পুঁজিবাদী অর্থনীতির আরেক নাম বাজার অর্থনীতি। এই অর্থনীতির নিয়মানুসারে কোনও পণ্যের চূড়ান্ত দাম নির্ধারিত হয় বাজারের চাহিদা জোগানের দ্বারা। বাজারের প্রতিযোগিতার মধ্য দিয়েই মুনাফা করতে হবে–এটাই বাজার অর্থনীতির সাবেকি ধারণা। কিন্তু পুঁজিবাদ একচেটিয়া স্তরে পৌঁছানোর পর বিশেষ করে রাষ্ট্র একচেটিয়া পুঁজির সেবাদাসে পরিণত হওয়ার পর পুঁজিবাদী অর্থনীতি বাজারের এই নিয়মে চলে না। বিভিন্ন পুঁজিপতি গোষ্ঠী বাজারে নিজস্ব নিয়ন্ত্রণ বাড়ানোর জন্য সরকার ও শাসক দলের নেতাদের মদত নিয়ে থাকে। আমাদের এই ভারতে কিছু দিন আগে একটি পত্রিকা লিখেছিল লোকসভায় কোন পুঁজিপতি গোষ্ঠীর কতজন সাংসদ বা কোন কোন সাংসদ কোন পুঁজিগোষ্ঠীর পকেটে। এদের কাজ হল লোকসভায় আইনকানুন পাশ হওয়ার ক্ষেত্রে বিশেষ পুঁজিগোষ্ঠীর স্বার্থ দেখা ও সেই অনুযায়ী ভূমিকা পালন করা। একচেটিয়া পুঁজিগোষ্ঠীর মধ্যে যারা বৃহৎ তাদের পাশে সরাসরি সরকারই দাঁড়ায়। এই ধরনের সহযোগিতাকেই বলে ‘ক্রোনিইজম’ বা স্যাঙাততন্ত্র। স্যাঙাততন্ত্র বা সহযোগী ছাড়া আজকের পুঁজিবাদী বাজার চলতেই পারে না।
এই স্যাঙাততন্ত্রের বাড়বাড়ন্ত সম্পর্কে বলতে গিয়ে রিজার্ভ ব্যাঙ্ক অফ ইন্ডিয়ার প্রাক্তন ডেপুটি গভর্নর বিরল আচার্য ২০২৩ সালের মার্চে এক প্রতিবেদনে লিখেছিলেন, দেশের গোটা শাসন প্রক্রিয়াটাই চলছে পাঁচ জন পুঁজিপতির স্বার্থে। তিনি উল্লেখ করেছেন, পরিকল্পিতভাবে দেশের শিল্পনীতি এমন করে তৈরি করা হচ্ছে যাতে কিছু পুঁজিপতি সরকারি সুযোগকে কাজে লাগিয়ে সুপার পাওয়ার হিসাবে আত্মপ্রকাশ করে। অর্থনৈতিকভাবে বিপুল ক্ষমতার অধিকারী এবং সরকার ঘনিষ্ঠ এই পাঁচ পুঁজিপতি কারা? এর মধ্যে রয়েছে আম্বানি গোষ্ঠী, টাটা, আদিত্য বিড়লা গোষ্ঠী, আদানি এবং সুনীল মিত্তাল গোষ্ঠী।
রিজার্ভ ব্যাঙ্কের এই প্রাক্তন ডেপুটি গভর্নরের পর্যবেক্ষণ, এই পাঁচ মনোপলির উত্থানগতি একটা বিশেষ মোড় নেয় মোদি শাসনের সূচনা লগ্নে। ২০১৫-২০১৬ সাল নাগাদ। ২০১৬ থেকে ২০২১ সালের মধ্যে সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিং এবং কনস্ট্রাকশনে এদের শেয়ার ৩১ শতাংশ থেকে বেড়ে ৪২ শতাংশ হয়। টেলিকমিউনিকেশনে বৃদ্ধি ঘটে ৬৫ শতাংশ থেকে ৮৪ শতাংশ। খুচরো ব্যবসায় বৃদ্ধি ঘটে ৪৪ শতাংশ থেকে ৬৫ শতাংশ। সম্পদের দিক থেকে ভোজ্য তেল এবং রান্নার গ্যাস উৎপাদনে এই পাঁচ শক্তির বৃদ্ধি ঘটে ৯০ শতাংশ পর্যন্ত। বিভিন্ন মেটাল বা ধাতু উৎপাদনে সম্পদ বৃদ্ধি ঘটে ৬৮ শতাংশ ।
এই বিগ-ফাইভএখন তাদের ব্যবসায়িক-সাম্রাজ্য বহুদূর বিস্তৃত করে ফেলেছে। ৪০টি নন-ফিনান্সিয়াল সেক্টরেও তারা ঢুকেছে। একটু একটু করে দখল নিচ্ছে পরিষেবামূলক ক্ষেত্রগুলিরও। এয়ারপোর্ট, সমুদ্র বন্দর, বিদ্যুৎ বণ্টন, সিটি গ্যাস বণ্টন, পুনর্নবীকরণ শক্তি, এমনকি ট্রেনের টিকিট বিক্রিতেও এরা ঢুকে পড়েছে। তারা শুধু নিজেদের ব্যবসায়িক সাম্রাজ্য বাড়িয়েছে তাই নয়, নিজেরা জোট করেছে যাতে প্রতিযোগিতায় দাম না কমে, বরং নিজেদের মধ্যে বোঝাপড়ার ভিত্তিতে ইচ্ছামতো দাম বাড়ানো যায়। দেশের সাধারণ মানুষ বাস্তবে আজ এদের শোষণে জর্জরিত। ওরা পণ্যের দাম যা ধার্য করবে, গ্রাহককে সেই দামেই কিনতে হবে।
