‘আপনাদের কোনও বইয়ের চার লাইন যে একবার পড়েছে, সে ভুলতে পারবে না’

কলকাতা

শারদীয় বুকস্টলে বলে গেলেন এক জন

ষষ্ঠীর সন্ধ্যে। উৎসবমুখী জনস্রোতের মধ্যে থেকে একজন এগিয়ে এলেন বড়বাজারে এসইউসিআই(কমিউনিস্ট)-এর বুকস্টলের সামনে। উচ্ছ্বাস ঝরে পড়ল তাঁর গলায়, ‘এই তো এসইউসিআই-এর স্টল। প্রতি বছর পুজোর সময় আপনাদের বই কেনা একরকম অভ্যাসে দাঁড়িয়ে গেছে।’ নতুন কী কী বই বেরিয়েছে খোঁজ নিয়ে সেগুলি কিনলেন। যাওয়ার আগে নিজের নাম, ফোন নম্বর দিয়ে বলে গেলেন, ‘এই উৎসবের মাঝেও আপনারা যেভাবে সারাদিন ধরে মানুষকে বুঝিয়ে রাজনৈতিক বইপত্র দেওয়ার চেষ্টা করেন, দিস ইজ এ জেনুইন স্ট্রাগল। কিপ ইট আপ।’

শারদোৎসবের জাঁকজমকের মধ্যে দলের কর্মীদের এই ‘জেনুইন স্ট্রাগল’ই মানুষের নজর কেড়েছে সর্বত্র। প্রতি বছরই এই সময়টিতে রাজ্য জুড়ে দলের আদর্শগত প্রচারের উপর জোর দেওয়া হয়। কর্মীরা পথচলতি মানুষকে দাঁড় করিয়ে বই কিনতে বলেন। বহু মানুষ নিজেরাই স্টলে এসে বই নিয়ে যান।

ঊনিশ-কুড়ির কলেজ পড়ুয়াদের একটা দল দাঁড়িয়েছিল শ্যামবাজার স্টলের সামনে। দলের এক কর্মী তাঁদের বই দেখতে অনুরোধ করলেন। ‘আসলে এখন তো মণ্ডপ দেখতে বেরিয়েছি, পরে নেব’ বলে এগিয়ে গেল প্রায় সকলেই। ওরই মধ্যে একটি মেয়ে দাঁড়িয়ে গেল। স্টলের বইগুলো নাড়াচাড়া করার পর তুলে নিল মার্কসবাদী চিন্তানায়ক শিবদাস ঘোষের ‘শরৎচন্দ্রের চিন্তা ও সাহিত্য’। একটি ছেলে খানিকটা ইয়ার্কির ঢং এ বলল, ‘তুই সত্যিই কিনবি নাকি বইটা?’ মেয়েটি হেসে বলল, ‘হ্যাঁ, শরৎচন্দ্র খুব ভালো লাগে।’ হুগলির পাণ্ডুয়া স্টেশনের স্টল থেকে, সাধারণ সম্পাদক কমরেড প্রভাস ঘোষের লেখা ‘ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরঃ একটি মূল্যায়ন’ বইটি নিয়েছিলেন একজন। বইটি পড়ে তিনি জানিয়েছেন, এ ধরনের মনীষী চর্চার উদ্যোগের সাথে যুক্ত হতে চান তিনি, কোনও সভা বা অনুষ্ঠান হলে যেন তাঁকে খবর দেওয়া হয়। ভাগলপুর নিবাসী একজন বড়বাজারের স্টলে এসে উর্দু ভাষায় প্রকাশিত সবগুলো বই সংগ্রহ করে নাম ঠিকানা দিয়ে গেলেন। কলকাতার এসপ্ল্যানেডে দলের কিশোর সংগঠন ‘কমসোমল’-এর সদস্যরা স্টল করে। সেই স্টল থেকে একটি বই কিনলেন এক মহিলা। বললেন, ‘ছোট ছোট ছেলেমেয়েরা পুজোর দিনে হাতে মনীষীদের বই নিয়ে রাস্তায় দাঁড়িয়ে আছে, এ জিনিস একমাত্র তোমাদের দলেই সম্ভব। তবে ঠিকই করছ তোমরা, ওদের মানুষ করতে হলে এই শিক্ষা ছোট বয়স থেকেই দিতে হবে।’

