এবার আর বিকাশের কথা নেই, সুশাসনের কথা নেই, নেই কালো টাকা উদ্ধার বা দুর্নীতি দূর করার কথা৷ বিজেপি সভাপতি অমিত শাহের গলায় এবার শুধুই অনুপ্রবেশ ইস্যু৷ তিনি বলেছেন, ‘২০১৯–এ লোকসভা নির্বাচন জিতে সরকার গঠনের পরে আমরা দেশের প্রতিটি কোনা থেকে অনুপ্রবেশকারীদের এক এক করে খুঁজে বের করব এবং বিতাড়ন করব৷’ অমিত শাহের হুঙ্কার শুনলে মনে হবে যেন দেশের একেবারে কোনা কোনা পর্যন্ত অনুপ্রবেশকারীতে ভরে গিয়েছে৷ গত লোকসভা নির্বাচনে তাঁরা কিন্তু এমন হুঙ্কার দেননি, এবার দিতে হচ্ছে কেন?
এবার দিতে হচ্ছে তার কারণ, এবার বিজেপি সামনে তুলে ধরার মতো আর কোনও ইস্যু নেই৷ ‘আচ্ছে দিন’ পুরো ফ্লপ, ‘সব কা সাথ, সব কা বিকাশ’ আজ মানুষের ব্যঙ্গ–বিদ্রুপের বিষয়ে পরিণত হয়েছে৷ বছরে দু’কোটি চাকরি দেওয়ার প্রতিশ্রুতি শেষ পর্যন্ত পকোড়া ভাজার পরামর্শে গিয়ে ঠেকেছে৷ ফলে পুরনো প্রতিশ্রুতিগুলি আজ দেশের মানুষের কাছে অত্যন্ত ক্লিশে হয়ে গেছে৷ অথচ মানুষকে দেওয়ার মতো নতুন কিছু নেই৷ তাই যা মানুষের দৈনন্দিন জীবন–সমস্যার সঙ্গে আদৌ কোনও ভাবে যুক্ত নয় তেমন বিষয়কেও অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ইস্যু করে তারা তুলে নিয়ে আসছে প্রচারের জোরে৷ যদি তারা সত্যিই মানুষের জীবনের সমস্যাগুলি সম্পর্কে সিরিয়াস হতেন তবে অমিত শাহ বলতেন, লোকসভা নির্বাচনে জিতে সবার আগে মানুষের জীবনের জ্বলন্ত সমস্যাগুলি সমাধান করব৷ বলতেন, এবার ক্ষমতায় ফিরে এলে আমরা প্রথমে দেশের প্রতিটি কোনা থেকে বেকারদের খুঁজে বের করে তাদের প্রত্যেকের জন্য কাজের ব্যবস্থা করব, প্রতিটি দরিদ্রকে খুঁজে বের করে তাদের দারিদ্র দূর করব, সমস্ত অপুষ্ট শিশুদের খুঁজে বের করে তাদের পুষ্টির ব্যবস্থা করব৷ এ সব কোনও কিছু না বলে অনুপ্রবেশ নিয়ে হুঙ্কার ছেড়েছেন বিজেপি সরকারের দ্বিতীয় সর্বাধিনায়ক অমিত শাহ৷ আসলে অমিত শাহরা বুঝে গেছেন, নন–ইস্যুকে ইস্যু করে তোলা ছাড়া তাঁদের আর কোনও উপায় নেই৷
প্রচারের জোরে বহু মানুষের প্রত্যাশা তৈরি হয়েছিল, ‘অন্য রকমের দল’ বলে দাবি করা বিজেপি ক্ষমতায় এলে সত্যিই হয়ত তাঁদের জীবনের সমস্যাগুলির সমাধান করবে৷ কিন্তু চার বছরের অভিজ্ঞতা থেকে তাঁরা বুঝে গেছেন, কংগ্রেসের মতো বিজেপিরও মানুষকে আরও মূল্যবৃদ্ধি, আরও বেকারি, আরও ছাঁটাই, আরও বেসরকারিকরণ, আরও দুর্নীতি ছাড়া দেওয়ার কিছু নেই৷
