সর্বনাশা তিন কৃষি আইন ও বিদ্যুৎ আইন সংশোধনী বাতিলের দাবিতে সংযুক্ত কিসান মোর্চার ডাকা ২৭ সেপ্টেম্বরের ভারত বনধ সফল করতে সর্বশক্তি নিয়ে প্রচারে নেমেছিল এস ইউ সি আই (কমিউনিস্ট) এবং কৃষক-খেতমজুর সংগঠন এআইকেকেএমএস। অন্য রাজ্যগুলির মতো পশ্চিমবঙ্গেও সমস্ত জেলাতেই বনধ ঘোষিত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে দলের কর্মীরা মাইক প্রচার, প্রচারপত্র বিলি, পথসভা, পাড়া মিটিং, মিছিল প্রভৃতি কর্মসূচি নিয়ে রাস্তায় নামেন। উত্তর থেকে দক্ষিণ, পূর্ব থেকে পশ্চিম– রাজ্যের সর্বত্রই জনসাধারণ ব্যাপক উৎসাহে বনধ সমর্থনে এগিয়ে আসেন। যেভাবে তাঁরা বনধের আহ্বানে সাড়া দিয়েছেন তা কর্মীদের কাছে প্রেরণার উৎস হয়ে থাকবে। কয়েকটি ঘটনা উল্লেখ করা হল।
ঝাড়গ্রাম জেলার নানা প্রান্তে প্রচারে গেলে গ্রামের সাধারণ মানুষ ও চাষিরা কর্মীদের কাছে বনধের দাবিগুলি সম্পর্কে ভাল করে জানতে-বুঝতে চেয়েছেন। কর্মীরা গ্রামে গ্রামে ছোট ছোট সভা করে নয়া কৃষি আইনের সর্বনাশা দিকগুলি সহজ ভাষায় তুলে ধরেছেন তাঁদের কাছে। মানুষ বুঝেছেন বনধের প্রয়োজনীয়তা। বলেছেন, একমাত্র এস ইউ সি আই (সি) ছাড়া আর কোনও দল চাষিদের পক্ষে এভাবে কাজ করছে না। আন্দোলন পরিচালনার জন্য তাঁরা যথাসাধ্য অর্থসাহায্য করেছেন। লালগড় ব্লকের বেলাটিকরিতে প্রচারের সময় কর্মীদের বক্তব্য শুনে চাষিরা একজোট হয়ে এলাকায় মিছিল করার দাবি জানান। একমাত্র তাঁদের সাহায্যেই সেটা সম্ভব বলে জানানোয় তাঁরা তখনই গ্রামবাসীদের জড়ো করে মিছিল শুরু করেন। বনধের দিন তাঁরাই পিকেটিং করেন। ওই এলাকা সহ জেলা জুড়ে সর্বাত্মক বনধ হয়।
উত্তর ২৪ পরগণা জেলায় বনধের প্রচারে ব্যাপক সাড়া পড়েছিল। বনধের প্রচারে দলের কর্মীরা এলাকায় এলাকায় গেলে সর্বত্রই মানুষ বলেছেন, আপনারা ছাড়া আর কাউকেই তো দেখছি না! অন্য একটি বামপন্থী দলের কর্মীরা এগিয়ে এসে বনধের প্রচারপত্র চেয়ে নিয়ে গেছেন, নিজেদের এলাকায় বিলি করবেন বলে। জানিয়েছেন, খাদ্যশস্য সহ চাষি-মজুরের জীবন-জীবিকা পুজিপতিদের গ্রাসে ঠেলে দেওয়ার বিজেপি সরকারের অপচেষ্টার বিরুদ্ধে এস ইউ সি আই (সি)-র এই লড়াইয়ে তাঁরা সঙ্গে থাকবেন। বনধের প্রচারপর্বে শুধু সন্দেশখালি এলাকাতেই অন্য বাম দলের সাত কর্মী দলের সঙ্গে যুক্ত হয়েছেন। আন্দোলন এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার জন্য এই জেলার মানুষ মুক্তহস্তে দলীয় তহবিলে অর্থসাহায্য করেছেন। বনধের দিন মাইলের পর মাইল রাস্তা পার হয়ে গ্রাম-গ্রামান্তর থেকে ছুটে এসেছেন মানুষ বসিরহাট শহরে, মিছিলে সামিল হতে। জেলায় এদিন বনধ হয়েছিল সর্বাত্মক।
মালদহ জেলার প্রত্যন্ত এলাকায়, যেখানে সংগঠনের বিস্তার এখনও বিশেষ হয়নি, সেখানে প্রচার করতে গেলে দলের কর্মীদের সাগ্রহে গ্রহণ করেন মানুষ। প্রচারপত্র চেয়ে নেন পাড়ায় বিলি করার জন্য। চলন্ত অটোরিক্সায় মাইক বেঁধে বনধের প্রচার চলার সময় পিছন থেকে চিৎকার করে গাড়ি থামিয়ে কর্মীদের হাতে টাকা তুলে দিয়ে গেছেন অনেকে। প্রচারপত্র চেয়ে নিয়েছেন, অর্থসাহায্য করেছেন। বলেছেন, আপনাদের লড়াই সফল হোক।
বাঁকুড়ার কলেজ মোড়ে প্রতিদিন সকাল থেকে কাজের আশায় বসে থাকেন যে দিনমজুররা, দলের কর্মীদের বক্তব্য থেকে সর্বনাশা কৃষি আইনের বিপদ বুঝে নিয়ে তাঁরা সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন, বনধ পালন করবেন। কাজ খুঁজতে তো নয়ই, এমনকি কাজ থাকলেও ২৭ সেপ্টেম্বর আসবেন না তাঁরা। গোটা জেলা জুড়েই বনধের প্রচার কর্মসূচির প্রতি খেটে-খাওয়া সাধারণ মানুষের প্রবল আগ্রহ ছিল চোখে পড়ার মতো। প্রবল রোদ উপেক্ষা করে পথসভাগুলিতে ভিড় করে দাঁড়িয়ে মানুষ শুনেছেন বিজেপি সরকারের মানুষ-মারা নীতির কথা। স্বতঃস্ফূর্ত হয়ে এগিয়ে এসে কর্মীদের কাছ থেকে প্রচারপত্র চেয়ে নিয়ে গেছেন নিজেরা বিলি করবেন বলে। এই জেলার এক বিশিষ্ট চিকিৎসক কলকাতার একটি সরকারি হাসপাতালে কর্মরত। কাজের সূত্রে নিয়মিত বাঁকুড়া-কলকাতা-পুরুলিয়া যাতায়াত করেন। বনধ সফল হওয়ার পর এক কর্মীকে ডেকে বলেছেন, ‘‘পূর্ব থেকে পশ্চিম আসা-যাওয়া করি নিয়মিত। সর্বত্রই দেখেছি শুধু আপনাদের কর্মীরাই রয়েছেন আন্দোলনের ময়দানে। দেশের কৃষকরা এক অসাধারণ সংগ্রাম চালাচ্ছেন দিল্লি সীমান্তে, আর এখানে দেখছি সেই ন্যায্য দাবির পক্ষে দাঁড়িয়ে আপনারাও অদম্য প্রয়াস চালিয়ে যাচ্ছেন। তাই বনধ এমন সর্বাত্মক হয়েছে। সবার হৃদয় জয় করেছেন আপনারা।”