জঙ্গলের অধিকার আইন-২০০৬-এর উপর সুপ্রিম কোর্টের ১৩ ফেব্রুয়ারির রায়ের ফলে লক্ষ লক্ষ আদিবাসী ও যুগ যুগ ধরে জঙ্গলে বসবাসকারী মানুষ ভিটেমাটি থেকে উচ্ছেদ হয়ে জীবন জীবিকা থেকে বঞ্চিত হয়ে এক ভয়াবহ বিপদের সম্মুখীন হয়েছেন। অতীতে খনি, জলাধার, পথ নির্মাণ, জঙ্গল ও ভিটে-মাটি থেকে উৎখাত হওয়া প্রায় ২ কোটি আদিবাসী ও গরিব মানুষের সাথে এই উচ্ছেদের সংখ্যা যুক্ত করলে কী বিশাল অঙ্ক দাঁড়াবে তা অনুমান করাও দুরূহ। লক্ষণীয়, সাংবিধানিক রক্ষাকবচ হিসাবে রাজ্যে রাজ্যে জমির অধিকার রক্ষার আইন এবং ঝাড়খণ্ডে ‘ছোটনাগপুর টেনান্সি অ্যাক্ট’ ও ‘সাঁওতাল পরগণা টেনান্সি অ্যাক্ট’-এর মতো আইন থাকা সত্তে্বও গত এক দশকে এক কোটি চল্লিশ লক্ষের বেশি আদিবাসী ও গরিব মানুষ উচ্ছেদ হয়েছেন। গভীর উদ্বেগের বিষয়, অতি দ্রুত বিভিন্ন রাজ্যে এই পরিস্থিতির পরিপ্রেক্ষিতে এলাকায় এলাকায় আদিবাসী ও বনবাসীদের উচ্ছেদের নোটিস জারি করা চলছে এবং লক্ষ লক্ষ পরিবার চরম বিপদের সম্মুখীন। বংশ পরম্পরায় বসবাসকারী এই মানুষগুলি ভিটেমাটি থেকে উচ্ছেদ হলে জীবিকা, কৃষ্টি, সংস্কৃতি হারিয়ে ছিন্নমূল হবেন।
আদিবাসী ও জঙ্গলে বসবাসকারী পরিবারগুলির একটা বড় অংশ জঙ্গলের উপর নির্ভর করে জীবন নির্বাহ করে। জঙ্গলে অবস্থিত গ্রামের বাইরে গঞ্জে বা শহরে উপার্জন করা তাঁদের পক্ষে প্রায় অসম্ভব। এই অবস্থায় জঙ্গল থেকে উচ্ছেদ করলে পথের ভিখারিতে পরিণত হওয়া ছাড়া এই বিশাল সংখ্যায় মানুষগুলির অন্য কোনও পথ থাকবে না।
আদিবাসী ও বনবাসীদের উচ্ছেদের এমন নির্দেশিকা এই প্রথম নয়। ২০০২ সালে কেন্দ্রীয় বন ও পরিবেশ মন্ত্রক এক নির্দেশিকায় জঙ্গলের জমিতে বংশপরম্পরায় বসবাসকারীদের ‘দখলকারী’ অ্যাখ্যা দিয়ে তাঁদের উচ্ছেদের কথা বলেছিল। এর ফলে সেই সময় এক কোটির বেশি আদিবাসী ও চিরাচরিত বনবাসী মানুষের সামনে উচ্ছেদের বিপদ দেখা দিয়েছিল। স্বাভাবিকভাবেই সেই নির্দেশিকার বিরুদ্ধে দেশের সমস্ত প্রান্তে প্রতিবাদ ধ্বনিত হয়েছিল। প্রতিবাদের মুখে পড়ে ২০০৩ সালে প্রাক্তন এক বিচারপতির নেতৃত্বে কেন্দ্রীয় সরকার ন্যাশনাল ফরেস্ট কমিশন গঠন করে। এই কমিশনের সুপারিশক্রমে ফরেস্ট রাইট অ্যাক্ট-২০০৬ তৈরি হয়। আইনে বলা হয়, ১৩ নভেম্বর ২০০৫ অবধি যাঁরা জঙ্গলের জমিতে