একদিন সন্ধ্যায় কয়েকজন বন্ধুর সঙ্গে কবি নজরুল যখন বসন্ত কেবিনে ঢুকতে যাচ্ছেন, সেই সময় কোটপ্যান্ট পরিহিত এক বাঙালি সাহেব সন্ধ্যার ভোজন শেষ করে বেরোনোর পথে দেখেন, এক ভিখারিনী তার সদ্যোজাত শিশুকে আদর করছে। দেখে তিনি বলতে থাকেন, ‘ভিখারির আবার মা হবার শখ!’ এই কথা বলে ঘৃণায় পাশ কাটিয়ে চলে যান সেই সাহেব এবং তাঁর বন্ধুরা। কবি চুপ করে থাকতে না পেরে আরক্ত চোখে সেই সাহেবের জামার কলার চেপে ধরে যে কথা বলেছিলেন, তা তাঁর ‘বারাঙ্গনা’ কবিতায় ফুটে উঠেছিল। পরবর্তীকালে ঐ মহিলারই একটা বড় ছবি এঁকেছিলেন পটলডাঙার এক শিল্পী। ছবিটি ১৫০০০ টাকায় বিক্রি হলে তিনি ওই টাকা মহিলাটিকে দান করেন।
মানুষকে তার মর্যাদার আসনে বসাতে কবি সর্বদা সচেষ্ট ছিলেন। নিজের জীবনের বিচিত্র অভিজ্ঞতা এবং সেই সঙ্গে সমাজ ও মানুষের প্রতি তার অকৃত্রিম ভালবাসা তার কবিতাগুলোকে করে তুলেছিল মনুষ্যত্ব রক্ষার উপাদান।
১৯২৩ সালে বিদ্রোহী কবি নজরুল ইসলামের এক বৎসর সশ্রম কারাবাস হয়। কলকাতার জেল থেকে হুগলি জেলে তাঁকে আনা হয় কোমরে দড়ি বেঁধে। এই সময় হুগলি জেলে কারারুদ্ধ স্বাধীনতা-সৈনিক বন্দিদের উপর চলত নানা রকমের জুলুম। স্বদেশী পত্রিকা যাতে জেলবন্দিদের হাতে না পড়ে সেই জন্য পুলিশের সজাগ দৃষ্টি থাকত। তবু বিপদ মাথায় করেও বিদ্যামন্দিরের স্বেচ্ছাসেবকরা জেলের মধ্যে পত্রিকা সরবরাহ করতেন। ধরা পড়ে জেলভোগও করেছেন কেউ কেউ। বন্দুকধারী পুলিশ পাহারার চাপে শেষে শুধু কাগজ বন্ধ হল তাই নয়, কর্তৃপক্ষ তাঁদের প্রয়োজনীয় নিত্যব্যবহার্য জিনিস সাবান সোডা ইত্যাদিও বন্ধ করে দিল। এমনকি বন্দিদের সঙ্গে বন্দিদের কথা বলাও নিষিদ্ধ হল।
এইরকম পরিস্থিতিতে বিদ্রোহী কবি রাজবন্দিদের মর্যাদার দাবিতে হুগলি জেলে প্রায় ৩৯ দিন অনশন ধর্মঘট করেছিলেন। কবিগুরু উদ্বিগ্ন হয়ে তারবার্তায় তাঁকে জানালেন, ‘গিভ আপ হাঙ্গার স্ট্রাইক, আওয়ার লিটারেচার ক্লেইমস ইউ।’ এই ভাবেই কবি নজরুল মনুষ্যত্ব রক্ষার দাবিতে, মানুষের সম্মান রক্ষার দাবিতে গর্জে উঠতেন বার বার। এমনকি মানুষের দুঃখ দারিদ্র দেখে মৌখিক সহানুভূতি জানিয়ে চুপ করে বসে থাকার লোক ছিলেন না তিনি। সে অবস্থার সম্মুখীন হলে দুঃখ-দারিদ্র্য পীড়িত মানুষের পাশে দাঁড়ানোর জন্য নিজের শেষসম্বল পর্যন্ত তিনি অকাতরে দান করতেন।
আজ যখন সভ্যতার সম্পদ সৃষ্টিকারী পরিযায়ী শ্রমিকদের অভাবনীয় দুর্দশা, মৃত্যু দেখি, রাজপথ যখন তাদের পায়ের রক্তে রাঙা হয়ে ওঠে, তখন চুপ করে বসে শুধু ভাবি, আর কতখানি মূল্য দিলে এই অসহায় মানুষগুলো দেশের নাগরিকের মর্যাদা পেত, পেত মানুষের সম্মান। আর বিষণ্ন হৃদয়ে শুধু খুঁজে বেড়াই এদের পক্ষে দাঁড়ানোর সেই বলিষ্ঠ কণ্ঠ। গভীর বেদনায় কবি বলেছিলেন, ‘যেদিন আমি দূর তারার দেশে চলে যাব … তারপর হয়ত বা বড় বড় সভা হবে। … বিশেষণের পর বিশেষণ, টেবিল ভেঙে ফেলবে থাপ্পড় মেরে– বক্তার পর বক্তা। এই অসুন্দরের শ্রদ্ধা নিবেদনের শ্রাদ্ধদিনে– বন্ধু তুমি যেন যেয়ো না। যদি পার চুপটি করে বসে আমার অলিখিত জীবনের কোন একটা কথা স্মরণ করো। তোমার আঙিনার আশেপাশে যদি একটি ঝরা, পায়ে পেষা ফুল পাও, সেইটাকে বুকে চেপে ধরে বলো– বন্ধু, আমি তোমায় পেয়েছি।’
সেই ফুল আজ খুঁজতে হবে।
গৌতম দাস, মালদা