বাস্তবে পুঁজিবাদী একটি রাষ্ট্রব্যবস্থায় যে আর্থিক নীতি নিয়ে বিজেপি চলছে তাতে এর বাইরে অন্য কিছু হওয়ার নয়৷ পুঁজিপতিদের স্বার্থে তৈরি এই নীতি স্বাভাবিক ভাবেই পুঁজিপতিদের স্বার্থই রক্ষা করছে৷ দেশের পুঁজিপতি শ্রেণি যে বিজেপির পিছনে টাকা ঢেলেছে, তাদের ব্যাপক প্রচার দিয়ে সামনে নিয়ে এসেছে তা এটা জেনেই যে কংগ্রেসের মতো বিজেপিও তাদেরই দল৷ মানুষ যখন কংগ্রেসের অপশাসনে ক্রমাগত বিক্ষুব্ধ হয়ে উঠেছে তখন তারা বিজেপিকে ক্ষমতায় বসিয়েছে৷ বিজেপিও গত চার বছর ধরে পুঁজিপতি শ্রেণির পলিটিক্যাল ম্যানেজার হিসাবেই সরকার চালাচ্ছে৷ স্বাভাবিক ভাবেই তাঁদের জনবিরোধী শাসনে সাধারণ মানুষের জীবনের সমস্যাগুলি বেড়েই চলেছে৷ তার অনিবার্য পরিণতিতে মানুষের ক্ষোভও বাড়ছে৷ বিজেপি নেতারা খুব ভাল করে জানেন, মানুষের এই ক্ষোভ যে কোনও সময় বিক্ষোভের আকারে ফেটে পড়বে এবং তা শেষ পর্যন্ত শাসক হিসাবে তাঁদের বিরুদ্ধেই যাবে৷ এই বিক্ষোভ আটকাতে তাই তাঁরা মিথ্যাচারের রাস্তা, প্রতারণার রাস্তা বেছে নিয়েছেন৷ তাঁদের লক্ষ্য মানুষকে বিভ্রান্ত করা, ভুল বোঝানো, ভেদাভেদ তৈরি করে নিজেদের মধ্যে দ্বন্দ্ব–হানাহানিতে মাতিয়ে দেওয়া, যাতে জনগণ এই সত্য ধরতে না পারে যে, তাদের সমস্ত দুর্ভোগের জন্য তাদের ভাগ্য দায়ী নয়, দায়ী এই পুঁজিবাদী ব্যবস্থা এবং তার পলিটিক্যাল ম্যানেজার হিসাবে শাসক বিজেপি৷ সেই লক্ষ্য থেকেই তাঁরা এবার অনুপ্রবেশকে ইস্যু হিসাবে তুলে এনেছেন৷ তাঁরা প্রচার করছেন, তোমার চাকরি নেই কেন– অনুপ্রবেশ দায়ী৷ মূল্যবৃদ্ধি হচ্ছে কেন– অনুপ্রবেশ দায়ী৷ নতুন কলকারখানা হচ্ছে না কেন– অনুপ্রবেশ দায়ী৷
বাস্তবে অনুপ্রবেশকে নির্বাচনী ইস্যু করে ভোটে ফয়দা তোলাই তাঁদের আসল লক্ষ্য৷ তা না হলে বিজেপি নেতাদের তো এ সব প্রশ্নের উত্তর দিতে হবে– উত্তরপ্রদেশে মাত্র ৩৬৮টি পিওন পদের জন্য যে ২৩ লক্ষ বেকার আবেদন করেছিল, তার জন্য কি অনুপ্রবেশ দায়ী? বছরে ২ কোটি বেকারকে কাজ দেব বলে, প্রধানমন্ত্রী আজ যে তাদের পকোড়া ভাজার পরামর্শ দিচ্ছেন তার জন্য কি অনুপ্রবেশ দায়ী? কংগ্রেস আমলের ২.৮৩ লক্ষ কোটি টাকার ঋণ–খেলাপ যে বিজেপি শাসনের মাত্র চার বছরেই ৯.১৭ লক্ষ কোটি টাকায় পৌঁছে গেল তার জন্য কি অনুপ্রবেশ দায়ী? গ্যাসের দাম যে বাড়তে বাড়তে ৯০৭ টাকা হয়ে গেল তার জন্য কি অনুপ্রবেশ দায়ী? প্রতিদিন যে শত শত কারখানা বন্ধ হয়ে যাচ্ছে তার জন্য কি অনুপ্রবেশ দায়ী? সরকারি লক্ষ লক্ষ পদে সরকার যে নতুন নিয়োগ বন্ধ করে দিয়েছে তার জন্য কি অনুপ্রবেশ দায়ী? শিল্পক্ষেত্রে সরকার যে স্থায়ী কাজের সুযোগ তুলে দিয়ে সব কাজে চুক্তিতে নিয়োগের মারাত্মক আইন নিয়ে এসেছে, তা কি অনুপ্রবেশ আটকানোর জন্য?