বসবাস করছেন বা জঙ্গলের জমি চাষবাস করে জীবন নির্বাহ করছেন তাঁরা এই জমির পাট্টা পাওয়ার যোগ্য। যদি তাঁরা দেখাতে পারেন যে, ওই জমিতে তাঁরা তিন পুরুষ বা ৭৫ বছর ধরে বসবাস করছেন। কিন্তু এটা গ্রামের মানুষের পক্ষে দেখানো সম্ভব নয়। এরফলে জঙ্গলে বসবাসকারী আদিবাসীদের জমির পাট্টা পাওয়া অসম্ভব হচ্ছে। কিন্তু কেন্দ্র ও রাজ্যে ক্ষমতাসীন কংগ্রেস, বিজেপি বা বামপন্থী বলে পরিচিত দলগুলি পরিচালিত কোনও সরকারই শর্ত সহজ করে ও এই বিষয়ে প্রচার চালিয়ে ব্যাপকভাবে জঙ্গলে বসবাসকারী মানুষদের পাট্টা দেওয়ার উদ্যোগ গ্রহণ করেনি। এখনও জঙ্গলে বসবাসকারী বহু আদিবাসী ও বনবাসী মানুষ জানেনই না যে তাঁরা যে জমিতে বসবাস করছেন বা চাষবাস করে দিনাতিপাত করছেন সেই জমির পাট্টার জন্য তাঁদের আবেদন করতে হবে। ফলে বেশিরভাগ মানুষ আবেদনই করেননি। যাঁরা করেছেন তাঁদের মধ্যে প্রায় অর্ধেকের আবেদন খারিজ হয়ে গেছে। আবার সম্প্রতি সুপ্রিম কোর্টের মামলার রায়ে লক্ষ লক্ষ মানুষ নতুন করে উচ্ছেদের সম্মুখীন হচ্ছে। ২৯ জানুয়ারি ২০১৬ সুপ্রিম কোর্টের রায়ে বলা হয়,‘‘যদি কোনও আবেদন দক্ষ আধিকারিক দ্বারা যোগ্য নয় বলে বিবেচিত হয় তাহলে আবেদনকারীর নাম পাট্টা বা এই আইনের অন্য অধিকারগুলি প্রাপকদের তালিকা থেকে বাদ দেওয়া হবে এবং তাঁকে ওই জমি থেকে উচ্ছেদ বা তাঁর বিরুদ্ধে অন্য আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়া হবে।” এর দুই বছর পর ৭ মার্চ ২০১৮ সুপ্রিম কোর্টের রায়ে, ‘‘যাদের আবেদন বাতিল হয়েছে তাদের বিরুদ্ধে কী ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে” এবং ‘‘যাদের আবেদন বাতিল হয়েছে তাদের উচ্ছেদ সংক্রান্ত অবস্থা ও যে এলাকা থেকে তাদের উচ্ছেদ করা হয়েছে তার পরিমাপ কত”– এই বিষয়গুলি জানতে চাওয়া হয়। ১৩ ফেব্রুয়ারি ২০১৯-এর রায়ে বলা হয় যে, ‘‘পরবর্তী শুনানির পূর্বে বাতিল আবেদনগুলির আবেদনকারীদের উচ্ছেদ করে তার রিপোর্ট জানাতে হবে।”
