আদালত এমন একটি স্থান যেখানে মানুষের দুঃখ যন্ত্রণা হাহাকার অনেক কিছু মিশে থাকে। যেখানে প্রতিদিন হাজার হাজার মামলা মোকদ্দমা নথিভুক্ত হয়। আবার সেই মামলা মোকদ্দমার একদিন না একদিন বিচারের রায় ঘোষিত হয়। আর আমাদের মতো রাজনৈতিক আন্দোলনের কর্মীদের কাছে এই নিম্ন আদালতের মুখোমুখি হওয়া রাজনৈতিক সংগ্রামের একটা অংশ। বহু সময় গণতান্ত্রিক দাবি দাওয়া নিয়ে আন্দোলন করতে গিয়ে রাষ্ট্রীয় দমন পীড়নের শিকার হয়ে আন্দোলনের কর্মীদের এই আদালতেই রাষ্ট্রের সাথে একপ্রকার আইনি যুদ্ধে লিপ্ত হতে হয়।
কয়েক দিন আগে কোচবিহারের হলদিবাড়ি কলেজে ফি বৃদ্ধির বিরুদ্ধে এআইডিএসও-র ছাত্র আন্দোলনে পুলিশি জুলুমের প্রতিবাদে এস পি অফিসে স্মারকলিপি দিতে গেলে ৪ জন ছাত্রী সহ ১৩ জনের বিরুদ্ধে সন্ত্রাসী কার্যকলাপ, নারীনিগ্রহ সহ একাধিক জামিন অযোগ্য ধারায় মিথ্যা মামলা দায়ের করে। তাদের ১০ দিন জেল হেফাজত দেওয়া হয়। আন্দোলনকারী ১৩ জনের মুক্তির দাবিতে কলকাতায় ২৩ আগস্ট আমরা প্রতিবাদ জানিয়ে মিছিল ও পথ অবরোধ করি। পুলিশ সেখানেও একইভাবে লাঠি চালায় এবং ৮২ জনকে গ্রেফতার করে এবং মিথ্যা মামলা দায়ের করে পুলিশের সদর দফতর লালবাজারে নিয়ে যায়। সন্ধ্যা ৭ টার পর ব্যক্তিগত বন্ডে জামিন দিলেও এমনভাবে মামলা সাজানো হয় যাতে আদালতে হাজির হয়ে চূড়ান্ত জামিন নিতে হয়।
২৫ আগস্ট ছিল সেই চূড়ান্ত জামিন নেওয়ার দিন। সেইমতো ৮২ জন কর্মী কলকাতা নগর দায়রা আদালতে (ব্যাঙ্কশালকোর্ট) উপস্থিত হই। এই মামলার খরচ ও জামিনের অর্থের জন্য আমরা আদালতে উপস্থিত আইনজীবী, ল-ক্লার্ক সহ সকল মানুষের কাছেই সাহায্য চাই। বহু আইনজীবী, ল-ক্লার্ক, ইন্টার্নশিপে থাকা আইনের ছাত্র আমাদের আবেদনে সাড়া দিয়ে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেন। এক আইনজীবী মন্তব্য করেন, ‘এটা তো দুর্নীতিগ্রস্ত নেতা-মন্ত্রীদের জায়গা। এখানে তোমরা কেন?’ আমাদের আবেদন শোনার পর আর্থিক সাহায্য করে তিনি বলেন, ‘তোমরাই জিতবে!’
আদালত চত্বরে বটতলা থেকে ডানদিকে এগিয়ে অতিরিক্ত বিচারবিভাগীয় ম্যাজিস্ট্রেট কক্ষে একজন বয়স্ক বিচারপ্রার্থী মহিলা দাঁড়িয়ে। মুখ দেখে তাঁকে যথেষ্ট বিচলিত এবং ক্লান্ত মনে হচ্ছিল। আমাদের কথা শোনার পর ৫০ টাকা বের করে দিয়ে বললেন, ‘আমি এটুকুই পারব’। আমাদের প্রচার শেষ হওয়ার পর সেই জায়গায় ওই মহিলাকে দেখি দাঁড়িয়ে আছেন। তাঁকে জিজ্ঞাসা করি, ‘কিছু হয়েছে মাসীমা?’ তিনি এক নিঃশ্বাসে বলতে থাকেন, ‘কী আর করব, স্বামী অনেকদিন আগেই চলে গেছেন। এখন ছেলে-বউয়ের সাথে ঘরের মালিকানা নিয়ে এখানে লড়তে এসেছি। একটা করে ডেট পাই, আর আসি। কিন্তু কিছুই ফয়সালা হয় না।’ মনে পড়ে যায় আমার পরিচিত এক স্কুল শিক্ষিকার কথা যিনি ‘মানুষের গন্ধ মাখার গল্পে’ বলেছিলেন, ‘অদ্ভুত মানুষের মন…অদ্ভুত তার চলন! নেই নেই কিছু নেই..তবুও তো আছে কিছু…’ হ্যাঁ, আছে। এত নেইয়ের মাঝেও অনেক কিছু আছে! সত্যিই মানুষের প্রাণ আছে, যার স্পর্শে হাজার হাজার প্রাণ জেগে ওঠে। মানুষের গন্ধ আছে। সেই গন্ধ মেখে জীবনের জন্য ডানা মেলে উড়ে যাওয়া যায়।
সৌপ্তিক পাল, কলকাতা