অর্থনীতির অভূতপূর্ব উন্নতির লম্বাচওড়া প্রতিশ্রুতি বিলিয়ে ক্ষমতায় বসেছিলেন নরেন্দ্র মোদি, গদিতে বসার পরও তাঁর প্রচারের ঢাক থামেনি৷ নোট বাতিলের মতো ‘জনমোহিনী’ সিদ্ধান্ত এবং জিএসটি–র মাহাত্ম্য কীর্তন করার পরও যখন অর্থনীতিতে টালমাটাল চলছে, তখনও সরকারি নেতাদের আর্থিক উন্নয়নের বুলিতে কান পাতা দায়৷ গুজরাতের নির্বাচনী প্রচারেও ঢক্কানিনাদ অব্যাহত ছিল৷ অর্থনীতির দ্রুতগতি টের পাচ্ছে না দেশের একশো তিরিশ কোটি সাধারণ মানুষ৷ টের পাচ্ছেন শুধু বিজেপির নেতা–মন্ত্রীরা, যেমন এতদিন টের পেতেন শুধু কংগ্রেসের নেতা–মন্ত্রীরা৷ মূল্যবৃদ্ধি হচ্ছে চড়চড় করে (গত ১৫ মাসে সর্বাধিক নভেম্বরে– ৫ শতাংশ), শিল্পোৎপাদনের হার কম, সরকারের রাজকোষ ঘাটতি বেড়েই চলেছে৷ তা সত্ত্বেও নির্বাচনের আগে ‘সুদিন এল ওই’ বলে সরকারের ঢাক পেটানো চলছেই৷
কিন্তু বিজেপির মতো দলগুলির সাধারণ মানুষকে দেওয়ার জন্য যে শুধু ধোঁকাই পুঁজি, তা আবারও দিনের আলোর মতো পরিষ্কার হল৷ দেশের জনসাধারণ যখন মূল্যবৃদ্ধির বোঝায় চরম দুর্দশাগ্রস্ত, ক্ষতির মুখে পড়ে কৃষকরা আত্মহত্যা করছে, কৃষিঋণ শুধতে না পেরে পরিবার নিয়ে পথে বসছে, তখন সেই ভারতেই কর্পোরেটদের বিপুল পরিমাণ ঋণ মকুব করছে রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাঙ্কগুলির বকলমে বিজেপি সরকার৷ চলতি আর্থিকবর্ষে প্রথম ছ’মাসেই তারা ৫৫ হাজার ৩৫৬ কোটি টাকার ঋণ মকুব করে দিয়েছে, এক বছরে তা ১ লক্ষ কোটি টাকা ছাড়িয়ে যাবে বলে অনুমান৷ এর বেশিরভাগই অনাদায়ী ঋণ৷ বড় পুঁজিপতি, কর্পোরেট মালিকরা ব্যাঙ্ক থেকে ঋণ নিয়ে ফেরত দেয়নি৷ সংসদে দেওয়া সরকারি হিসাব অনুযায়ী, ১১ লক্ষ কোটি টাকার বেশি প্রাপ্য ব্যাঙ্কগুলির৷ কিন্তু ব্যাঙ্ক কর্তৃপক্ষের সাহস হয়নি কর্পোরেট মালিকদের গায়ে হাত দেওয়ার, উল্টে সরকারি মদতে তাদের কেউ কেউ বিদেশে পালিয়ে গিয়েছেন৷ বিজেপি সাংসদ ও লিকার ব্যারন বিজয় মালিয়া নয় হাজার কোটি টাকার ঋণ খেলাপ করে বিদেশে আত্মগোপন করেছেন৷ তাঁকে পালিয়ে যেতে সাহায্য করেছেন বিজেপি নেত্রী সুষমা স্বরাজ সহ দলের অন্য নেতারা৷
ভারতের মতো পুঁজিবাদী–সাম্রাজ্যবাদী দেশে কোটিপতিদের শত শত হাজার হাজার কোটি টাকার ঋণ মকুব হচ্ছে, আর গরিব চাষি কয়েক হাজার টাকা কৃষিঋণ শোধ দিতে না পেরে আত্মহত্যা করতে বাধ্য হচ্ছে৷ কারণ তাদের ঋণ মকুব করা দূরের কথা, পুলিশ গ্রেপ্তার করে জেলে ভরছে৷ বিশ্বজোড়া পুঁজিবাদী দুনিয়ার একই চিত্র৷ সাম্রাজ্যবাদের শিরোমণি আমেরিকাতে সম্প্রতি নয়া কর সংস্কার বিল পাশ হয়েছে একই উদ্দেশ্যে– কর্পোরেট মালিকদের স্বার্থ পূরণ৷ বিলে বেসরকারি সংস্থাগুলিকে বিপুল ছাড় দেওয়া হয়েছে৷ কর্পোরেট ট্যাক্স এক ধাক্কায় কমে গেছে ৩৫ থেকে ২০ শতাংশ৷ এখানেও বাজেট ঘাটতি বেড়ে যাওয়ার আশঙ্কা সত্ত্বেও ট্রাম্প প্রশাসন পিছপা হয়নি৷ তারা জানে, বাজেট ঘাটতি জনসাধারণের উপর নানা ট্যাক্স চাপিয়ে তুলে নেওয়া যাবে, কিন্তু কর্পোরেটদের সন্তুষ্ট রাখতে হবে৷ তারাই তো রাষ্ট্রের প্রকৃত মালিক৷
এভাবেই প্রতিটি পুঁজিবাদী দেশে খেটে খাওয়া মানুষকে আরও বেশি দুর্দশার দিকে ঠেলে দিয়ে পুঁজিমালিকদের তোষণ করার নীতি নিয়ে চলেছে সরকারগুলি৷ এই অবস্থায় ‘দেশ এগোচ্ছে’ বলে ঢাক পেটানো সত্যকে আড়াল করার সরকারি অপচেষ্টা ছাড়া আর কিছু নয়৷