জঙ্গলের অধিকার আইন ২০০৬-ও এক দীর্ঘ আন্দোলনের ফসল, কোনও সরকারের দান নয়। ১৯৮৮ সালে রিজার্ভ ফরেস্ট অ্যাক্ট চালু করার ফলে দেশের এক কোটি মানুষ যখন উচ্ছেদের সম্মুখীন হয়েছিল তখনই দেশজুড়ে গড়ে ওঠা আন্দোলনের ফলেই জঙ্গলের অধিকার আইন প্রণয়ন করা হয় এবং ২০০৬ সালে ওই আইন চালু হয়। আদিবাসী ও গরিব মানুষের শোষণ, জুলুম, অত্যাচার থেকে রেহাই পেতে জঙ্গলকে কেন্দ্র করে বেঁচে থাকার যে চিরাচরিত অধিকার ছিল, জঙ্গলের অধিকার আইন-২০০৬-এর মধ্যে সেই সুযোগ যতটুকু ছিল ১৩ ফেব্রুয়ারি ২০১৯-এর সুপ্রিম কোর্টের রায়ে কার্যত তা কেড়ে নেওয়া হল।
অষ্টাদশ শতাব্দীর মধ্যভাগ থেকে ব্রিটিশ সরকারের পুলিশ, দেশীয় জমিদার এবং প্রশাসন জঙ্গলমহল সহ ছোটনাগপুরের মালভূমি এবং রাজমহল এলাকাতে আদিবাসী ও গরিব মানুষকেজমি থেকে উৎখাত করতে অবর্ণনীয় অত্যাচার চালিয়েছিল যার বিরুদ্ধে সেই অষ্টাদশ শতাব্দীর মধ্যভাগ থেকে এই অঞ্চলের আদিবাসী ও গরিব মানুষ লাগাতার সংগ্রাম চালিয়ে এসেছে। রাজমহল এলাকাতে পাহাড়িয়া বিদ্রোহ, ভাগলপুর অঞ্চলে তিলকা মাঝির নেতৃত্বে বিদ্রোহ, হো বিদ্রোহ, ওরাঁও বিদ্রোহ, খেড়োয়ার বিদ্রোহ, সর্দ্দার বিদ্রোহ, জঙ্গলমহলে চুয়াড় বিদ্রোহ, কোল বিদ্রোহ, ভুমিজ বিদ্রোহ একের পর এক সংগ্রাম এভাবে সংগঠিত হয়েছে। পরবর্তী সময়ে জমিদার, মহাজন, আড়কাঠি ও ঠিকাদার এবং তাদের রক্ষক ইংরেজ শাসকদের বিরুদ্ধে ১৮৫৫-৫৬ সালে সাঁওতাল পরগণা এলাকাতে ঐতিহাসিক সাঁওতাল বিদ্রোহ বা ‘হুল’ সংগঠিত হয়েছিল। এই লড়াইয়ের মধ্য দিয়েই সাঁওতাল পরগণা নামের উদ্ভব হয়েছিল এবং এই সমস্ত আদিবাসীদের জমি রক্ষার জন্য যে সমস্ত আইনি সংস্কার শুরু হয়েছিল তারই ধারাবাহিকতাতে ১৯৪৯ সালে স্বাধীন ভারতে সাঁওতাল পরগণা টেনান্সি অ্যাক্ট প্রণীত হয়। ১৮৭৮ সালের জঙ্গল আইনের প্রতিবাদ করার মধ্য দিয়েই বিরসা মুন্ডার ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলনের শুরু। ১৮৯৫-১৯০০ সাল ব্যাপী ছোটনাগপুর এলাকা জুড়ে বিরসা মুন্ডার নেতৃত্বে গড়ে ওঠা আন্দোলনের ফসল হিসাবেই ১৯০৮ সালে ছোটনাগপুর টেনান্সি অ্যাক্ট প্রণীত হয়েছিল। ফলে বহু রক্ত ও জীবন বলিদানের মধ্য দিয়ে যে আইনগুলি তদানীন্তন শাসকেরা চালু করতে বাধ্য হয়েছিল তা শাসক শ্রেণি দেশি-বিদেশি পুঁজিপতিদের স্বার্থে এখন কেড়ে নিতে বদ্ধপরিকর হয়েছে।
