Breaking News

আদালতের নির্দেশে বিজেপি সরকার কাঠগড়ায় : উন্নাও

কলকাতা

এ যেন ক্রাইম থ্রিলারকেও হার মানায়৷ বইয়ে পড়া গল্পের থেকেও অনেক বেশি ভয়ঙ্কর উন্নাওয়ের ঘটনা৷ ১৭ বছরের এক কিশোরীর উপর দলবদ্ধভাবে ধর্ষণ এবং পুলিশে অভিযোগ করার ‘অপরাধে’ তাঁর গোটা পরিবারকে শেষ করে দেওয়ার মারাত্মক চক্রান্ত এক বিজেপি বিধায়ক ও তার সঙ্গীদের৷ আর তাদের বাঁচানোর নির্লজ্জ অপচেষ্টা উত্তরপ্রদেশের বিজেপি সরকারের৷ ঘটনায় শিউরে উঠেছে দেশের মানুষ৷

উত্তরপ্রদেশের উন্নাওয়ে ২০১৭ সালের জুন মাসে এক মহিলা কাজ দেওয়ার নামে ওই কিশোরীকে নিয়ে গিয়েছিল বিজেপি বিধায়ক কুলদীপ সেঙ্গারের কাছে৷ তাকে দলবদ্ধভাবে ধর্ষণ করেছিল ওই বিধায়ক এবং তার সঙ্গীরা৷ মুখ্যমন্ত্রী যোগীর ঘনিষ্ঠ প্রভাবশালী ওই বিধায়ক ভয় দেখিয়ে, শাসানি দিয়ে অনেকদিন মুখ বন্ধ করিয়ে রেখেছিল মেয়েটির৷ শেষে আর সহ্য করতে না পেরে ২০১৮ সালে মেয়েটি মুখ্যমন্ত্রীর বাড়ির সামনে গায়ে আগুন লাগিয়ে আত্মহত্যা করতে গেলে ঘটনাটি প্রকাশ্যে আসে৷ ১০ জন অভিযুক্তের নামে উন্নাও থানায় এফআইআর করা হয় এবং এলাহাবাদ কোর্টে মামলা করা হয় মেয়েটির পরিবারের থেকে৷ এর পর থেকেই শুরু হয় পরিবারটির উপর লাগামছাড়া অত্যাচার৷ মেয়েটির বাবাকে থানার মধ্যেই পিটিয়ে মেরে ফেলে সেঙ্গারের লোকেরা৷ ঘটনার সাক্ষী মহম্মদ ইউনিস কয়েকমাস পরে রহস্যজনক ভাবে মারা যান৷ মানুষের ক্ষোভের পারদ চড়তে থাকায় কুলদীপ সেঙ্গারকে জেলে পোরে পুলিশ৷ প্রশাসন এবং বিজেপি নেতাদের প্রশ্রয়ে জেলে বসেই কুলদীপ নির্যাতিতার পরিবারকে শেষ করে দেওয়ার পরিকল্পনা করতে থাকে৷ কুলদীপের ভাই মেয়েটির কাকাকে বেআইনি অস্ত্র রাখার মিথ্যা অজুহাতে পুলিশের সাহায্যে জেলে পোরে৷ অভিযুক্ত আরেক বিজেপি নেতা অরুণ সিংহের শ্বশুর রণবেন্দ্রপ্রতাপ সিংহ যোগী সরকারের কৃষিমন্ত্রী৷ ইনি সম্প্রতি ধর্ষণকারী কুলদীপ সেঙ্গারের দুঃখে কাতর হয়ে মন্তব্য করেছেন, ‘‘ভাই কুলদীপের সময়টা সত্যিই খুব খারাপ যাচ্ছে৷ তবে আমাদের শুভেচ্ছা ওর সঙ্গে রয়েছে’’ (আনন্দবাজার পত্রিকা, ৪ আগস্ট, ’১৯)৷ নজরদারি চালাতে নির্যাতিতার বাড়ির দেওয়ালে সিসি ক্যামেরা বসিয়ে দেয় সেঙ্গারের স্যাঙাৎরা৷ ইতিমধ্যে ২৮ জুলাই জেলবন্দি কাকার সঙ্গে দেখা করতে যাওয়ার পথে কুলদীপ সেঙ্গারের দলবলের ছক মাফিক নির্যাতিতাদের গাড়িতে ধাক্কা মারে নম্বরপ্লেটে কালো রঙ করা একটি ট্রাক৷ মারা যান মেয়েটির দুই আত্মীয়া৷ মারাত্মক আহত হয়ে বর্তমানে ভেন্টিলেশনে মৃত্যুর সাথে পাঞ্জা লড়ছেন ওই তরুণী ও তাঁর আইনজীবী৷

