‘মারো শালা যবনদের, মারো শালা কাফেরদের’ – আবার হিন্দু মুসলমানী কাণ্ড বাধিয়া গিয়াছে৷ প্রথমে কথা কাটাকাটি, তারপর মাথা ফাটাফাটি আরম্ভ হইয়া গেল৷ আল্লার এবং মা কালীর ‘প্রেস্টিজ’ রক্ষার জন্য যাহারা এতক্ষণ মাতাল হইয়া চীৎকার করিতেছিল তাহারাই যখন মার খাইয়া পড়িয়া যাইতে লাগিল, দেখিলাম– তখন আর তাহারা আল্লা মিয়া বা কালী ঠাকুরানির নাম লইতেছে না৷ হিন্দু–মুসলমান পাশাপাশি পড়িয়া থাকিয়া একই ভাষায় আর্তনাদ করিতেছে, –‘বাবা গো, মা গো’ – মাতৃপরিত্যক্ত দু’টি ভিন্ন ধর্মের শিশু যেমন করিয়া এক স্বরে কাঁদিয়া তাহাদের মাকে ডাকে৷
দেখিলাম হত–আহতদের ক্রন্দনে মসজিদ টলিল না, মন্দিরের পাষাণ দেবতা সাড়া দিল না৷ শুধু নির্বোধ মানুষের রক্তে তাহাদের বেদি চিরকলঙ্কিত হইয়া রহিল৷ …
একস্থানে দেখিলাম ঊনপঞ্চাশ জন ভদ্র–ভদ্র হিন্দু মিলিয়া একজন শীর্ণকায় মুসলমান মজুরকে নির্মম ভাবে প্রহার করিতেছে, আর এক স্থানে দেখিলাম, প্রায় ওই সংখ্যক মুসলমান মিলিয়া একজন দুর্বল হিন্দুকে পশুর মতো মারিতেছে৷ দুই পশুর হাতে মার খাইতেছে দুর্বল অসহায় মানুষ৷ ইহারা মানুষকে মারিতেছে যেমন করিয়া বুনো জংলি বর্বরেরা শূকরকে খোঁচাইয়া মারে৷ উহাদের মুখের দিকে তাকাইয়া দেখিলাম, উহাদের প্রত্যেকের মুখ শয়তানের চেয়েও বীভৎস, শূকরের চেয়েও কুৎসিত হিংসায়, কদর্যতায় উহাদের গাত্রে অনন্ত নরকের দুর্গন্ধ!
উহাদের দুই দলেরই নেতা একজন, তাহার আসল নাম শয়তান৷ সে নাম ভাঁড়াইয়া কখনও টুপি পরিয়া পর–দাড়ি লাগাইয়া মুসলমানদের খ্যাপাইয়া আসিতেছে, কখনও পর–টিকি বাঁধিয়া হিন্দুদের লেলাইয়া দিতেছে, সেই আবার গোরা সিপাই, গুর্খা সিপাই হইয়া হিন্দু–মুসলমানদের গুলি মারিতেছে৷ উহার ল্যাজ সমুদ্রপারে গিয়া ঠেকিয়াছে, উহার মুখ সমুদ্র পারের বুনো বাঁদরের মতো লাল৷ …
মারামারি চলিতেছে৷ উহারই মধ্যে এক জীর্ণা–শীর্ণা ভিখারিনী তাহার সদ্যপ্রসূত শিশুটিকে বুকে চাপিয়া একটি পয়সা ভিক্ষা চাহিতেছে, শিশুটির তখনও নাড়ি কাটা হয় নাই৷ অসহায় ক্ষীণ কন্ঠে সে যেন এই দুঃখের পৃথিবীতে আসার প্রতিবাদ করিতেছিল৷ ভিখারিনী বলিল, ‘‘বাছাকে আমার একটু দুধ দিতে পারছি না বাবু এই মাত্র এসেছে বাছা আমার৷ আমার বুকে একফোঁটা দুধ নেই’’ তাহার কন্ঠে যেন বিশ্ব জননী কাঁদিয়া উঠিল৷ …. তিনদিন পরে আবার দেখিলাম, পথে দাঁড়াইয়া সেই ভিখারিনী৷ এবার তাহার বক্ষ শূন্য৷ চক্ষুও