বর্তমান আর্থ-সামাজিক অবস্থা এক ভয়াবহ রূপ ধারণ করেছে। বর্তমান নতুন কর্মসংস্থান দূর অস্ত্। কল কারখানা গড়ে তুলে কর্মসংস্থানের সুযোগের কোনও সম্ভাবনা নেই। বরঞ্চ প্রতিনিয়ত কলে-কারখানায় ছাঁটাই, লে-অফ, লক-আউট, ক্লোজারের ফলে কোটি কোটি সংখ্যায় নতুন করে বেকার তৈরি হচ্ছে। গ্রামেও কাজের কোনও সুযোগ নেই। সেচের সুবন্দোবস্ত না থাকা এবং বীজ, সার সহ কৃষি উপকরণের অত্যধিক মূল্যবৃদ্ধির ফলে চাষবাস করে চাষিরা ঋণগ্রস্ত হয়ে আত্মহত্যা করছেন। নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যের অত্যধিক মূল্যবৃদ্ধি, চিকিৎসার ব্যয় বৃদ্ধি, বিদ্যুতের মাশুল বৃদ্ধি, শিক্ষায় ফি বৃদ্ধি, শিক্ষাসামগ্রীর মূল্যবৃদ্ধি সাধারণ মানুষের বেঁচে থাকাই অসম্ভব করে তুলেছে। এই পরিস্থিতিতে নতুন করে লক্ষ লক্ষ মানুষ রুটি-রুজি এবং বাসস্থান হারাতে চলেছে। এর বিরুদ্ধে সর্বত্র প্রতিবাদ ধ্বনিত হচ্ছে। সকল শোষিত মানুষ ও সবস্তরের গণতন্ত্রপ্রিয় শুভবুদ্ধিসম্পন্ন মানুষ আদিবাসী ও চিরাচরিত বনবাসীদের অধিকার রক্ষার আন্দোলনকে সমর্থন জানিয়েছেন। লক্ষ লক্ষ আদিবাসী ও জঙ্গলে বসবাসকারী মানুষের উচ্ছেদ প্রতিরোধে ‘সারা ভারত জন অধিকার সুরক্ষা কমিটি’ আগামী ৩০ মার্চ পার্লামেন্ট অভিযানের আহ্বান জানিয়েছে।
সারা ভারত জন অধিকার সুরক্ষা কমিটির দাবি– ১) আদিবাসী ও বনাঞ্চলের মানুষদের কোনওভাবেই বসবাসের এলাকা থেকে উচ্ছেদ করা যাবে না, আবেদনকারীদের জীবন-জীবিকা সুনিশ্চিত করতে অধিকৃত জঙ্গলের জমির পাট্টা দিতে হবে, সামুদায়িক জঙ্গলের অধিকার দিতে হবে এবং জঙ্গলে প্রবেশের অধিকার ধারাবাহিকভাবে দিতে হবে। ২) বিভিন্ন রাজ্যের জমি রক্ষা সংক্রান্ত আইনগুলি এবং ছোটনাগপুর টেনান্সি অ্যাক্ট ও সাঁওতাল পরগণা টেনান্সি অ্যাক্ট সংশোধন করে আদিবাসী ও গরিব মানুষদের জমির অধিকার কেড়ে নেওয়া চলবে না। ৩) আদিবাসীদের ছিন্নমূল না করে তাদের কৃষ্টি, সংস্কৃতি ও ভাষার বিকাশ ঘটাতে হবে। ৪) আদিবাসীদের এবং গরিব পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠীগুলির আর্থিক ও বৌদ্ধিক বিকাশের জন্য বিশ্ববিদ্যালয় স্তর পর্যন্ত অবৈতনিক শিক্ষার ব্যবস্থা করতে হবে। ৫) আদিবাসী ও গরিব মানুষের জন্য প্রত্যন্ত গ্রামাঞ্চল পর্যন্ত স্বাস্থ্য পরিষেবার ব্যবস্থা করতে হবে। ৬) এস সি/এস টি আইডেন্টিফিকেশন অ্যাক্ট বাতিল করে আদিবাসী ও তফসিলি জাতির পরিচয়পত্র প্রদান সহজ করতে হবে। ৭) তফসিলি জাতি ও উপজাতি নাগরিকদের সামাজিক মর্যাদাকে সুরক্ষিত করতে হবে।