বর্ধমান শহর

দলের রাজনীতি, মতাদর্শ জানার, বিভিন্ন বিষয়ে দলের বক্তব্য শোনার একটা আলাদা আগ্রহ প্রায় সর্বত্রই চোখে পড়েছে এবার। সংসদীয় দলগুলোর নির্লজ্জ মিথ্যাচার, ক্ষমতার লোভ, নীতিহীনতা দেখে দেখে জনগণ ক্লান্ত, হতাশ, রাজনীতিবিমুখ। কিন্তু এটাই একমাত্র চিত্র নয়। এর মধ্যেও কিছু লোক বরাবরই থাকেন যাঁরা পথ খোঁজেন। সমাজের নানা সমস্যা তাঁদের ভাবায়। মুক্তি কোন পথে অনুসন্ধানের দিকে ঠেলে। তাঁদেরই অনেককে দেখা গেল এবারের স্টলে। বেছে বেছে রাজনৈতিক বই, মার্কসবাদের আলোচনা, বিশ্লেষণ নিয়ে গেছেন তাঁরা স্টল থেকে।

পুজোর দিনগুলোয় সকালে বাড়ি বাড়িও বই নিয়ে যান দলের কর্মীরা। এমনই কিছু জন গিয়েছিলেন উত্তরবঙ্গের সুশ্রুতনগরের একটি বস্তিতে। রাজ্যের অসংখ্য বস্তির মতোই উৎসবের রোশনাই সেখানে ঢাকতে পারেনি মানুষগুলোর অভাব, ক্লেদাক্ত জীবনের অন্ধকার। কর্মীদের হাতে বই দেখে ঝগড়া থেমে গেল এমনই এক একচিলতে ঘরে। পরিবারের একজন বললেন, বই যে দেখছ, বই কেনার পয়সা আছে তোমার? মানুষটি একটা বই তুলে নিয়ে বললেন, ‘বিদ্যাসাগরের বই কেনার জন্য পয়সা আছে।’ উত্তরবঙ্গেরই একটি স্টলে এক বিএসএফ জওয়ান বাইক থামিয়ে স্টলে এলেন। ‘সব শাসকই দুর্নীতিগ্রস্ত কেন’ এবং ‘কেন ভারতবর্ষের মাটিতে এসইউসিআই (কমিউনিস্ট) একমাত্র সাম্যবাদী দল’ বই দুটো কিনে ব্যাগে ভরে নিলেন। হেসে বললেন, ‘লুকিয়ে লুকিয়ে পড়ব।’ বিভিন্ন স্টলে ‘চিনের সাস্কৃতিক বিপ্লব’, ‘মার্কসবাদ ও মানবসমাজের বিকাশ প্রসঙ্গে’র মতো বই নিয়ে গেছেন কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রছাত্রীরা। উত্তরবঙ্গ মেডিকেল কলেজের এক অধ্যাপক দলের ছাত্রকর্মীদের সাথে ছবি তুলে বন্ধুদের পাঠালেন হোয়াটসঅ্যাপে। বলে গেলেন, ‘তোমাদের মতো ছাত্র-যুবকরাই সমাজে নতুন প্রাণ সঞ্চার করতে পারে, তোমরাই পারবে।’ দক্ষিণ চব্বিশ পরগণার লোকাল ট্রেনে বই বিক্রি করছিলেন কর্মীরা। স্থানীয় কলেজের এক অধ্যাপক প্রাথমিকে ইংরেজি চালুর দাবিতে দলের আন্দোলনের উচ্ছ্বসিত প্রশংসা করে বই নিলেন। কর্মীদের ডেকে দাঁড় করালেন স্থানীয় হাসপাতালের এক ডাক্তার। বললেন, ‘কই, আমায় বই দিলে না?’

