৮–৮–৮৷ ৮ বছরের আসিফা, ৮ জন ‘পশু’৷ ৮ দিন ধরে ছোট্ট মেয়েটির উপর যে পাশবিক অত্যাচার চালায় তা দেশের লজ্জা, জাতির লজ্জা৷ ‘পশু’ বললে হয়ত ভুল হবে কারণ পশুরা এমন করে না৷ কিন্তু ওই ৮ জন মানুষরূপী ‘পশুর’ মধ্যে আত্মনিয়ন্ত্রণ বোধ শূন্য৷ মাত্র ৮ বছর বয়স, তাতেও রেহাই মেলেনি আসিফা বানোর৷ এই ঘটনা মনে করিয়ে দিল ২০১৩ সালের নির্ভয়া কাণ্ডের স্মৃতি৷ যেদিন রাজধানীর রাস্তায় শাস্তির দাবি নিয়ে নেমেছিল জনস্রোত, জ্বলেছিল মোমবাতি৷ ভোগবাদও নতমস্তকে পরাজয় স্বীকার করে এদের কাছে৷ এই বছরের জানুয়ারিতে নিজের ঘোড়া খুঁজতে খুঁজতে যখন আসিফা গভীর জঙ্গলে চলে যায় তখনই তার ঘোড়া খুঁজে দেওয়ার প্রলোভন দেখিয়ে অপহরণ করে কাঠুয়ার এক মন্দিরের কেয়ারটেকার৷ আসিফাকে আটকে রাখা হয় ওই মন্দিরে৷ দিনের পর দিন তার উপর চলতে থাকে নরপিশাচদের আক্রমণ৷ একরত্তি মেয়ে তাতে কী যায় আসে৷ তাকে মাদকাসক্ত করে ভোগ–লালসার সিদ্ধি করে৷ ঘটনার সাথে জড়িয়ে পড়ে দুজন পুলিশ আধিকারিক ও বিজেপি নেতাদের নাম৷ রক্ষক যে ভক্ষক তা বারেবারে প্রমাণ হয়েছে, কিন্তু এবার এক আশ্চর্য দৃষ্টান্ত তৈরি হল৷ কাঠুয়ার আইনজীবীরা কোর্টে চার্জশিট পেশ করতে পুলিশকে বাধা দিল৷ ডাকা হল উপত্যকা ধর্মঘট৷ সাথে যোগ দিল দাঙ্গাবাজ বিজেপি–আরএসএস আশ্রিত ‘হিন্দু একতা সংহতি’৷ তারা ধর্ষকদের পক্ষ নিয়ে আইনের বিরোধিতা করে৷ গোটা দুনিয়া দেখল ভারত নামক রাষ্ট্রটিতে খুনি, ধর্ষকদের সমর্থনে ধর্মঘট হয়, আদালতে ভাঙচুর হয়, খুনি–ধর্ষকদের দেবতার আসনে বসানো হয়, তাদের সমর্থনে দাঙ্গা পরিস্থিতি তৈরি হয়, কিন্তু বিচার পায় না আফরাজুল, জুনেইদ, আসিফারা, সবিতারা৷
সাধারণ শারীরবৃত্তিয় প্রক্রিয়ায় একজন শিশু যখন ১২–১৪ বছরে উত্তীর্ণ হয় তখন তার গৌণ যৌন অঙ্গগুলি গঠন হতে শুরু করে৷ মাত্র ৮ বছর বয়সে আসিফার তো ক্লাস টু–থ্রিতে পড়ার কথা৷ কিন্তু সে আজ ক্ষতবিক্ষত দেহ নিয়ে কবরে শুয়ে চোখ বন্ধ করে৷ না আসিফার চোখ বন্ধ হয়নি বন্ধ হচ্ছে আমাদের, যারা সভ্য বলে নিজেদের দাবি করি৷ আসিফার অপরাধটা কী তা আসিফাকে আমরা বলতে পারিনি৷ আমরা তার দোষীদের শাস্তি দিতে পারিনি৷ লজ্জায় চোখ তো আমাদের বন্ধ হওয়া উচিত৷ হয়ত আসিফা মরে গিয়েও আতঙ্কে রাত কাটাচ্ছে, কারণ কেই বা বলতে পারে কবর থেকে তুলে তার উপর এমন পাশবিক অত্যাচার আবার হবে না৷ সেই ভয়ে আজও হয়ত শিউরে উঠছে আসিফার নিথর রক্তমাখা দেহ৷ মাত্র ৮ বছরের আসিফা এখনও শৈশব পার করে কৈশোরে পা দেয়নি, তবুও তার মধ্যে কি এমন জিনিস দেখল যা ধর্ষকদের লালসা থেকে মুক্তি দিল না৷ হয়তো আসিফার মৃত্যুর সাথে লড়াই আরও কিছুদিন বেঁচে থাকত কিন্তু তাকে মাদকাসক্ত করা হয়েছিল৷ সে ছিল সংজ্ঞাহীন৷ তার মৃত্যু নিশ্চিত করতে মাথা পাথর দিয়ে থেঁতলে দেওয়া হয়েছিল৷ অতঃপর সলিল সমাধি করা হয় তাকে৷
