সম্প্রতি মিছিলে পুলিশের লাঠিচার্জ এবং বামপন্থী যুবকর্মী মইদুল ইসলাম মিদ্যার মৃত্যু জনমানসে বহু প্রশ্ন তুলেছে। মানুষ জানতে চায়, পুলিশের জন্য আদৌ কি কোনও আইন আছে? কোনও মিছিলকে ছত্রভঙ্গ করার নামে পুলিশ কি যথেচ্ছ আচরণ করতে পারে? পুলিশের মারে আবার একজন নিরপরাধ তরতাজা যুবক প্রাণ হারানোর পরেও কি শাস্তি হবে দোষী পুলিশদের? এই জীবনহানির ঘটনা থেকে শিক্ষা নিয়ে এরপর থেকে কি পুলিশ আইন ও মানবতাসম্মত আচরণ করবে? মিথ্যা মামলায় রাজনৈতিক কর্মীদের ফাঁসানোর চেষ্টা বন্ধ করবে? গ্রেপ্তারের পর রাজনৈতিক বন্দিদের উপর অত্যাচারের ট্রাডিশন বন্ধ করবে? আন্দোলন মোকাবিলায় পুলিশের ভূমিকা নিয়ে এই সঙ্গত প্রশ্নগুলি বছরের পর বছর ধরে উঠলেও উত্তর মেলেনি। সরকারের রাজনৈতিক রঙ বদল হয়েছে, কিন্তু উত্তরটা অধরাই থেকে গেছে। পুলিশ বা সরকার, কারও কাছ থেকেই আচরণ পরিবর্তনের কোনও আশ্বাস পাওয়া যায়নি।
এক সময় গণতান্ত্রিক আন্দোলনের চাপে পুলিশ কোডে লেখা হয়েছিল মিছিলকারীদের উপর বলপ্রয়োগ যদি করতেও হয়, সে ক্ষেত্রে পুলিশ প্রথমে গ্রেপ্তার করবে, না হলে খালি হাতেই ঠেলে সরিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করবে। না পারলে যথাযথ কর্তৃপক্ষের নির্দেশ নিয়ে যদি আঘাত করতেই হয়, তবে তা পায়ের নিচের অংশে করতে হবে। আঘাত যাতে কোনও মতেই জীবনঘাতী না হয় তা নিিচত করতে হবে, ইত্যাদি। পরবর্তীকালে প্রাণঘাতী বুলেটের পরিবর্তে রাবার বুলেট, জলকামান ইত্যাদি ব্যবহারের কথা এসেছে।
গণতন্ত্রের মুখোশ বজায় রাখতে পুলিশের আচরণবিধিতে লেখা হয়েছে অনেক কথাই, কিন্তু তা মেনে চলতে পুলিশকে বাধ্য করবে কে? সরকার তো? এর জন্য শাসকদের যে জনমুখী দৃষ্টিভঙ্গি থাকা প্রয়োজন তা এ দেশে কেন্দ্র কিংবা রাজ্যে ক্ষমতাসীন কোনও সরকারের আছে কি? আন্দোলনকারীরা মাটিতে পড়ে যাবার পরেও একাধিক পুলিশ কর্মী মিলে পেটানোর ঘটনা যেন ‘স্বাভাবিক’ হয়ে উঠেছে। মুখে গালাগালির বন্যা বইয়ে পুলিশকর্মীরা যে নৃশংস ভঙ্গিতে আন্দোলনকারীদের দিকে তেড়ে যায়, তা দেখে কোনও দুষ্কৃতীবাহিনীর থেকে তাদের আলাদা করা মুশকিল। মহিলা আন্দোলনকারীদের মহিলা পুলিশ দিয়েই গ্রেপ্তার করার রীতি বহুদিনই পুলিশ প্রায় তুলে দিয়েছে। আন্দোলনকারীদের মাথা, চোখ বারবার পুলিশের মারের লক্ষ্য হয়ে উঠছে। পুলিশের মারে মিছিলকারীদের চোখ নষ্ট হওয়ার ঘটনা বারবার ঘটছে। ২০১৫ সালের ৫ ফেব্রুয়ারি এস ইউ সি আই (সি) দলের ডাকে আইন অমান্যে তৃণমূল সরকারের পুলিশের লাঠিতে ছাত্র সংগঠনের কর্মী উত্তম পাড়ুইয়ের চোখ পুরোপুরি নষ্ট হয়ে যায়, রমাকান্ত সরকারের চোখেও গুরুতর আঘাত লাগে। পুলিশ কিংবা রাজ্য সরকার তাদের চিকিৎসার দায়িত্ব নেওয়া দূরে থাক, এতটুকু দুঃখপ্রকাশও করেনি।
