বৃষ্টির মধ্যে এভাবে বসা যায় নাকি? বিরক্ত হতে গিয়ে একটু থমকে গেলাম৷ সামনের চেয়ারগুলো রুমাল দিয়ে মুছে দিচ্ছিল বছর কুডির দুটি মেয়ে৷ গলায় ভলান্টিয়ার কার্ড৷ না না ও মুছতে হবে না–বলে বেশ নিশ্চিন্তে ওই ভেজা চেয়ারেই বসে পডলেন কয়েকজন৷ দীপ্তর কাছে শুনেছি এরা এসেছেন বাংলাদেশ থেকে, বাংলাদেশ সমাজতান্ত্রিক দল (মার্কসবাদী)–র প্রতিনিধি হয়ে৷
একপাশে সরে দাঁডালাম৷ বৃষ্টি থামার কোনও লক্ষণ নেই৷ মাত্র এক সপ্তাহের ছুটিতে কলকাতা এসেছি৷ দীপ্ত খানিকটা জোর করেই টেনে আনল আজ৷ ওর কথা ফেলতে পারলাম না সেই কলেজ এর দিনগুলোর মতই৷ আকাশের হাল দেখে খিঁচড়েই ছিল মেজাজটা৷ এই বৃষ্টিতে মিটিং ফিটিং আর কতক্ষণ চলবে? সুযোগ বুঝে কেটে পডার তালে ছিলাম৷ কিন্তু সব যেন কেমন গোলমাল হয়ে যাচ্ছে এখানে এসে৷ রানি রাসমণি রোড এর তিনটে লেন জুডে জনস্রোত আসছে তো আসছেই৷ চেয়ারগুলো ভরে যাচ্ছে মুহূর্তে৷ কর্ণাটক, কেরালা, তামিলনাডু, ঝাডখণ্ড, পাঞ্জাব, দিল্লি, মধ্যপ্রদেশ … পডতে চেষ্টা করছি নামগুলো৷ এত জায়গায় ছডিয়ে পডেছে এস ইউ সি আই দলটা? এত লোক এসেছে এই মিটিং শুনতে? মাইকে শুনছি পশ্চিমবঙ্গের প্রান্ত প্রত্যন্ত থেকে আসছেন আরও হাজার হাজার মানুষ৷ বৃষ্টিতে কোথাও ট্রেন লেট, কোথাও রাস্তা বন্ধ৷ তবু উৎসাহ–উদ্দীপনা’র এতটুকু কমতি নেই, একফোঁটা হতাশা নেই৷ কাগজে পড়ি পার্টিগুলো মাঠ ভরাতে ভাডা করে লোক আনে, সমাবেশ এর নামে ভুরিভোজ চলে৷ কিন্তু এই মানুষগুলো ঝড়বৃষ্টি মাথায় নিয়ে কীসের টানে জড়ো হচ্ছে দলে দলে? টাকা? খাবার? হাঁটতে হাঁটতে কখন পিছনের দিকটায় চলে এসেছি খেয়াল নেই৷ আমার ঠিক সামনে এসে দাঁডায় একটা মিছিল৷ ক্লান্ত, বিধ্বস্ত, আধভেজা শ’দুয়েক ছেলেমেয়ে, বুডো, বাচ্চা কোলে মহিলা৷ ওরই মধ্যে একজনকে ধরি– ‘এতদূর থেকে বৃষ্টিতে এলেন, কষ্ট হল না? এখন মিটিং শুনবেন?’ প্রশ্ন শুনে বেশ বিরক্ত হয় লোকটা৷ ‘এর থেকে ঢের বেশি বৃষ্টিতেও আমরা মিটিং করেছি গো৷ শুনব বলে এদ্দুর এলাম, আর শুনব না?’ মঞ্চ থেকে গান ভেসে আসে–‘ওই দ্যাখো, জনতা পায়ে পায়ে এগিয়ে চলে, স্লোগান তুলে’৷ যতদূর চোখ যায় শুধু অগুন্তি মাথা আর লাল পতাকা৷ এসপ্ল্যানেড মোড় থেকে ডোরিনা ক্রসিং, রাস্তা ছাপিয়ে শহিদ মিনার ময়দান–নিপুণ হাতে সাজানো হয়েছে ফ্ল্যাগ, ফ্লেক্স, ব্যানারে৷ মঞ্চের কাঠামোতেও উড়ন্ত রক্তপতাকার ভাঁজ, মেহনতি মানুষের সংগ্রাম এর প্রতীক কাস্তে–হাতুড়ি–তারা৷ ফুলে সাজানো লেনিন–স্ট্যালিন এর ছবি৷ রাত জেগে সাজিয়েছে দীপ্তরা৷ ড্রাম এর ছন্দে