দেশের মানুষ জানে, এ সব প্রশ্নের উত্তর বিজেপি নেতারা দেবেন না৷ কারণ তা হলে তাঁদের প্রতারণার রাজনীতির মুখোশটা খুলে যাবে৷ দেশের মানুষ ধরে ফেলবে, বিজেপি সরকারের বেআব্রু মালিক তোষণ নীতির কারণেই দেশের ৭০ শতাংশ সম্পদ আজ এক শতাংশ ধনকুবেরের হাতে৷ তেল–গ্যাস–টেলিকম ক্ষেত্রের ধনকুবের মুকেশ আম্বানির সম্পদের পরিমাণ যে এক বছরে ৬৭ শতাংশ বেড়ে ২.৫ লক্ষ কোটি টাকায় পরিণত হয়েছে, আজিম প্রেমজির ২৬,০০০ কোটি টাকার সম্পত্তি এক বছরে পাঁচ গুণ বেড়ে হয়েছে ১,২৪,৫০০ কোটি টাকা, তা হয়েছে বিজেপির এই নীতির কারণেই৷ বিজেপি সভাপতির পুত্রের সম্পদ এক বছরে ১৬ হাজার গুণ বেড়েছে কি কোনও ম্যাজিকে? বাস্তবের কঠিন আঘাতে, জীবনের নির্মম অভিজ্ঞতায় মানুষের কাছে সত্য দ্রুত স্পষ্ট হয়ে যাচ্ছে৷ এই অবস্থায় গত লোকসভা নির্বাচনের প্রতিশ্রুতিগুলি আর মানুষের মনে কোনও দাগ কাটছে না৷ মানুষ বুঝে গেছে, এগুলি শুধু কথার কথাই৷ এবার তাই বিজেপি নেতারা ইস্যু হিসেবে বেছে নিয়েছেন অনুপ্রবেশকে৷ ধর্মে ধর্মে বিদ্বেষ এবং ঘৃণা তৈরি করে মানুষের মধ্যে বিভেদ তৈরি করে তারা এবার নির্বাচনে জিততে চায়৷ এই জঘন্য ভোটলোভীরা জানে, জীবনের অসহনীয় জ্বালায় দিশেহারা মানুষের সামনে দুর্দশার কারণ হিসাবে যে কোনও মিথ্যাকে জোর গলায় তুলে ধরতে পারলে, প্রচারে প্রচারে মাথায় গেঁথে দিতে পারলেই কেল্লা ফতে৷ তাই অনুপ্রবেশের ইস্যুকেই তুরুপের তাস করে মানুষের জীবনকে বাজি রেখে তারা গদির দখল নিতে চায়৷ বিজেপির এ এক সর্বনাশা ফ্যাসিবাদী পদক্ষেপ৷
অনুপ্রবেশ বন্ধে সরকারকে কঠোর পদক্ষেপ নিতে হবে৷ কিন্তু অনুপ্রবেশকে নির্বাচনী ইস্যু করে সাম্প্রদায়িক বিভাজনে মদত দেওয়া দেশের মানুষ কোনও ভাবেই চলতে দিতে পারে না৷ এর বিরুদ্ধে সর্বশক্তি নিয়ে রুখে দাঁড়াতে হবে দেশের সাধারণ মানুষকেই৷ যে জ্বলন্ত অর্থনৈতিক–রাজনৈতি সমস্যাগুলি মানুষের জীবনকে প্রতিনিয়ত জেরবার করে দিচ্ছে সেগুলি সমাধানের জন্য সরকার কী পদক্ষেপ নিচ্ছে, স্পষ্ট ভাষায় তার জবাব চাইতে হবে বিজেপির কাছে৷ ভোটের লালসায় বিজেপি নেতাদের সর্বনাশা প্ররোচনাকে আটকে দেওয়ার এই হল একমাত্র রাস্তা৷
(৭১ বর্ষ ১০ সংখ্যা ৫ -১১ অক্টোবর, ২০১৮)