দুঃখের বিষয় হল, যে সিপিএম দলের যুবকর্মী আজ আন্দোলনে এসে নিহত হলেন, তাদের সরকারের আমলে পুলিশের আচরণ এর থেকে ভাল কিছু ছিল না। ১৯৮৩ সালের বাসভাড়া বৃদ্ধি প্রতিরোধ আন্দোলনে, ১৯৯০ সালের বাসভাড়া ও দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধির বিরুদ্ধে আন্দোলনে সিপিএম সরকারের পুলিশ কলকাতা এবং পুরুলিয়াতে গুলি চালিয়ে হত্যা করেছে। ১৯৮৩ সালে কলকাতার মানিকতলায় বাসভাড়া বৃদ্ধি আন্দোলনে এলাকার যুবক দুলাল দাস পুলিশের গুলি লেগে মাটিতে পড়ে যাওয়ার পর তাঁর দেহে লাথি মেরে রাস্তা দিয়ে হেঁচড়ে নিয়ে গিয়ে ভ্যানে তুলেছিল পুলিশ। পুরুলিয়ার রঘুনাথপুরে শুধু মিছিলে নয়, আশেপাশের মানুষ এবং এস ইউ সি আই (সি) অফিস লক্ষ্য করে গুলি চালিয়েছে পুলিশ। সেখানে শহিদ হয়েছিলেনএলাকার শ্রমজীবী মানুষ কমরেড হাবুল রজক ও শোভারাম মোদক। ১৯৯০ সালের ৩১ আগস্ট, ঐতিহাসিক খাদ্য আন্দোলনের শহিদ দিবসে কলকাতার রানি রাসমণি রোডে ৩২ জনকে গুলিবিদ্ধ করেছিল সিপিএম সরকারের পুলিশ। শহিদ হয়েছিলেন ১৮ বছরের তরুণ মাধাই হালদার। পুলিশের বিরুদ্ধে কোনও শাস্তিমূলক ব্যবস্থার কথা দূরে থাকুক, সেদিনের মুখ্যমন্ত্রী জ্যোতি বসু বিদ্রুপ করে বলেছিলেন, ‘নিরামিষ আন্দোলনকে একটু আমিষ করে দেওয়া হল’।
রাজনৈতিক বিরোধিতার বদলে আন্দোলনকারীদের বিরুদ্ধে মিথ্যা মামলা দেওয়াটাই পুলিশের ট্র্যাডিশন। সিপিএম সরকারের আমলে ইংরেজি ফিরিয়ে আনার দাবিতে মিছিল থেকে গ্রেপ্তার করে চাঁদপাল ঘাট থেকে অস্ত্র সমেত ধরা হয়েছে বলে মিথ্যা মামলা দিয়েছে পুলিশ।প্রকাশ্য রাজপথে এস ইউ সি আই (সি)-র মহিলা কর্মীদের পোশাক টেনে খুলে উল্লাস করেছিলেন যে মহিলা পুলিশ অফিসার, তাঁর শাস্তি দূরে থাক, সিপিএম আমলে তাঁর প্রভূত উন্নতি হয়েছে। আজ তৃণমূল আমলেও এই সব অফিসাররা পুলিশের বড় বড় পদ আলো করে আছেন।
গণআন্দোলনে অংশ নেওয়া, মিছিল করার অধিকার আজও অন্তত খাতায় কলমে ভারতে কেড়ে নেওয়া হয়নি। কিন্তু যে কোনও আন্দোলনের উপরই নানা ধরনের নিষেধাজ্ঞা চাপানোটাই আজ কেন্দে্র-রাজ্যে ক্ষমতাসীন সব দলের সরকারের কাছে স্বাভাবিক হয়ে উঠেছে। কলকাতা শহরেই প্রতিবাদের পরিধিকে ক্রমাগত ছোট বৃত্তে নিয়ে আসার চেষ্টা শুরু করেছিল সিপিএম। তৃণমূল আমলে সে গণ্ডিকে আরও আঁট করে বাঁধা হচ্ছে। বিজেপি শাসিত উত্তরপ্রদেশে প্রতিবাদী মানুষদের উপর লক্ষ লক্ষ টাকা জরিমানা চাপিয়েছে পুলিশ। মিথ্যা মামলায় জেল খাটিয়েছে মানবদরদী ডাক্তার কাফিল খান সহ অসংখ্য প্রতিবাদী মানুষকে। কৃষক আন্দোলন দমনে দিল্লি এবং হরিয়ানা সরকারের পুলিশ কী ন্যক্কারজনক ভূমিকা নিয়েছে তা সারা দেশ দেখেছে।