বড়বাজার স্টলের কাছে ট্যাক্সির গতি একটু কমিয়ে পঞ্চাশ টাকা বাড়িয়ে ধরলেন এক ট্যাক্সি ড্রাইভার। বলে গেলেন, এটা স্টল খরচের জন্য রাখুন কমরেড। বুদ্ধিজীবী থেকে শ্রমজীবী মানুষ প্রান্তিক মানুষ এভাবেই জীবনের অভিজ্ঞতা দিয়ে চিনে নিচ্ছেন এই দলের সংগ্রামী রাজনীতিকে, বেকারি-মূল্যবৃদ্ধির মতো জীবনের জ্বলন্ত সমস্যাগুলোর উত্তর খুঁজছেন এস ইউ সি আই (কমিউনিস্ট) দলের বইপত্রে।

বাঁকুড়ার সোনামুখীতে একজন নিজের দোকান বন্ধ রেখে তার বারান্দায় স্টল করতে দিয়েছেন, পাঁচদিন ধরে স্টলের সব কর্মীদের তিন বেলার খাওয়ার ব্যবস্থা করেছেন। এক তাঁতশিল্পী স্টল থেকে ‘বিপ্লবী জীবনই সর্বাপেক্ষা মর্যাদাময়’ সহ বেশ কয়েকটি বই কিনে বললেন, হাজার কাজের মধ্যেও নিজে এবং অন্যদের নিয়ে গণদাবী পড়ি। প্রতিবার পুজোর সময় স্টল থেকে বই কিনি। দক্ষিণ কলকাতার হরিনাভিতে পুজো কমিটির এক সদস্য স্টলে এসে বললেন, পরের বার থেকে আপনাদের স্টলের জন্য বিদ্যুতের ব্যবস্থা আমরাই করে দেব। আদর্শহীনতার মরুভূমিতে এসইউসিআই(কমিউনিস্ট) দলের কর্মীদের আচরণ, রুচি-সংস্কৃতি, নিষ্ঠা এভাবেই মরূদ্যানের মতো টেনেছে মানুষকে। শুধু বই নিয়েই নয়, কোথাও কর্মীদের খাওয়ার ব্যবস্থা করে কোথাও স্টলে বিদ্যুৎ সংযোগের ব্যবস্থা করে দিয়ে বা স্টল চালানোর জন্য অর্থসাহায্য করে সর্বতোভাবে পাশে থাকতে চেয়েছেন মানুষ, তাঁদের এই ভালোবাসা শ্রদ্ধা প্রেরণা জুগিয়েছে দলের কর্মীদের।

এক পরিচিত বামপন্থী কর্মী এগিয়ে এলেন কলকাতার হাতিবাগান স্টলে। বইপত্র দেখার পর একটু চুপ করে থেকে বললেন, যাদের ওপর ভরসা করে ভাল কিছু করব বলে রাজনীতিতে এসেছিলাম, তারা বেশিরভাগই পাল্টে গেছে। এবার একটু অন্য ভাবে ভাবতে হচ্ছে। বেছে বেছে বেশ কিছু বই নিয়ে গেলেন। এমনই আরেকজনকে বই দেখতে অনুরোধ করায় তিনি বললেন, আমিও সারা দিন স্টলে ছিলাম। কিন্তু আমাদের তো গল্প করেই দিন কেটে গেল। আপনারা যেভাবে পরিশ্রম করে, মানুষকে বুঝিয়ে বই দিচ্ছেন, একটা বামপন্থী দলের এমনটাই করা উচিত। আমার দলে অনেক বলেছি, কিন্তু ওরা আর এসব করবে না। তারপর ‘কমরেড শিবদাস ঘোষের গণআন্দোলনে বিপ্লবী নেতৃত্ব কেন চাই’, ‘সোসাল ডেমোক্রেসিকে পরাস্ত করেই বিপ্লবী দলকে এগোতে হয়’, ‘যুক্তফ্রন্ট রাজনীতি ও আমাদের কর্তব্য’ সহ বেশ কিছু বই নিয়ে ফোন নম্বর দিয়ে গেলেন।