জামশেদপুর

মেরে ফেলার হুমকি এবং মামলা তুলে নেওয়ার জন্য প্রকাশ্যে চাপ দেওয়া হচ্ছে এই অভিযোগ জানিয়ে নির্যাতিতার পরিবার ১৩ জুলাই স্থানীয় থানায় চিঠি দেয়৷ সঙ্গে দুষ্কৃতীদের অত্যাচারের বিবরণ সহ ফটো ও ভিডিও ফুটেজও দেয়৷ সেগুলি মুখ্যমন্ত্রী, প্রধানমন্ত্রী, সিবিআই, ভারতের প্রধান বিচারপতির উদ্দেশেও পাঠিয়ে আবেদন করে, যাতে উত্তরপ্রদেশ থেকে মামলা অন্যত্র সরানো হয়৷ কিন্তু ‘আইন–শৃঙ্খলা রক্ষার মডেল’ রাজ্য উত্তরপ্রদেশে অভিযুক্ত বিজেপি বিধায়ক এতটাই প্রভাবশালী যে সে চিঠিও চেপে দেওয়া হয়৷ মেয়েটিকে খুন করার অপচেষ্টার সাম্প্রতিক ঘটনায় দেশ জুড়ে ব্যাপক শোরগোল হলে শেষ পর্যন্ত সুপ্রিম কোর্ট সরাসরি হস্তক্ষেপ করে৷ লক্ষ্মৌয়ের সিবিআই কোর্ট থেকে এই মামলা দিল্লিতে স্থানান্তরিত করে এবং রাজ্য সরকারকে নির্দেশ দেয় নির্যাতিতাকে অবিলম্বে ২৫ লক্ষ টাকা ক্ষতিপূরণ দিতে এবং দ্রুত তদন্ত শেষ করতে৷ এ হেন ভয়ঙ্কর অপরাধে অভিযুক্ত বিজেপি বিধায়ক ও তার দলবলের ক্রিমিনালসুলভ আচরণ, পাশাপাশি উত্তরপ্রদেশের পুলিশ–প্রশাসনের ন্যক্কারজনক ভূমিকায় ক্ষুব্ধ সুপ্রিম কোর্টের প্রধান বিচারপতি মন্তব্য করেছেন, ‘দেশে এ সব কী হচ্ছে’!

কেরালা

গোটা দেশ এই ঘটনায় ক্ষোভে ফেটে পড়েছে৷ রাজ্যে রাজ্যে অসংখ্য বিক্ষোভ কর্মসূচিতে সামিল হয়েছে মানুষ৷ নির্যাতিতা ও তার পরিবারের পাশাপাশি ন্যায়বিচার পাওয়ার আশায় দিন গুনছে সারা দেশ৷ চাইছে কঠোর ও দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি হোক এই বর্বরদের৷

