Breaking News

আদর্শের আসল মর্মবস্তু নিহিত থাকে তার সাংস্কৃতিক-নৈতিক মানের উপর—শিবদাস ঘোষ

বর্তমানে জাতির জীবনে নৈতিক অধঃপতন একটা অন্যতম প্রধান সমস্যা হিসাবে দেখা দিয়েছে। এটা একটা বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়। এটা একটা গোষ্ঠী ক্রিয়াকলাপ, শুধু এই ভাবে বললে অবস্থাটাকে খাটো করে দেখা হয়। আমাদের সমস্ত জাতিটার মধ্যে নৈতিক অধঃপতন, ঘুষ খাওয়া, মিথ্যাচার, লোক ঠকানো, কর্তব্যে অবহেলা, দায়িত্বজ্ঞানহীনতা, কাপুরুষোচিত আক্রমণ আজ একটা বৈশিষ্ট্য হিসাবে দাঁড়িয়ে গেছে। কি শাসক দলের, কি বিরুদ্ধ দলের রাজনীতির মধ্যে এ সব ঢুকে গেছে। আমি তার থেকে আমাদের দলকেও বাদ দিতে চাই না। তবে এটুকু বলব, আমাদের দল এ সম্বন্ধে হুঁশিয়ার আছে। আমরা নিজেদের এ সব থেকে রক্ষা করবার জন্য সাধ্যমতো চেষ্টা করছি। কিন্তু এ কথা বলি না যে, এই সর্বাত্মক, সর্বগ্রাসী যে বিরুদ্ধ পরিবেশ এবং আবহাওয়া, তার প্রভাব থেকে আমাদের দলের সমস্ত ছেলে, সমস্ত কর্মী এবং সমর্থকেরা সম্পূর্ণভাবে মুক্ত হয়ে রয়েছে, তা তাদের একেবারে স্পর্শ করতে পারে না। বারবার এ হাওয়া এসে তাদের স্পর্শ করে, তাদের কলুষিত করার চেষ্টা করে, তাদের নৈতিক অধঃপতন ঘটাবার চেষ্টা করে। বারবার আমরা নিরলসভাবে তার বিরুদ্ধে সংগ্রাম করে নৈতিকভাবে তাদের খাড়া রাখবার চেষ্টা করছি। কারণ, একটা কথা আমি বিশ্বাস করি এবং আপনাদেরও ভাবতে বলি, আদর্শের কথা যদি ঠিকও হয়, বড়ও হয়, সত্যও হয়, রাস্তাও যদি ঠিক বাতলাতে পারি, তবুও নৈতিক বল এবং উন্নত সাংস্কৃতিক মান ছাড়া সেই রাস্তায় এগোবার শক্তি কোনও মানুষ অর্জন করতে পারে না। একটা বড় আদর্শ, উন্নত আদর্শ এবং সমস্যা সমাধানের সঠিক রাস্তাও যদি কতকগুলো নৈতিক অধঃপতিত মানুষের হাতে পড়ে, তবে তার দ্বারা দেশের মঙ্গল হতে পারে না, আন্দোলনও সফল হতে পারে না। বরং ক্ষতি হয়। তাই আমি বিশ্বাস করি, যে কোনও আদর্শ, তা শুনতে কেমন, বলতে কেমন, স্লোগান কেমন– এ তার বাইরের ঠাট-বাট। কেউ মাকর্সবাদ-লেনিনবাদ বলে, বিপ্লবের কথা বলে, গণতান্ত্রিক সমাজবাদের বত্তৃতা করে, কিন্তু তাদের সেই আদর্শের দ্বারা সমাজ অভ্যন্তরে পচে-যাওয়া অধঃপতিত নৈতিক মানকে সংযত করা যায় কি না, উন্নত করা যায় কি না, নূতন নৈতিক বলের সৃষ্টি করা যায় কি না এবং তা সৃষ্টি হচ্ছে কি না, এটাই বিচার্য বিষয়। আমি যে কথাটা বলতে চাইছি, তা হচ্ছে, শুনতে, বলতে আদর্শ যত ভালই মনে হোক, সেই আদর্শের আসল মর্মবস্তু নিহিত থাকে তার সাংস্কৃতিক-নৈতিক মানের উপর। এইখানেই তার অগ্নিপরীক্ষা।

কোনও আদর্শ শুনতে এবং বলতে যত ভালই হোক, সে আদর্শের কাঠামো যত সুন্দর হোক, সেই আদর্শের প্রচার এবং প্রভাব সৃষ্টির দ্বারা সমাজ অভ্যন্তরে উন্নত একটা নৈতিক চেতনা, একটা নতুন মান, একটা উন্নত সাংস্কৃতিক ধারণা গড়ে না উঠলে সে আদর্শ কখনও মানুষকে পথ দেখাতে পারে না। তা পরিত্যাজ্য, তা মৃত দেহের মতো পরিত্যাগ করতে হবে। একটা সুন্দর শরীর যদি মৃত ব্যক্তির হয়, আমরা তাকে ফেলে দিই। কেন? কারণ, মমতা করে তাকে জিইয়ে রাখলে দুর্গন্ধ ছড়াবে। তেমনই একগাদা লোক, যদি নৈতিক দিক দিয়ে অধঃপতিত ও স্লোগান সর্বস্ব হয়, দাবি তোলে, কিন্তু দায়িত্ব পালন করে না এমন হয়, তা হলে তারা সমাজের অনিষ্ট করবে। লেনিন বলেছিলেন, ‘‘Better fewer, but better’’– অর্থাৎ অল্প হোক, কিন্তু উন্নত গুণসম্পন্ন মানুষ চাই, কারণ তারা কিছু করবে।

উন্নত নৈতিক মান ও সঠিক রাস্তায় লড়াই চাইঃ নির্বাচিত রচনাবলি, পঞ্চম খণ্ড