উত্তরবঙ্গে নকশালবাড়ির বুক স্টলে এসে বই নিয়ে একজন বললেন, নেতাজির দল ভেবে ফরোয়ার্ড ব্লকে ছিলাম, পরে কিছুদিন সিপিএম করেছি। এখন আর কোনও দলের সাথেই নেই। নিজের নাম ঠিকানা দিয়ে গেলেন। দক্ষিণ চব্বিশ পরগণায় এক জায়গায় স্টলের পাশে অন্য একটি বামপন্থী দলের স্টলে বসা এক কর্মী এসইউসিআই(সি) দলের স্টলে এসে বইপত্র দেখলেন অনেকক্ষণ, বেশ কিছু বই নিলেন। এক প্রাক্তন বাম যুব কর্মী কমরেড শিবদাস ঘোষ এর রচনাবলি, কমরেড প্রভাস ঘোষ এর লেখা বেশ কিছু বই নিয়ে বললেন, ‘আমাদের দল তো এখন মিলিটান্ট আন্দোলন থেকে সরে গেছে। আপনারা আন্দোলনে আছেন, প্রয়োজনে যোগাযোগ করবেন।’ এরকম অভিজ্ঞতা হয়েছে কলকাতা সহ গোটা রাজ্যের বহু স্টলেই। এমনই প্রাক্তন শাসক দলের কর্মী, ছাত্র, সমর্থক, বাম মনোভাবাপন্ন মানুষ স্টলে এসে বই নিয়েছেন। অর্থাৎ আজও যাঁরা বামপন্থার প্রতি যথার্থই শ্রদ্ধাশীল, সিপিএম সহ অন্যান্য দলের ভোটসর্বস্ব রাজনীতিকে যাঁরা অন্তর থেকে মেনে নিতে পারছেন না, সেই মানুষগুলো আকৃষ্ট হচ্ছেন এসইউসিআই(কমিউনিস্ট) দলের প্রতি, একমাত্র আশার আলো দেখতে পাচ্ছেন এখানেই। মেদিনীপুরের মদনচকে স্থানীয় এক ব্যক্তি দলের কর্মীদের বললেন, আপনাদের কোনও বইয়ের চার লাইন যে একবার পড়েছে, সে ভুলতে পারবে না। একই সুর শোনা গেল কলকাতার একটি স্টলেও। একজন বই নিয়ে বললেন, আপনাদের বই একবার পড়লে বারবার খুঁজতে হয়। প্রচলিত অর্থে লোক টানার মতো একটি বইও থাকে না এই দলের স্টলে, অথচ এত মানুষ আসেন আকৃষ্ট হন কীসের টানে? আসলে, বইগুলোর মধ্যে রাজনীতির তত্ত্বের বাইরেও যে মানবিক মূল্যবোধ ও উন্নত নৈতিকতার সন্ধান মানুষ পান, তা গভীর ছাপ রেখে যায় সংবেদনশীল মনে।

এসইউসিআই(কমিউনিস্ট)-এর প্রতিষ্ঠাতা এ যুগের অন্যতম শ্রেষ্ঠ মার্কসবাদী চিন্তানায়ক শিবদাস ঘোষ বলেছিলেন, ‘মনে রাখবেন, মার্কসবাদ-লেনিনবাদই হোক, আর যে কোনও আদর্শবাদই হোক, শুধু কতকগুলো কথার মধ্যে কোনও আদর্শের মর্মবস্তু নিহিত থাকে না। যে কোনও আদর্শের আসল পরিচয় বা মর্মবস্তু নিহিত থাকে তার সংস্কৃতিগত, নীতিগত এবং রুচিগত মানের মধ্যে। … তাই মার্কস থেকে শুরু করে লেনিন, স্ট্যালিন, মাও সে-তুঙ পর্যন্ত বা যাঁরাই হাতেকলমে বিপ্লব করেছেন, সকলেই একটা কথার উপর জোর দিয়েছেন, তা হচ্ছে, কোনও আদর্শ বড় হলেই তাকে বাস্তবে রূপায়িত করা যায় না, যদি সেই আদর্শকে রূপায়িত করবে যে মানুষগুলো তারা সেই আদর্শকে রূপায়িত করবার মতো বড় মানুষ এবং উন্নত চরিত্রের না হয়।’ এই উন্নত রুচি-সংস্কৃতির আধারে গড়ে ওঠা বিপ্লবী রাজনীতিই এসইউসিআই(কমিউনিস্ট)-এর মূল শক্তি, যা অনিবার্যভাবে মানুষের শ্রদ্ধা ভালোবাসা আদায় করে নেয়। চারপাশের অবক্ষয় এবং অনিশ্চয়তার মাঝে এই দলের বুক স্টল এত প্রাণবন্ত হয়ে ওঠে এই বিপ্লবী রাজনীতির উষ্ণ স্পর্শেই। দলের বইগুলো হয়ে ওঠে সংগ্রামী মানুষের প্রেরণা, সমাজ পরিবর্তনের লড়াইয়ের রসদ।

ত্রিপুরা