এমন নৃশংস ঘটনা আমাদের অজান্তে দেশের কোথাও না কোথাও ঘটে চলেছে নিত্যদিন৷ কিছু আসিফা, কিছু নির্ভয়া প্রকাশ্যে আসে আর বাকিরা থেকে যায় বা রেখে দেওয়া হয় অন্তরালের অন্ধকারে৷ যে দেশের সরকারের স্লোগান ‘বেটি বাঁচাও বেটি পড়াও’ সেই দেশেই, সেই সরকারের নেতা–মন্ত্রীরা এইসব পৈশাচিক কাণ্ডের সাথে ওতপ্রোতভাবে জড়িত৷ তবে কি এই স্লোগানের মধ্য দিয়ে বিজেপি–আরএসএস–এর হাত থেকে বেটি বাঁচানোর কথা বলা হচ্ছে? আমরা চাই না এই মধ্যযুগীয় ভারতবর্ষ৷ আমরা চাই ক্ষুদিরাম, ভগৎ সিং, নজরুল–এর ভারতবর্ষ, যেখানে রামের বন্ধু হবে রহিম, আসিফার বাড়িতে ঈদের পায়েস খেতে যাবে অসীমা৷
দুঃখের বিষয়, কিছু স্বার্থান্বেষী, লোভী, ভোগবাদী, ধর্মের ধ্বজাধারী পিশাচদের জন্য সমাজ আজ কলুষিত৷ সমাজে বেজে চলেছে হিংসার দামামা৷ চারিদিকে শোনা যাচ্ছে উৎপীড়িতের ক্রন্দন রোল৷ এরা মানুষের প্রতি মানুষের বিশ্বাসকে ধ্বংস করছে৷ সাধারণ মানুষের দুর্বলতাকে কাজে লাগিয়ে ফায়দা লুটছে৷ তা না হলে আসিফার বাবা আসিফাকে মন্দিরের মধ্যেও খোঁজ করতেন৷ কারণ তিনি বিশ্বাস করতেন মন্দির পবিত্র জায়গা, এখানে খারাপ কাজ হতে পারে না৷ আসিফার বাবা যদি নজরুলের কবিতা পড়তেন– ‘মন্দির আর মসজিদ ওই শয়তানদের মন্ত্রণাগার…’ এই কথাটা যদি আসিফার বাবা জানতেন নিশ্চিতভাবে তিনি মন্দিরে আসিফার খোঁজ করতেন৷ কিন্তু আফশোস– এখন পবিত্রস্থানে, তুলসীতলায় প্রদীপ জ্বলে না, অবলা দেব দেবীদের সামনে জ্বলে শুধু আসিফাদের শরীর৷ আর পুরোহিত সেজে ওৎ পেতে থাকে পিশাচেরা৷ আসিফার ছিন্ন যোনীর রক্তে যদি মন্দিরের পবিত্রতা নষ্ট না হয়, তা হলে দলিতদের স্পর্শে জাত যাবে কেন? এতকিছুর পরও যদি শুভবুদ্ধির উদয় না হয় তাহলে সর্ব ধর্মের সম্প্রীতির পীঠস্থান ভারতবর্ষকে আমরা অচিরেই হারিয়ে ফেলব৷ ভারতের আকাশে বাতাসে হিংসা, অসহিষ্ণুতার ঝড়৷ যে ঝড়ে আতঙ্কে কেঁপে উঠছে আসিফার মায়েদের জরায়ুতে থাকা ভ্রূণগুলি৷ এই ঝড় সবাই মিলে প্রতিহত করতে না পারলে এমন বহু আসিফাই যে এইসব ধর্ষকদের লালসার শিকার হবে তা বলাই বাহুল্য৷ এই শুভ নববর্ষের সন্ধিক্ষণে একটাই কামনা, এই পাশবিকতার অবসান হোক৷ চৈতন্য ফিরুক ভোগবাদীদের৷
মেহেদি হাসান মোল্লা, বটতলি, গোসাবা
(৭০ বর্ষ ৩৬ সংখ্যা ২৭ এপ্রিল, ২০১৮)