নানা সময়ে সরকারি গদির বৃত্তে ঘোরা বুর্জোয়া, পেটি-বুর্জোয়া দলগুলি যখন বিরোধী আসনে থাকে, দেশের মানুষের দুঃখ, অভাব, দারিদ্রকে ঘিরে ফেনিয়ে ওঠা ক্ষোভ-বিক্ষোভকে তারা কাজে লাগাতে চায় পরের ভোটে জেতবার আশায়। তখন কিছু কিছু আন্দোলন তারা করে। কিন্তু সরকারে গেলেই তারা আন্দোলনের উপর দমন পীড়ন চালাতে থাকে। তারা তখন আইন-শৃঙ্খলা রক্ষার দোহাই পাড়ে। এর মাধ্যমে তারা প্রচলিত শোষণমূলক রাষ্ট্রব্যবস্থার আসল মালিক একচেটিয়া পুঁজিপতিদের সেবক হিসাবে সরকারের দায় বহন করে। দেশের জনসাধারণ তাদের জীবন-জীবিকা রক্ষার প্রয়োজন থেকে গণআন্দোলনকে যে ভাবে দেখে, কোনও ভোটবাজ দল সেভাবে দেখে না। বুর্জোয়া অর্থেও যতটুকু গণতান্ত্রিক ঠাটবাট এখনও টিকে আছে, শাসক বুর্জোয়া শ্রেণি সেটুকুকেও গলা টিপে মারতে চায়। তাই যে কোনও রাজ্যেই আন্দোলনের উপর পুলিশকে ঝাঁপিয়ে পড়তে নির্দেশ দিচ্ছে সরকারগুলি। বামপন্থী বলে পরিচিত বৃহৎ দলগুলির সরকারে থাকার সময়কার ভূমিকা এবং বর্তমানের বামপন্থী আন্দোলনের দুর্বলতা এ সবের আরও সুযোগ করে দিচ্ছে।
১৯৬৭ এবং ‘৬৯ সালে যুক্তফ্রন্ট সরকারের মধ্যে থেকেই এস ইউ সি আই (সি) দাবি তুলেছিল ন্যায়সঙ্গত গণআন্দোলনে পুলিশ হস্তক্ষেপ করবে না। কিন্তু সিপিএম-সিপিআই সেদিন এই দাবি মানতে চায়নি। এর সুযোগ নিয়েছে পরবর্তী শাসক কংগ্রেস। এই সিপিএম ১৯৭৭-এ পিচমবঙ্গে ক্ষমতায় বসার পর গণআন্দোলনের উপর কীভাবে পুলিশি দমন নীতির নির্মম প্রয়োগ করেছে তা রাজ্যের মানুষ আজও ভোলেনি। বামপন্থার পথ থেকে বিচ্যুত হয়ে একচেটিয়া মালিকদের স্বার্থ রক্ষাতেই ঝাঁপিয়ে পড়ার তাগিদে তারা তখন ভেবে দেখেনি, ভবিষ্যতে সেই অস্ত্রই ব্যবহৃত হবে যে কোনও আন্দোলনের বিরুদ্ধে। আজ মইদুল মিদ্যার মতো তরতাজা যুবককে তাই এ ভাবে মরতে হয়।
এখনও এ দেশে যতটুকু গণতান্ত্রিক পরিসর টিকে আছে তাকে বাঁচিয়ে রাখার স্বার্থেই আজ দরকার তীব্র বাম-গণতান্ত্রিক আন্দোলন। দিল্লির কৃষক আন্দোলন দেখিয়েছে অতি স্বৈরাচারী একটি সরকারও কী ভাবে গণআন্দোলনের শক্তির কাছে মাথা নিচু করতে বাধ্য হয়। কিন্তু সেই শিক্ষা গ্রহণের বদলে সিপিএম নেতৃত্ব আজ ব্যগ্র কংগ্রেস এবং কিছু ধর্মীয় শক্তির সাথে বোঝাপড়া করে কোনও রকমে পিচমবঙ্গে দু’চারটে এমএলএ পাওয়ার ব্যবস্থা করতে। যে কংগ্রেস ভারতে পুলিশিরাজ কায়েমের হোতা, যারা বারবার কলকাতার রাজপথে ছাত্র-যুবদের রক্ত ঝরিয়েছে, তাদের হাত ধরে পুলিশি সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে আদৌ কোনও প্রতিবাদ হয় কি? তাই ভোটের আগে সিপিএম নেতারা একটা মিছিল করে ছাত্র-যুবদের যখন রক্ত দিতে বলেছেন, যৌবনের তেজে তারা তা দিয়েওছেন। একজন তাঁর জীবনও দিলেন। কিন্তু এই জীবনদান যদি আবার নেতাদের নির্বাচনী আখের গোছানোর কাজে ব্যবহৃত হয়, সে বড় দুঃখের। কংগ্রেসকে সাথে নিয়ে শহিদ স্মরণ সম্ভব কি না– সিপিএমের কর্মী, সমর্থক ছাত্র-যুবক বন্ধুদের তা ভেবে দেখতে হবে।