তাহার শূন্য৷ যেদিন শিশু ছিল তার বুকে, সেদিন চক্ষে তাহার দেখিয়াছিলাম বিশ্ব মাতার মমতা৷ অনন্ত নারীর করুণা সেদিন পুঞ্জিভূত হইয়া উঠিয়াছিল তাহার চোখের তারায়, তাই সে সেদিন অমন সিক্ত কাতর কন্ঠে ভিক্ষা চাহিতেছিল৷ আজ তাহার মনের মা বুঝি–বা মরিয়া গিয়াছে, তাহার শিশুর সাথে৷ আজও সে ভিক্ষা চাহিতেছে, কিন্তু আজ সে কাতরতা নেই তাহার কণ্ঠে, আজ যেন সে চাহিবার জন্যই চাহিতেছে৷ …. পথের ধারে কৃষ্ণচূড়ার গাছ৷ তারই পাশে ডাস্টবিন৷ শহরের যত আবর্জনা জমা হয় ওই ডাস্টবিনে৷ আমি শিহরিয়া উঠিলাম৷ ভিখারিনী ডাস্টবিনের অনেকগুলো আবর্জনা তুলিয়া ময়লা ন্যাকড়া জড়ানো কী একটা যেন তুলিয়া লইয়া ‘যাদু আমার, সোনা আমার’ বলিয়া উন্মাদিনীর মতো চুমা খাইতে লাগিল৷ …
চলে গেল ভিখারিনী আবার ভিক্ষা মাগতে!
ডাস্টবিন হইতে ভিখারিনীর পুত্রকে বুকে তুলিয়া লইয়া আমি চলিলাম গোরস্থানের দিকে৷ …যাইতে যাইতে দেখিলাম, সেদিনের মন্দির আর মসজিদের ইট–পাথরের স্তূপ লইয়া হিন্দু–মুসলমান সমানে কাটাকাটি করিতেছে৷
এমনি করিয়া যুগে যুগে ইহারা মানুষকে অবহেলা করিয়া ইট–পাথর লইয়া মাতামাতি করিয়াছে৷ মানুষ মারিয়া ইট–পাথর বাঁচাইয়াছে৷ বৎসরের পর বৎসর ধরিয়া বঙ্গ–জননী তাঁহার দশ লক্ষ অনাহার জীর্ণ, রোগ শীর্ণ, অকালমৃত সন্তানের লাশ লইয়া ইহাদের পাশ দিয়া চলিয়া যাইতেছেন, ইহাদের ভ্রূক্ষেপ নাই ইহারা মানুষের চেয়ে ইট–পাথরকে বেশি পবিত্র মনে করে, ইহারাই ইট পুজো করে৷ ইহারা পাথর–পুজারি!
ভূতে পাওয়ার মতো ইহাদেরে মন্দিরে পাইয়াছে, ইহাদেরে মসজিদে পাইয়াছে৷ ইহাদের বহু দুঃখ ভোগ করিতে হইবে৷
যে দশ লক্ষ মানুষ প্রতি বৎসর মরিতেছে শুধু বাংলায়, তাহারা শুধু হিন্দু নয়, তাহারা শুধু মুসলমান নয়, তাহারা মানুষ৷ স্রষ্টার প্রিয় সৃষ্টি …
মানুষের পশু–প্রবৃত্তির সুবিধা লইয়া, ধর্মমদান্ধদের নাচাইয়া কত কাপুরুষই না আজ মহাপুরুষ হইয়া গেল সকল কালে, সকল দেশে, সকল লাভ–লোভকে জয় করিয়াছে তরুণ৷ ওগো বাংলার তরুণের দল – ওগো আমার আগুন খেলার নির্ভীক ভাইরা, ওই দশ লক্ষ অকালমৃতের লাশ তোমাদের দোরে দাঁড়াইয়া তারা প্রতিকার চায়
তোমরা ওই শকুনির দলের নও৷ তোমরা আগুনের শিখা, তোমাদের জাতি নাই৷ তোমরা আলোর৷ তোমরা গানের, তোমরা কল্যাণের৷ তোমরা বাহিরে এস, এই দুর্দিনে তাড়াও ওই গো–ভাগাড়ে পড়া শকুনির দলকে৷
(কাজী নজরুল ইসলামের ‘মন্দির মসজিদ’ প্রবন্ধ থেকে)