পা ফেলে এগিয়ে আসছে একদল ছেলেমেয়ে, একশ বছর আগের শোষণমুক্ত সমাজকে কুর্নিশ জানাচ্ছে একশটা লালপতাকা৷ বারো থেকে আঠেরোর একশ জোড়া চোখে অনাবিল আনন্দ, প্রত্যয়৷ এক বাবা তার ছোট্ট ছেলেকে দুহাতে তুলে ধরেছেন, জনসমুদ্র পেরিয়ে ওই একশ পতাকার আলো ছডিয়ে পডছে ওর পেলব মুখে, অবাক চোখদুটোয়৷ আমার মেয়ে রাইয়ের মুখটা হঠাৎ ভেসে ওঠে চোখের পাতায় … নিজেকে বড় ক্লীব মনে হয়৷ তনুকার বারণ না শুনে ওকে তো নিয়ে আসতে পারতাম আজ, ও তো আসতেই চাইছিল বারবার৷ রাই কি মানুষ হবে? রাস্তায় অন্ধ মানুষ দেখলে পার করে দেবে? বাসে বয়স্ক্ মানুষকে সিট ছেডে দেবে? আমাদের গলির মোডড় থালা নিয়ে বসা ভাইবোনকে দেখে একটুও দুঃখ পাবে? নাকি সেই পথগুলো যত্ন করে বন্ধ করে দিচ্ছি আমরাই? আমার মতই রাইও হয়তো ছিটকে যাবে এসব থেকে অনেক দুরে … মোটা স্যালারি আর প্রোমোশন এর হিসেব কষতে শিখবে, ইতিহাসের বইতে এক দু লাইন পড়বে ১৯১৭ সালে রাশিয়ার বুকে কিছু একটা বিরাট কাণ্ড ঘটেছিল– যতটুকু জানলে এমসিকিউ তে রাইট অপশন এ টিক দেওয়া যায়৷ ঠিক সেভাবেই হয়তো মনে রাখবে রবীন্দ্রনাথ, সুভাষচন্দ্র বসু, বিদ্যাসাগর, নজরুল এই নামগুলো৷
জোলো হাওয়ায় শীত শীত লাগছে বেশ৷ অঝোর বৃষ্টিতে ছাতা খুলে ভেজা রাস্তায় বসে হাজার হাজার লোক, কোথাও একটা ছাতায় ঠাঁই নিয়েছেন দু–তিনজন৷ সবার দৃষ্টি মঞ্চের দিকে, সবাই মন দিয়ে শুনতে চায় মাটির পৃথিবীর বুকে গডে ওঠা সেই স্বর্গরাজ্যের কথা৷ সন্ধান পেতে চায় শোষণমুক্তির চাবিকাঠির৷ রাস্তার একপাশে ছবি আর লেখায় সাজানো প্রদর্শনী৷ রাশিয়ার বুকে জারের শাসন, জনমানসে দানা বাঁধছে মুক্তির আকুতি, লেনিন এর উত্থান, গণবিক্ষোভ এর জোয়ার, সোভিয়েতের জন্ম, তারই ধারাবাহিকতায় ঐতিহাসিক নভেম্বর বিপ্লব৷ সমাজতন্ত্রের প্রতি, পৃথিবীর প্রথম সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্রের প্রতি বিশ্বের মনীষীদের অকুণ্ঠ শ্রদ্ধাজ্ঞাপন– রবীন্দ্রনাথ, নেতাজি, বার্নার্ড শ, আইনস্টাইন, রমাঁ রলাঁ, প্রেমচাঁদ, ভগৎ সিং৷ আরেক দিকে মার্কস, এঙ্গেলস, লেনিন, স্ট্যালিন, মাও সে তুং, শিবদাস ঘোষ এর উদ্ধৃতি৷ দুনিয়াকে শুধু জানা নয়, পাল্টানোর পথনির্দেশ৷ পথচলতি বহু মানুষ দাঁডিয়ে দেখছেন একমনে৷ মন্তব্য কানে এলো– যাই বল, এ পার্টিটা ভোটে না জিতলে কি হবে, একদম সাচ্চা পার্টি৷
