(সমাজতন্ত্রের অতন্ত্র প্রহরী, সাম্যবাদী আন্দোলনের মহান নেতা কমরেড স্ট্যালিন অসুস্থ থাকায় ১৯৫২ সালে অক্টোবর মাসে অনুষ্ঠিত সোভিয়েত কমিউনিস্ট পার্টির ঊনবিংশ কংগ্রেসে তাঁর গাইডেন্সে লিখিত মূল রিপোর্টটি পেশ করেন কমরেড ম্যালেনকভ। ১৪ অক্টোবরের শেষ অধিবেশনে কমরেড স্ট্যালিন সংক্ষিপ্ত অথচ অত্যন্ত শিক্ষণীয় বক্তব্য রাখেন। সেই শিক্ষা আজও প্রাসঙ্গিক বিবেচনা করে মহান নেতার স্মরণ দিবস ৫ মার্চ উপলক্ষে সেই মূল্যবান ভাষণটির বঙ্গানুবাদ আমরা প্রকাশ করছি – সম্পাদক, গণদাবী)।
কমরেডস, ভ্রাতৃপ্রতিম যেসব পার্টি ও গ্রুপের প্রতিনিধিরা উপস্থিত হয়ে আমাদের কংগ্রেসকে সফল হতে সাহায্য করেছেন বা যাঁরা বার্তা পাঠিয়ে কংগ্রেসকে অভিনন্দন ও আমাদের প্রতি শুভকামনা জানিয়েছেন, তাঁদের সৌভ্রাত্রের প্রতি আমি আন্তরিক কৃতজ্ঞতা জানাই। (দীর্ঘ অভিনন্দনে হল ভরে যায়)। তাঁদের আস্থা আমাদের কাছে অত্যন্ত মূল্যবান। কারণ তা দেখায় যে, জনগণের জন্য উজ্জ্বল ভবিষ্যৎ রচনার জন্য আমাদের সংগ্রাম, যুদ্ধের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে শান্তি বজায় রাখার জন্য আমাদের সংগ্রামে পার্টিকে সমর্থন করতে তাঁরা প্রস্তুত। (দীর্ঘ ও সোচ্চার করতালি)।
আমাদের দল অপরাজেয় শক্তির অধিকারী, অতএব আমাদের আর কারও সমর্থন প্রয়োজন নেই এ কথা ভাবা ভুল, কারণ তা সত্য নয়। বিদেশের ভ্রাতৃপ্রতিম জনগণের সমর্থন, সহানুভূতি ও আস্থা আমাদের দলের ও দেশের কাছে সর্বদা প্রয়োজন।
আমাদের প্রতি তাঁদের সমর্থনের বৈশিষ্ট্য এই যে, যখনই তাঁরা আমাদের দলের শান্তি আকাঙক্ষাকে সমর্থন জানান, তখন একই সঙ্গে তাঁরা শান্তি বজায় রাখার জন্য নিজ দেশের জনগণের সংগ্রামকে সমর্থন করেন।
১৯১৮-১৯ সালে যখন ব্রিটিশ বুর্জোয়ারা সোভিয়েটভূমির উপর সশস্ত্র আক্রমণ হেনেছিল, তখন ‘রাশিয়া থেকে হাত ওঠাও’ রণধ্বনি দিয়ে ব্রিটিশ শ্রমজীবী মানুষ যুদ্ধের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়েছিলেন। প্রকৃত সমর্থন একেই বলে। একদিকে শান্তির জন্য নিজের দেশের জনগণের লড়াইয়ের প্রতি সমর্থন, অন্যদিকে সোভিয়েট ইউনিয়নের প্রতি সমর্থন। কমরেড থোরেজ বা কমরেড তোগলিয়াত্তি ঘোষণা করেছেন, তাঁদের দেশের জনগণ সোভিয়েট জনগণের বিরুদ্ধে যাবে না। এই হল খাঁটি সমর্থন। কারণ ইতালি ও ফ্রান্সের শ্রমিক-কৃষক, যাঁরা শান্তির জন্য লড়ছেন, তাঁরা সর্বোপরি সোভিয়েট ইউনিয়নের শান্তি-আকাঙক্ষার পাশে