রক্ষা করে চলেছে, এই কথা তো সকলেরই জানা। ‘ব্যাপম কেলেঙ্কারি’তে বিপুল পরিমাণ অর্থের লেনদেনকে ক্ষমতার জোরে আজ তারা চাপা দিয়ে রেখেছে। কেউ কোথাও কোনও অন্যায়ের প্রতিবাদে মুখ খুললেই সন্ত্রাস সৃষ্টি করে, খুনখারাবি করে, জেলে ভরে তাকে দমন করছে। বাস্তবে ক্ষমতালিপ্সু সকল দলগুলির নেতারা আজ কার্যত নিজেদের দলকে সমাজবিরোধীদের আখড়ায় পরিণত করেছে এই হীন স্বার্থে।
কেবল তাই নয়, সমাজের সর্বস্তরে যাতে নৈতিক মূল্যবোধ ধ্বংস করে দেওয়া যায় সে জন্য তারা আজ বেপরোয়া। ইতিহাসের এই শিক্ষা তারা জানে যে, কোনও অন্যায়, কোনও শোষণ-জুলুম টিকে থাকতে পারে না যদি একটা সমাজ উন্নত মূল্যবোধ ও নৈতিকতার ভিত্তিতে মাথা তুলে দাঁড়ায়। তাই এই সকল দুর্নীতি ও অপকর্মকে ব্যাপক রূপ দিয়ে গা সওয়া করিয়ে নিতেও এরা সকলেই সচেষ্ট। যে যখন ক্ষমতায় থাকে অন্য পক্ষ তখন তার ভ্রষ্টাচার নিয়ে চিল-চিৎকার করে। সাধারণ মানুষের যন্ত্রণাকাতর মানসিকতাকে ব্যবহার করে ক্ষমতায় যাওয়ার সিঁড়ি হিাসবে। সমাজ সচেতন বিবেকবান যে কোনও মানুষকে তাই আজ ভাবতে হবে এই পঙ্কিল পরিস্থিতি থেকে গা বাঁচিয়ে চলার বাস্তবে কোন পথ খোলা নেই। এর বিরুদ্ধে প্রতিরোধের শক্তিকে সর্বতোভাবে দুর্বার করে গড়ে তোলার জন্য আগুয়ান হতে হবে সকলকে।