সুজলা–সুফলা সবুজ শস্যখেত দেখে প্রকৃতি প্রেমীদের চোখ জুড়োতে পারে, কিন্তু চাষ করতে গিয়ে কৃষকদের শুধু চোখের জলই ফেলতে হচেছ না, ঋণজর্জরিত হয়ে আত্মহত্যার পথ বেছে নিতে হচেছ৷ যে কৃষকরা গোটা জাতিকে খাওয়ানোর দায়িত্ব পালন করেন, আত্মহত্যার রেকর্ডে তাঁরা রয়েছেন প্রথম সারিতে৷ কৃষিই যেখানে অর্ধেকের বেশি মানুষের রোজগারের একমাত্র পথ, কৃষিপ্রধান সেই দেশে কৃষকদের দুর্দশা উঠেছে চরমে৷ কৃষকরা চাষ করতে গিয়ে মহাজনদের থেকে চারগুণ বেশি সুদে ঋণ নিতে বাধ্য হচ্ছেন৷
সম্প্রতি মধ্যপ্রদেশের নিমাচ জেলায় বিনোদ পতিদার নামে একজন কৃষক মহাজনের ঋণ শোধ করতে না পেরে আত্মহত্যা করেছেন৷ তিনি মোবাইল ফোনে মৃত্যুকালীন বয়ান ভিডিও করায় প্রকাশ্যে এসেছে কৃষকদের ভয়ঙ্কর দুর্দশা৷ জানা গেছে, পাঁচ মহাজন তাঁকে ঋণ পরিশোধের জন্য বারবার শাসানি এবং চাপ দিতে থাকে৷ তারপর তাঁর একমাত্র ট্রাক্টরটি ছিনিয়ে নেয়৷ পরিণতিতে বিষ খেয়ে মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়েন বছর তিরিশের এই কৃষক৷
ইন্ডিয়া স্পেন্ড স্টেটস সম্প্রতি এক রিপোর্টে প্রকাশ করেছে, কৃষকদের ঋণ নেওয়ার রেখাচিত্র ক্রমশ উর্ধ্বমুখী৷ ২০০২ সালে ১৯.৬ শতাংশ থেকে ২০১৩ সালে বেড়ে হয়েছে ২৮.২ শতাংশ৷ ২০১৭ সালে স্ট্যানফোর্ড ইউনিভার্সিটির করা ‘সেন্টার অন গ্লোবাল পভার্টি অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট’ রিপোর্ট থেকে জানা গেছে, কৃষকরা তাদের ক্ষতি সামাল দিতে মহাজনদের থেকে উচ্চহারে সুদের বিনিময়ে ঋণ নিতে বাধ্য হয়৷ তারা যদি উপযুক্ত পরিমাণে সরকারি ঋণ পেত, তাহলে এই নিষ্ঠুর ও অশুভ চক্রের ফাঁদে পড়তে হত না কৃষকদের৷
দশকের পর দশক ধরে মহাজনরা গ্রামীণ এলাকায় তাদের একচেটিয়া সুদের কারবার চালিয়ে যাচ্ছে৷ এমনকী ঋণ নিয়ে চাষ করার পরও ফলন ভালো না হওয়ায় কিংবা বিক্রিবাটায় মার খেয়ে কৃষক জমি বিক্রি করতে বাধ্য হয়, পরিবারের শেষ সম্বল গয়না পর্যন্ত বিক্রি করতে বাধ্য হয়৷ তারপর কোনও উপায় না দেখে আবার ফসল উৎপাদন করে লাভ করবে এই আশায় গলা পর্যন্ত ঋণ নেয়৷ কিন্তু লাভ দূর অস্ত্, লোকসানের বোঝা ঘাড়ে আরও চেপে বসে৷ মহাজনের ফাঁদা কলে এইভাবে ইঁদুরের মতো আটকে পড়ে ছটফট করতে থাকে অধিকাংশ ক্ষুদ্র ও মাঝারি চাষি৷ এমনকী সুদটুকুও ফেরত দিতে না পেরে আরও ঋণের বোঝায় জর্জরিত হয় চাষি এবং ঋণের জালে জড়িয়ে পড়ে৷
রাজ্যে রাজ্যে এরকম হাজার হাজার ঋণগ্রস্ত কৃষক আত্মহত্যা করতে বাধ্য হচ্ছেন৷ ২০১৭ সালে মাত্র পাঁচ মাসের মধ্যে শুধু মধ্যপ্রদেশেই ১৭৬১ জন, মহারাষ্ট্রে ১১২৯ জন চাষি আত্মহত্যা করতে বাধ্য হয়েছেন৷ অন্যান্য রাজ্যেও কম–বেশি সংখ্যাটা এ রকমই৷ স্ত্রী একমাত্র রোজগেরে স্বামীকে হারিয়ে, শিশুরা তাদের বাবাকে হারিয়ে অনিশ্চিত জীবন কাটাতে বাধ্য হচ্ছে৷ এইভাবে মহাজনদের কাছে বেশিরভাগ গ্রামীণ মানুষই বন্দি জীবন যাপন করছে৷ সমান্তরাল গ্রামীণ অর্থনীতির মালিক মহাজনরা এভাবে আষ্টেপৃষ্ঠে বেঁধে রেখেছে কৃষকদের৷ কিন্তু বিজেপির ‘আচ্ছে দিনের সরকার’ কৃষকদের জীবনে আচ্ছে দিন আনতে পারল না কেন, নাকি হাজার হাজার কৃষকের আত্মহত্যার তালিকায় নাম লেখানোই আচ্ছে দিনের নমুনা
কেন্দ্রের বিজেপি সরকারের নেতা–মন্ত্রীরা উঠতে বসতে কৃষকদের জীবনে উন্নয়নের জোয়ার বইয়ে দেওয়ার বাণী দিয়ে চলেছেন, তবু এই অন্ধকারের ছবি কেন সর্বত্র? কৃষিমন্ত্রী তো কৃষকদের স্বার্থে দু’বেলা চোখের জল ফেলে চলেছেন, তবে কেন মহাজনদের থেকে মোটা সুদে ঋণ নিতে হচ্ছে কৃষকদের, সরকার কেন কৃষকদের বিনা সুদে ঋণের ব্যবস্থা করছে না, চাষের জন্য যাবতীয় ব্যবস্থায় সাহায্য করছে না? মুখেই বিনা সুদে ঋণের ঘোষণা, নানা প্রকল্পের চটকদারি বহুমূল্য বিজ্ঞাপনে সর্বত্র ভরিয়ে না দিয়ে কৃষকদের জন্য বিন্দুমাত্র ভাবলে কাজের কাজ হত৷