একদল লোক আছেন যারা পুঁজিবাদী অর্থনীতির ঘোরতর সমর্থক হয়েও একচেটিয়া পুঁজিবাদের জনস্বার্থবিরোধী, আগ্রাসী ভূমিকার বিরোধী তাদের বক্তব্য– এমন ব্যবস্থা নেওয়া দরকার যাতে মনোপলির উদ্ভবই না ঘটে, যাতে ক্রোনি ক্যাপিটালিজম গড়ে ওঠার সুযোগই না পায়।
জনজীবনে পুঁজিবাদী অর্থনীতির ভয়ঙ্কর কুফল লক্ষ করে পুঁজিবাদকে নিয়ন্ত্রণের জন্য তাদের এই উদ্বেগ যথার্থ। কিন্তু তারা গভীরে ভাবলে, অর্থনীতির চরিত্র বিশ্লেষণ করলে অবশ্যই লক্ষ করবেন পুঁজিবাদ থাকলে তা একচেটিয়া রূপ নেবেই। কারণ এটা পুঁজিবাদী অর্থনীতির বৈশিষ্ট্য। আর ক্রোনি ক্যাপিটালিজম, অর্থাৎ স্যাঙাততন্ত্র সেটাও পুঁজিবাদের ভিন্ন কোনও জাত নয়। একচেটিয়া পুঁজিতন্ত্র ও সরকারের যোগসাজশে দুর্নীতির পথেই হোক বা বেআইনি পথেই হোক সরকারি সুবিধা আত্মসাৎ করে একচেটিয়া হিসাবে আরও বিপুল পুঁজি কুক্ষিগত করা পুঁজিবাদের স্বাভাবিক পরিণাম। এটা পুঁজিবাদের কোনও নতুন বৈশিষ্ট্য নয়। আগে এটা হত অনেক রেখে-ঢেকে, খানিকটা মানুষের দৃষ্টির আড়ালে। আর আজ যখন পুঁজিবাদ আরও পচে গিয়েছে, প্রতিক্রিয়াশীল হয়ে পড়েছে, তখন এটা একেবারে বেআব্রু হয়ে পড়েছে।
একচেটিয়া পুঁজিবাদী ব্যবস্থায় রাষ্ট্র পুঁজির সেবাদাস। পুঁজিপতিদের কারখানা পরিচালনার জন্য, উৎপাদনের জন্য, ব্যবসা-বাণিজ্যের জন্য যেমন অর্থনৈতিক ম্যানেজার থাকে, তেমনি রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত, সরকারের গৃহীত সিদ্ধান্ত নিজেদের অনুকূলে আনার জন্য থাকে রাজনৈতিক ম্যানেজার। এখন পুঁজিবাদ আরও পচে গিয়েছে, প্রতিক্রিয়াশীল হয়ে পড়েছে। অবাধ শোষণ, অবাধ লুঠ, অবাধ মুনাফা– সবই যাতে দেশের মানুষের কাছে ন্যায্য হিসাবে প্রতিষ্ঠা করা যায় তার জন্য থাকে রাজনৈতিক ম্যানেজার। সরকারের এমএলএ-এমপি-মন্ত্রীরা এই ম্যানেজারের ভূমিকা পালন করে। এরা হলেন পুঁজিপতিদের পলিটিক্যাল ম্যানেজার। এরা পার্লামেন্টে এই একচেটিয়া পুঁজিপতিদের স্বার্থে নানা নীতি গ্রহণ করে এদের শোষণ ন্যায্য প্রতিপন্ন করতে আইন তৈরি করে। তাঁরা নানা দেশে গিয়ে এদের বাণিজ্যের স্বার্থে নানা বৈঠক করে, চুক্তি করে। এর বিনিময়ে সরকারের পরিচালক প্রধানমন্ত্রী ও তার দল বা মুখ্যমন্ত্রী ও তার দল পুঁজিপতিদের থেকে বিপুল আর্থিক সুবিধা পেয়ে থাকে। এদের দেওয়া কোটি কোটি টাকায় এরা ভোটে জেতে। এদের মদতে ক্ষমতাসীন হয় আবার এদেরই স্বার্থ রক্ষা করে। এই চক্রাকার আবর্তনই ঘটছে ভোট ব্যবস্থার মধ্য দিয়ে। এই কারণে স্বাধীনতার পর ৭৫ বছরের শাসন প্রকৃতপক্ষে জনস্বার্থকে প্রতিফলিত করতে পারছে না।
শাসনব্যবস্থাকে যদি জনস্বার্থে পরিচালিত করতে হয়, যদি একচেটিয়া পুঁজির শোষণ বঞ্চনা রুখতে হয় তা হলে এর মূল পুঁজিবাদী অর্থনীতিকেই পাল্টাতে হবে। মুনাফা, অতি-মুনাফা লোটার পুঁজিবাদী অর্থনীতিকে আমূল পাল্টে সমাজতান্ত্রিক অর্থনীতির গোড়াপত্তন করতে হবে। এ ক্ষেত্রে যে দর্শন এই পরিবর্তন ঘটাতে আলোকবর্তিকা হিসাবে কাজ করবে তা হল মার্ক্সবাদ-লেনিনবাদ এবং ভারতে তার বিশেষীকৃত প্রয়োগ শিবদাস ঘোষ চিন্তাধারা। অর্থনীতিকে গভীর খাদ থেকে তুলতে হলে এই ভাবধারার বিস্তার ঘটানো অত্যন্ত জরুরি। এটাই বিকল্প, এটাই সমাধান।