দাঁড়াচ্ছেন। এই পারস্পরিক সমর্থনের মূলে যেটা আছে তা হল, শান্তিকামী জনগণের স্বার্থের সঙ্গে আমাদের দলের স্বার্থের কোনও বিরুদ্ধতা না থাকা, বরং পরিপূরক হিসাবে তার মিলে যাওয়া। (সোচ্চার অভিনন্দন)। বিশ্বশান্তির প্রয়োজনের সঙ্গে সোভিয়েট ইউনিয়নের চাওয়া-পাওয়া এক ও অভিন্ন। স্বাভাবিক ভাবেই ভ্রাতৃপ্রতিম পার্টিগুলির কাছ থেকে আমাদের পার্টি শুধু সমর্থন নেবে, দেবে না কিছুই, তা হতে পারে না। বিনিময়ে মুক্তির জন্য তাঁদের লড়াই, শান্তি বজায় রাখার জন্য তাঁদের সংগ্রামের প্রতি আমরা সমর্থনের হাত বাড়িয়ে দেব। আর এটাই আমরা করছি (সোচ্চার অভিনন্দন)। ১৯১৭ সালে ক্ষমতা দখল এবং পুঁজিবাদী ও সামন্তী দমনপীড়নের অবসান ঘটানোর লক্ষ্যে কার্যকরী পদক্ষেপ গ্রহণ করার জন্য আমাদের দলের কর্মকাণ্ডের সাহসিকতা ও সাফল্য দেখে ভ্রাতৃপ্রতিম দলগুলি বলে, আমরা হলাম বিশ্ব শ্রমিক আন্দোলন ও বিপ্লবী আন্দোলনের ‘শক ব্রিগেড’। এই নামকরণের পিছনে রয়েছে, আমাদের প্রতি তাঁদের আশার অভিব্যক্তি। তাঁদের আশা, ‘শক ব্রিগেডে’র সাফল্য, পুঁজিবাদী শোষণের জাঁতাকলে নিষ্পেষিত জনগণের যন্ত্রণার উপশম ঘটাবে। আমার মনে হয়, জার্মান ও জাপানি ফ্যাসিবাদের দাসত্বের কবল থেকে ইউরোপ ও এশিয়ার জনগণকে মুক্ত করার দ্বারা আমাদের দল তাঁদের আশার প্রতি সুবিচার করেছে।
যতদিন ‘শক ব্রিগেড’ হিসাবে আমরা একক ছিলাম, যতদিন অগ্রগামী বাহিনী হিসাবে একা আমরা কাজ করেছি, ততদিন মর্যাদাময় ও মহান এই দায়িত্ব পালন ছিল অত্যন্ত কঠিন। আজ পরিস্থিতি বদলেছে। আজ চিন থেকে কোরিয়া, চেকোস্লোভাকিয়া থেকে হাঙ্গেরি, জনগণতান্ত্রিক রাষ্ট্রগুলি নতুন ‘শক ব্রিগেড’ রূপে গড়ে উঠেছে। আজ আমাদের লড়াই অনেক সহজ হয়েছে, কাজ এগোচ্ছে সাবলীল ভাবে।
আজও যেসব কমিউনিস্ট, গণতান্ত্রিক, শ্রমিক-কৃষকের পার্টি ক্ষমতা দখল করতে পারেনি, দানবীয় বুর্জোয়া আইনের বুটের তলায় যাদের কাজ করতে হচ্ছে, তাদের প্রতি বিশেষ মনোযোগ দিতে হবে। তাদের কাজটা আরও কঠিন। তবে আমাদের, রুশ কমিউনিস্টদের অনেক কঠিন অবস্থার মধ্যে কাজ করতে হয়েছিল, কারণ জারতন্তে্রর অধীনে প্রগতির পথে এক পা এগোনোই ছিল বিরাট অপরাধ। কিন্তু প্রতিবন্ধকতাকে ভয় না পেয়ে রুশ কমিউনিস্টরা মাটি কামড়ে লড়াই করে জয় ছিনিয়ে এনেছে। এই দলগুলিকেও তা-ই করতে হবে।
জারতন্ত্রের অধীনে রুশ কমিউনিস্টদের যে অসম্ভব কঠিন অবস্থার মধ্যে কাজ করতে হয়েছিল, এইসব দলগুলিকে তা করতে হবে না কেন?
