নতুন বছরের প্রথমে আবার উত্তাল হয়ে উঠেছে টিউনিশিয়া৷ রাজপথে ঢল নেমেছে বিক্ষুব্ধ জনতার৷ দাবি উঠেছে– এখনই বেকার যুবকদের কাজের ব্যবস্থা করতে হবে, বাতিল করতে হবে জনস্বার্থবিরোধী বাজেট৷ বিক্ষোভ চলে থানা, সুপারমার্কেট, কর দপ্তর, পৌরসভার মতো নানা সরকারি দপ্তরের সামনে৷ রেল অবরোধ করা হয়৷ আন্দোলনকারীদের ঠেকাতে ঝাঁপিয়ে পড়ে পুলিশ ও সেনাবাহিনী৷ কাঁদানে গ্যাস ও লাঠির মুখে রুখে দাঁড়ায় মানুষ৷ গ্রেপ্তার হয় আটশোরও বেশি আন্দোলনকারী৷
এই সেই টিউনিশিয়া৷ স্বৈরাচারী শাসনমুক্ত হয়ে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার দাবিতে ২০১১ সালে উত্তর আফ্রিকার এই দেশটিতেই শুরু হয়েছিল গণভ্যুত্থান– ‘আরব বসন্ত’৷ প্রশাসনের জুলুমের প্রতিবাদে এক ফলবিক্রেতা যুবক মহম্মদ বুয়াজিজির আত্মহত্যার ঘটনা পুঁজিবাদী শোষণে জর্জরিত টিউনিশিয়ার মানুষের বুকে জমে থাকা ক্ষোভের বারুদে আগুন ধরিয়ে দিয়েছিল৷ সেই আগুনের আঁচ ছুঁয়েছিল আফ্রিকা ও মধ্যপ্রাচ্যের নানা দেশকে৷ উত্তাল হয়ে উঠেছিল আন্দোলনের ঢেউ৷ সর্বত্রই অত্যাচারী শাসকদের ক্ষমতাচ্যুত করার স্লোগান উঠেছিল৷
আন্দোলনের চাপে ক্ষমতা থেকে সরতে হয়েছিল ২৩ বছর ধরে শাসনক্ষমতা আঁকড়ে থাকা টিউনিশিয়ার প্রেসিডেন্ট জিনে আল আবেদিন বেন আলিকে৷ কিন্তু শাসক বদল হলেও বদল ঘটেনি সে দেশের শাসন ব্যবস্থায়৷ নির্বাচনের মাধ্যমে সরকার কায়েম হলেও পুঁজিবাদী ব্যবস্থার সঙ্গে অঙ্গাঙ্গীভাবে জড়িত দারিদ্র, বেকারি, দুর্দশার হাত থেকে সামান্যতম রেহাইও মেলেনি টিউনিশিয়ার সাধারণ মানুষের৷ ঠিক যেমন আমাদের দেশেও একের পর এক সরকার বদল হয়, কিন্তু দুরবস্থার বদল হয় না জনতার৷ নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসের চড়া দামে টিউনিশিয়ার খেটে–খাওয়া গরিব–মধ্যবিত্ত মানুষের জীবন জেরবার৷ বেকারির হার অত্যন্ত চড়া৷ সরকারি হিসাবেই স্নাতক ডিগ্রিধারী তরুণ–যুবকদের ৩০ শতাংশ বেকার৷ বাস্তব পরিস্থিতি যে আরও মারাত্মক, তা বুঝতে অসুবিধা হয় না৷ নতুন সরকার সাম্রাজ্যবাদী আর্থিক সংস্থা আইএমএফ–এর থেকে দেদার টাকা ধার করেছে৷ শর্ত হিসাবে মেনে নিয়েছে ব্যয়সঙ্কোচের কঠিন ফরমান৷ ছকে বাঁধা পথে হেঁটে সে ফরমানের বোঝা তারা চাপিয়েছে দেশের গরিব–মধ্যবিত্ত মানুষের ঘাড়ে৷ ব্যয় সংকোচন করতে টিউনিশিয়ার পুঁজিবাদী সরকার সমাজকল্যাণমূলক কর্মসূচিগুলিতে দেদার ছাঁটাই করে বাড়িয়েছে নিত্যপণ্যের উপর করের হার৷ ২০১৮–র প্রথম দিনেই নতুন বাজেটে সরকার করের হার বাড়িয়ে খাদ্যপণ্য সহ অন্যান্য অতিপ্রয়োজনীয় জিনিসের দাম ব্যাপক বাড়ানোর কথা ঘোষণা করেছে৷