বুকের ভিতরটা কেমন খালি খালি লাগে৷ আমি তো চাইলে এই লড়াই এর শরিক হতে পারতাম … অন্তত কিছুটা৷ চেয়েছি কি? খেটে খাওয়া মানুষের মুক্তির স্বপ্ন তো আমিও দেখতাম একদিন, ভাবতাম একটা অন্য রকম সমাজ গডার কথা– যেখানে মানুষ না খেয়ে মরবে না, মা বাবাদের সন্তানকে স্কুলে না পাঠিয়ে চায়ের দোকান–কারখানা–হোটে পাঠাতে হবে না, দিনের আলো নিভলেই মেয়েদের সার দিয়ে দেহ বিক্রির জন্য দাঁডাতে হবে না৷ গান, কবিতা, পোস্টার, নাটক … দিনবদলের স্বপ্নে বিভোর সেই দিনগুলো এত সহজে ভুলে গেলাম? দীপ্তর দেওয়া বইপত্রে ধুলো জমেছে, কোনও দিন জানতে চাইনি বুঝতে চাইনি ওদের, চিনতে চাইনি ওদের অমানুষিক পরিশ্রম আর সংগ্রামকে৷ বাজারি কাগজ পড়ে অফিস এর ঠেকে বিজ্ঞের মতো বলেছি– বামপন্থার আর কোনও ভবিষ্যৎ নেই৷ দীপ্তদের আন্দোলন তহবিলে টাকা দেওয়ার সময় কম দেওয়ার হাজারটা মিথ্যে অজুহাত সাজিয়েছি৷ ‘নিশ্চয়ই আসব’ বলে অসুস্থতার গল্প ফেঁদে শপিং মলে গেছি রাই–তনুকাকে নিয়ে৷ চোখের আড়ালেই তিলে তিলে বেড়ে উঠেছে দলটা৷ এমএলএ–এমপি–মিডিয়া ব্যাকিং ছাডাই৷ অর্জন করেছে মানুষ এর শ্রদ্ধা, বিশ্বাস৷ কমিউনিজম এর মধ্যে উন্নত নৈতিকতার সন্ধান না পেলে আমি কমিউনিস্ট হতাম না–সামনের ফ্লেক্সে জ্বলজ্বল করছে এসইউসিআই (কমিউনিস্ট)–এর প্রতিষ্ঠাতা শিবদাস ঘোষ এর কথাগুলো৷ দীপ্তদের আসল জোরটা বোধহয় এখানেই৷
এগিয়ে যাই বুকস্টলের দিকে৷ ডিপি–স্ট্যাটাস–লাইক– শাসিত আত্মবিজ্ঞাপনের যুগে বই পড়ার জন্য এমন উপচে পডা ভিড়? তাও আবার সমাজ–দর্শন–রাজনীতির বই? প্রেসিডেন্সি, রাজাবাজার, এস এন বোসের চেনামুখ বেরিয়ে যায় দু একটা৷ আরও অনেক নাম না জানা ঝকঝকে মুখ, বুদ্ধিদীপ্ত চোখ৷ কোথাও রুটিরুজির দাবি, কোথাও গবেষণার অধিকারের লড়াই, কোথাও শিক্ষার ওপর নেমে আসা আক্রমণ ঠেকানোর জেদ এক ময়দানে জড়ো করেছে অসংখ্য মুক্তিকামী মনকে৷ ভরসা জাগে– এটাই পথ, এ পথেই পৃথিবীর ক্রমমুক্তি৷
সভা শেষ৷ ইন্টারন্যাশনালের সুরে গলা মেলাচ্ছে লাখো জনতা৷ মঞ্চের স্লোগান এর উত্তরে লাল সেলাম এর ভঙ্গিতে ওপরে ওঠে হাজার হাজার মুষ্টিবদ্ধ হাত– নভেম্বর বিপ্লব দীর্ঘজীবী হোক৷ লেনিন স্ট্যালিন শিবদাস ঘোষ লাল সেলাম৷ দুনিয়ার মজদুর এক হও৷ নভেম্বর এর আহ্বান মুছে দিচ্ছে জেলা, রাজ্য, দেশের সীমারেখা৷ নতুন সমাজের শপথ আঁকা হচ্ছে সহস্র সংগ্রামী হৃদয়ে৷
‘কীরে কেমন লাগল?’ দীপ্তর ডাকে চমকে তাকালাম৷ অনেকদিন পর ওর হাতদুটো চেপে ধরলাম– হারিয়ে ফেলা দিনগুলোর মতো৷ কী উত্তর দেব? ভালো? দারুণ? কোথাও অযত্নে ফেলে রাখা দুটো লাইন চলে এলো ঠোটে–
‘দিগন্তে কারা আমাদের সাড়া পেয়ে/সাতটি রঙের ঘোড়ায় চাপায় জিন৷ তুমি আলো আমি আঁধারের পথ বেয়ে/আনতে চলেছি লাল টুকটুকে দিন৷’