বজবজের মানুষের দাবিটা ছিল খুব সামান্য– করোনা লকডাউনের সময় থেকে বন্ধ হয়ে থাaকা রেলগেটটি খুলে দেওয়া, আর ভিড় এড়িয়ে সুষ্ঠুভাবে যাতায়াতের জন্য পর্যাপ্ত সংখ্যক ট্রেন চালানো। এইটুকু দাবিতেও কর্ণপাত করার দরকার মনে করেনি কি সরকার কি রেল কর্তৃপক্ষ। আর তথাকথিত বড় বড় দলগুলির সাংসদ, বিধায়ক সহ তাবড় সব নেতারা, যাঁরা এখন ভোটের বাজারে জাঁকজমকের প্রতিযোগিতায় নেমেছেন, তাঁরা? না, জনজীবনের দাবি তুলে ধরার দায় তাঁদের নেই। তাঁরা ভাবেন ভোটের আগে কিছু পাইয়ে দেওয়ার প্রতিশ্রুতি আর কিছু টাকার বান্ডিল ছুঁড়লেই যখন ভোট হয়ে যায়, মানুষকে অধিকার আদায়ের পথ তাঁরা দেখাতে যাবেন কেন? সেই কোনকালে রমাপদ চৌধুরীর কলমে ফুটে উঠেছিল মানুষের মর্যাদাবোধ কেড়ে নেওয়ার জন্য শাসকের চক্রান্তের ছবি। সেখানে শুধু ক’টা সিদ্ধ ডিম ছুঁড়ে দিয়ে মাথা উঁচু করে বেঁচে থাকা আদিবাসী গ্রামকে ‘ভিখারি’তে পরিণত করেছিল ব্রিটিশ ও মার্কিন সেনারা। এ কালের ভোটবাজ নেতাদের দেখলে গল্পকার হয়ত মানুষের মর্যাদা হরণের এক নতুন কথা জানতেন!
এর ঠিক বিপরীতে মর্যাদা নিয়ে মানুষকে মাথা উঁচু করে বেঁচে থাকার পথ দেখানোর রাজনীতির ধারাটা নিয়ে এসেছে মার্কসবাদী চিন্তানায়ক শিবদাস ঘোষের হাতে গড়া দল এস ইউ সি আই (কমিউনিস্ট)। তাই বজবজের মানুষের এই দাবি নিয়ে এলাকার অটোচালক, দোকানদার, রেলযাত্রী, জুটমিল শ্রমিক, তেল কোম্পানির শ্রমিক সকলকে যুক্ত করে গণকমিটি গড়ে তুলে আন্দোলনের উদ্যোগ নিয়েছিল এই দল। অধিকার আদায়ের সেই কথাই শোনা গেল ১৯ মার্চ বজবজ স্টেশনে বসে থাকা এক তরুণীর মুখে। প্রচার চলছিল বজবজ কেন্দে্রর এস ইউ সি আই (সি) প্রার্থী উত্তম পাল এবং সাতগাছিয়া কেন্দ্রের প্রার্থী সেখ রবিয়ালের সমর্থনে। প্রচারে যাওয়া স্বেচ্ছাসেবকদের দেখিয়ে বেঞ্চে বসে থাকা চার-পাঁচজন সঙ্গীর উদ্দেশে কী যেন বলছিলেন ওই তরুণী। একজন কর্মী এগিয়ে গিয়ে লিফলেট দিতেই বললেন, ‘ওদের বলছিলাম, এই দলটার জন্যই রেলগেটটা খুলেছে, ট্রেনও অনেকগুলো বেড়েছে’। দলের এক বর্ষীয়ান সংগঠক কিন্তু কৃতিত্বটা দিলেন সেই তরুণীকেই আর এলাকার শত শত সাধারণ মানুষ, অটোচালক দোকানদার, শ্রমিক, রেলযাত্রীদের। বললেন, ‘আপনারা যদি গণকমিটিতে এগিয়ে না আসতেন, নিজের অধিকার বুঝে নেওয়ার ডাকে সাড়া না দিতেন, শুধু আমাদের কিছু দলীয় কর্মীর পক্ষে আন্দোলনটা এগিয়ে নিয়ে যাওয়া সম্ভব হত কি’? অনুরোধ করলেন, ‘সকলকে বলবেন, ভোটটাকেও এই অধিকার আদায়ের আন্দোলনের মতো করেই যেন দেখেন তাঁরা। আন্দোলন ছাড়া রেলগেটও খোলে না, জীবনের চলার পথও কেউ খুলে দেয় না’। উজ্জ্বল চোখে একটু হেসে তরুণীটি বলে গেলেন, আন্দোলনের এই শক্তির পাশেই থাকবেন তিনি। বজবজের এক মধ্যবয়সী পুরনো বামপন্থী কর্মী লিফলেট চেয়ে নিলেন। তাঁর আক্ষেপ, আমাদের দলটা ভোটের স্বার্থে যে জায়গায় নামল, ভাবতেও লজ্জা হয়। আপনাদের দেখলে বুকে বল পাই। নিজের নাম ফোন নম্বর দিয়ে বলে গেলেন, স্ক্রুটিনি হয়ে গেলেই চিহ্নটা জানাবেন, ভোটটা আপনাদেরই প্রাপ্য।
স্টেশনের আশেপাশের বাড়িতে মানুষের নানা ক্ষোভের কথা শুনে এসে অন্যদের তা বলছিলেন দলের দুই কর্মী। এগিয়ে এলেন এক জুট মিলের শ্রমিক। ‘২৫ বছর সিপিএম করেছি। আজ নেতারা কংগ্রেস আর আব্বাসের হাত ধরেছেন!’ পকেট থেকে বার করলেন ৫০ টাকার একটা নোট, বললেন, ‘এটা রাখুন। লড়াইয়ে আমার এই সাহায্যটুকু রইল। পারলে আরও দিতাম’। বারবার অনুরোধ করে গেলেন তাঁর বাড়িতে যেতে, অন্যদের সাথে পরিচয় করিয়ে দেবেন।
বজবজের শিল্পাঞ্চলের শ্রমিকদের সমস্যা, বিস্তীর্ণ এলাকার চাষিদের সেচের সমস্যা, চড়িয়াল খাল সংস্কার না হওয়ার সমস্যা নিয়ে আন্দোলন গড়ে তুলেছে এস ইউ সি আই (সি)। একই সাথে রায়পুরের টালি শ্রমিকদের দাবি, মৎস্যজীবীদের সমস্যা, জলপ্রকল্পের ড্রেনেজের জলে চাষের জমিতে দূষণের সমস্যা এগুলি নিয়ে নানা সময় আন্দোলন গড়ে তুলেছে দল। এলাকায় শিক্ষা আন্দোলনের সামনের সারিতে থেকেছেন দলের প্রার্থী সহ স্থানীয় নেতৃবৃন্দ। আবার সিপিএম আমলের মতোই তৃণমূল আমলেও সন্ত্রাসের রাজনীতির বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়িয়েছে এই দলই। সব মিলিয়ে সারা পশ্চিমবঙ্গের মতোই বজবজ, সাতগাছিয়া এলাকায় আন্দোলনের প্রতীকে পরিণত হয়েছে এস ইউ সি আই (সি)। ভোটের সময়েও উঠে আসছে সেই আন্দোলনের কথা। নির্বাচনকেও আন্দোলনের পরিপূরক হিসাবে দেখার সংগ্রামী লাইনই তুলে ধরছে এসইউসিআই(সি)