করবৃদ্ধির ঘোষণা শুনেই ফুঁসে উঠেছে টিউনিশিয়ার জনতা৷ সাথে যুক্ত হয়েছে কর্মসংস্থান বাড়ানোর দাবি৷ রাজধানী টিউনিস থেকে বিক্ষোভ ছড়িয়েছে অন্যান্য শহরেও৷ প্রেসিডেন্ট বেন আলি পদচ্যুত হওয়ার পর সরকারে বসেছিল যে ইসলামি এন্নাহাদা দল, যারা বর্তমান সরকারেরও শরিক, এই বিক্ষোভে তাদের বিশেষ ভূমিকা নিতে দেখা যায়নি৷ অথচ ২০১১ সালে স্বৈরতন্ত্র হঠাবার আন্দোলনে এরা সক্রিয় ভূমিকা নিয়েছিল৷ ঠিক যেমন আমাদের দেশেও গণআন্দোলনের মধ্য দিয়ে জনপ্রিয়তা অর্জন করে সরকারে বসা দলগুলিকে ক্ষমতা পেয়ে যাওয়ার পরেই লড়াই–আন্দোলনের উপর খড়গহস্ত হয়ে উঠতে দেখা যায় টিউনিশিয়ার শ্রমিক সংগঠনগুলির প্রধান জোট– ‘টিউনিশিয়ান জেনারেল লেবার ইউনিয়ন’–কেও অত্যন্ত সতর্কভাবে পা ফেলতে দেখা যাচ্ছে৷ অর্থাৎ ক্ষমতাসীন সরকারের বিরুদ্ধে সরব হওয়ার ইচ্ছা তাদেরও বিশেষ নেই৷ বর্তমান আন্দোলন গড়ে তুলতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নিয়েছে বামপন্থী ও আরব জাতীয়তাবাদী তরুণ যুবকদের একটি গোষ্ঠী, যেটির নামের অর্থ ‘কীসের অপেক্ষা?’৷ পুলিশি হামলা ও ধরপাকড় হলেও আন্দোলনের চাপে সরকার খানিকটা মাথা নত করতে বাধ্য হয়েছে৷ বেকারদের জন্য বিনামূল্যে চিকিৎসার ব্যবস্থা, পেনশনের পরিমাণ বৃদ্ধি, দরিদ্র পরিবারগুলিকে আর্থিক সহায়তা ও সস্তায় গৃহনির্মাণের জন্য অর্থভাণ্ডার গড়ে তোলার প্রতিশ্রুতি দিয়েছে সরকার৷ যদিও আন্দোলনের মূল দাবি মেনে নতুন বাজেট বাতিল করা সম্ভব নয় বলে জানিয়ে দিয়েছে সরকার৷
দেশে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করে দিন বদলের আশায় টিউনিশিয়ায় আজ থেকে সাত বছর আগে শুরু হয়েছিল যে মরণপণ আন্দোলন, আপাতদৃষ্টিতে সেই আন্দোলনের জয় হলেও সুদিন ফেরেনি সাধারণ মানুষের৷ পুঁজিবাদী একটি সরকারকে সরিয়ে পুঁজিপতি শ্রেণিরই স্বার্থবাহী জনস্বার্থবিরোধী আরেকটি সরকার ক্ষমতায় বসেছে৷ পুঁজিবাদী শোষণ–জুলুমে অতিষ্ঠ আশাহত মানুষ পেটের টানে আবারও সমবেত হয়েছে আন্দোলনের ময়দানে৷ কিন্তু শোষণমূলক পুঁজিবাদী ব্যবস্থাটাকেই উচ্ছেদ করতে না পারলে এবারেও যে তাদের আশা পূরণ হবে না, তা বলাই বাহুল্য৷ তার জন্য প্রয়োজন সঠিক নীতি আর সঠিক নেতৃত্বে লাগাতার ও সংগঠিত ঐক্যবদ্ধ আন্দোলন৷ টিউনিশিয়ার সংগ্রামী জনগণকে অভিনন্দন জানানোর পাশাপাশি আশা করা যায়, আন্দোলনের আগুনে পুড়ে সে দেশের মানুষ নিশ্চয় এ সত্য উপলব্ধি করতে পারবে৷