অথচ সম্পূর্ণ নীরব প্রধানমন্ত্রী সহ বিজেপির সামনের সারির নেতা–মন্ত্রীরা৷ এমনকী এই লেখা তৈরি হওয়ার সময় পর্যন্ত অভিযুক্ত বিধায়ককে দল থেকে বহিষ্কারের সিদ্ধান্তও নিতে পারেননি তাঁরা৷ আসলে ‘ঠাকুর’ সম্প্রদায়ের অত্যন্ত প্রভাবশালী এই বিধায়ক কুলদীপ সেঙ্গারের অর্থ ও পেশিশক্তির প্রবল জোর রয়েছে৷ অতীত অপরাধের বহু রেকর্ডও রয়েছে তার৷ গত লোকসভা নির্বাচনে ঠাকুরদের ভোটব্যাঙ্কের একটা বড় অংশ বিজেপির ঝুলিতে ঢুকেছিল সেঙ্গারের হাত ধরে৷ স্বভাবতই এ হেন ‘সম্পদ’কে বাঁচাতে তৎপর বিজেপি সরকার৷

উত্তরপ্রদেশ

যে দল এবং তার সরকার একটি অসহায় অত্যাচারিতা মেয়ের পাশে না দাঁড়িয়ে প্রভাব খাটিয়ে অভিযুক্তদের আড়াল করে, নির্যাতিতার ন্যায়বিচার পেতে বাধা সৃষ্টি করে, এমনকি সত্য ঘটনা ধামাচাপা দিতে একের পর এক খুন করায়, সেই দল কেমন গণতান্ত্রিক শাসন দেবে মানুষকে? বিজেপির এই কদর্য কার্যকলাপের বিরুদ্ধে দেশ জুড়ে মানুষ সরব হয়েছেন৷ দেশের প্রান্তে প্রান্তে গর্জে উঠেছেন৷ একের পর এক ঘটনায় ক্রমশ মানুষের কাছে স্পষ্ট হয়ে যাচ্ছে, সরকারের ‘বেটি বাঁচাও’ স্লোগানটি কত মেকি৷

তাই উত্তরপ্রদেশের বরাবাঁকির একটি গার্লস স্কুলে মেয়েদের নিরাপত্তা নিয়ে বক্তৃতারত পুলিশ অফিসারের দিকে প্রশ্ন ছুঁড়ে দিয়েছে এক ছাত্রী৷ উন্নাওয়ের ঘটনা উল্লেখ করে বলেছে, ‘আপনারা আমাদের অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করতে বলছেন৷ সাধারণ মানুষের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করা এক বিষয়৷ কিন্তু যখন প্রভাবশালী কেউ জড়িয়ে থাকে তখন? আমরা জানি তখন তাকে আড়াল করা হবে৷’ ছাত্রীটি তারপর প্রশ্ন করে, ‘আমরা যদি প্রতিবাদ করি, কীভাবে আপনারা নিরাপত্তা নিশ্চিত করবেন? আপনি গ্যারান্টি দিতে পারেন, আমার খারাপ কিছু হবে না?’ স্বাভাবিকভাবেই অফিসার কোনও উত্তর দিতে পারেননি৷ উত্তর নেই প্রধানমন্ত্রী কিংবা কোনও বিজেপি নেতার মুখেই৷ ছাত্রীটি ‘উলঙ্গ রাজা’ গল্পের শিশুটির মতো বিজেপি সরকারের আসল চেহারাটাকে বেআব্রু করে দিয়েছে৷

বেটি বাঁচাওয়ের স্লোগানটা আসলে বিজেপির এই ঘৃণ্য রাজনীতির মুখোশ৷ এই মুখোশ টেনে ছিঁড়ে ফেলে ভয়ঙ্কর মুখগুলোকে জনসমক্ষে আনা দরকার৷ তার জন্য সর্বত্র সংগঠিতভাবে নারীর সম্ভ্রম রক্ষার আন্দোলন গড়ে তুলতে হবে৷ সাথে সাথে যে সমাজে এমন বর্বর পশুরা নিশ্চিন্তে বিচরণ করতে পারে সেই সমাজটাকেও বদলে ফেলতে হবে৷

(গণদাবী : ৭২ বর্ষ ২ সংখ্যা)