কারণ, প্রথমত, সোভিয়েট ইউনিয়ন ও জনগণতান্ত্রিক রাষ্ট্রগুলির সংগ্রাম ও বিজয়ের দৃষ্টান্ত তাদের চোখের সামনে রয়েছে। কাজেই অপরের ভুলগুলি থেকে নিজেদের শুধরে নেওয়া ও অপরের সাফল্য থেকে অনুপ্রাণিত হওয়ার সুযোগ এই দলগুলির রয়েছে, যা তাদের কাজের গুরুভার অনেকটা লাঘব করেছে।
দ্বিতীয়ত, গণমুক্তির প্রধান শত্রু বুর্জোয়ারা বদলে গিয়েছে। তারা অনেক বেশি প্রতিক্রিয়াশীল হয়েছে, ফলে জনগণকে তারা হারিয়েছে এবং তার দ্বারা নিজেদের দুর্বল করে ফেলেছে। স্বাভাবিকভাবেই পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে বিপ্লবী ও গণতান্ত্রিক পার্টিগুলির কাজ সহজতর হয়েছে।
আজ কেবল বচনে বুর্জোয়ারা উদার সাজতে পারে, বুর্জোয়া গণতান্ত্রিক স্বাধীনতার কথা তুলে ধরে জনপ্রিয়তা অর্জন করতে পারে। কিন্তু আসলে উদারতার লেশমাত্র তাদের নেই। তথাকথিত ব্যক্তিস্বাধীনতার বিন্দুমাত্র অবশিষ্ট নেই। ব্যক্তিস্বাধীনতা শুধু তাদেরই আছে যারা পুঁজির মালিক। বাকি সব নাগরিকই হল মানবদেহী কাঁচামাল, নিছক শোষণের পাত্র। ব্যক্তি ও জাতির সমানাধিকার আজ বুটের তলায়। পরিবর্তে মুষ্টিমেয় শোষকের জন্য সর্বপ্রকার অধিকার আর শোষিত সংখ্যাগরিষ্ঠের কোনও অধিকারই নেই। বুর্জোয়া গণতন্ত্র ও মুক্তির পতাকা ধূলায় লুণ্ঠিত। আমি মনে করি, যদি সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগণকে পাশে পেতে চান, তবে আপনাদের, কমিউনিস্ট ও গণতান্ত্রিক দলগুলিকে সেই পতাকা তুলে ধরতে হবে, বহন করতে হবে। তা তুলে ধরার জন্য আর কেউ নেই।
অতীতে বুর্জোয়ারা ছিল জাতির নেতা, তারা জাতীয় স্বাধীনতা ও ব্যক্তিস্বাধীনতাকে ‘সকলের উপরে’ স্থান দিত। এখন ‘জাতীয় স্বাধীনতার নীতির’ লেশমাত্র নিয়ে তারা চলে না। বুর্জোয়ারা এখন জাতীয় স্বাধীনতা ও অধিকার ডলারের মূল্যে বিকিয়ে দিয়েছে। জাতীয় স্বাধীনতা ও জাতীয় সার্বভৌমত্বের পতাকা তারা ছুঁড়ে ফেলে দিয়েছে। যদি আপনারা দেশপ্রেমিক হিসাবে পরিচয় দিতে চান, জাতির নেতা হতে চান তবে আপনাদের, কমিউনিস্ট ও গণতান্ত্রিক পার্টিগুলির প্রতিনিধিদেরই তা তুলে ধরতে হবে। আর কেউ এটা করতে পারে না। এই হল বাস্তব পরিস্থিতি। স্বাভাবিকভাবে, যে সব কমিউনিস্ট ও গণতান্ত্রিক পার্টি আজও ক্ষমতা দখল করেনি, এই নতুন পরিস্থিতি তাদের কাজ হালকা করে দেবে। ফলে, যেসব দেশে আজও পুঁজির দাপট চলছে, সেখানে ভ্রাতৃপ্রতিম পার্টিগুলি নিশ্চয় বিজয়ী হবে। (বিপুল অভিনন্দন)।