কলকাতার পার্ক সার্কাসে এনআরসি–সিএএ–এনপিআ বিরোধী ধর্নামঞ্চের নাম ‘স্বাধীনতা আন্দোলন ২.০’ মঞ্চ৷ স্বাধীনতার ৭৩ বছর পরে এ কোন ‘স্বাধীনতা’র লড়াই প্রশ্ন করতেই জবাব এল, আমরা এ দেশের প্রকৃত নাগরিক৷ তা সত্ত্বেও নতুন করে নাগরিকত্বের যে প্রমাণ দিতে বলা হচ্ছে, সেই অবমাননা থেকে মুক্তির লড়াই৷ ৬ ফেব্রুয়ারি সন্ধ্যেয় পৌঁছতেই দেখা গেল, হাজার খানেক মহিলা অবস্থান করছেন সেখানে৷ বাইরে দাঁড়িয়ে আরও কয়েকশো মানুষ করতালি দিয়ে তাঁদের সমর্থন জানিয়ে চলেছেন৷
এই খানেই প্রচণ্ড ঠাণ্ডায় অসুস্থ হয়ে কয়েক দিন আগে আন্দোলনকারী সাহিদা বিবি মারা গিয়েছেন৷ দিল্লির শাহিনবাগে চার মাসের শিশু মারা গিয়েছে৷ তার পরেও এত জোরদার আন্দোলন চলছে কী করে, আপনারা এত অনুপ্রেরণা কোথা থেকে পাচ্ছেন? এই প্রশ্নের উত্তরে অবস্থানরত মহিলারা সমস্বরে বললেন, নেতাজি, ভগৎ সিং, ক্ষুদিরাম, আসফাকউল্লা খান– এরা স্বাধীনতার জন্য যে লড়াই লড়ে গিয়েছেন, আজ নাগরিক অধিকার রক্ষার লড়াইয়ে তাঁরাই আমাদের অনুপ্রেরণা৷ দেশ আজ চূড়ান্ত সংকটগ্রস্ত, দেশের সংহতি ধ্বংসের চেষ্টা চলছে ক্রমাগত, নাগরিকত্ব নিয়ে চলছে ছিনিমিনি খেলা৷ এ সময় মহিলা বলে কি আমরা বাড়িতে বসে থাকব?
পঞ্চাশোর্ধ্ব আসমত জামিল আরও কিছু মহিলাকে নিয়ে শুরু করেছিলেন এই ধর্না৷ অসুস্থ (একটা কিডনি বাদ দিতে হয়েছে) অবস্থাতেও এক মাসেরও বেশি সময় ধরে রাত জাগছেন৷ ধর্নায় কেন জানতে চাইলে বললেন, এত বড় বিপদ দেশের, এ সময় বসে থাকব কী করে? আমাদের ছেলেমেয়েদের ডিগ্রি আছে কিন্তু কাজ নেই৷ তাদের চাকরির ব্যবস্থা কীভাবে করা যায় তাই সরকারের ভাবা উচিত৷ কত জন শিক্ষার সুযোগ পাচ্ছে না৷ সরকার তাদের শিক্ষার সুযোগ দিক৷ তা না করে হিন্দু–মুসলিম–শিখ– ভাগ করছে৷ বললেন, আমরা প্রথমে ভারতীয়, তারপর কেউ হিন্দু, কেউ মুসলমান, শিখ–খ্রিস্টান৷ আমাদের মধ্যে বিভেদ করার চেষ্টা হচ্ছে কেন?
দেশের নাগরিকদের কাগজ দেখতে চাইছে কেন্দ্রের বিজেপি সরকার৷ এতে আপত্তি কোথায়? জিজ্ঞেস করতেই ফুঁসে উঠলেন, কেন কাগজ দেখাব আমরা? যারা গরিব, সম্পত্তিহীন, তাদের অনেকের কাগজ নেই, যাদের ঘর বন্যায় ভেসে গেছে, আগুনে যাদের ঘর পুড়ে গেছে, তারা কাগজ পাবে কোথায়? তাই আমরাও কোনও কাগজ দেখাব না৷ ১৩০ কোটি মানুষকে ডিটেনশন ক্যাম্পে নিয়ে যাবে ওরা? যাক, কিন্তু কাগজ দেখাব না আমরা৷ ক্ষোভের সাথে বললেন– মোদিজিরা বলছেন, বাংলাদেশ থেকে অনেক অনুপ্রবেশকারী এ দেশে ঢুকেছে সীমান্তে কারা পাহারা দিচ্ছে? সেনাবাহিনী৷ তাহলে এ দেশে অনুপ্রবেশকারী ঢুকলে তো তার জন্য সরকার দায়ী, প্রশাসন দায়ী৷ আর সীমান্তে পাহারা দিতে গিয়ে যে সেনারা প্রাণ দিল, তাদের নিয়ে সরকার মজা করছে, তাদের ভোটের বোড়ে হিসাবে কাজে লাগাচ্ছে৷
স্বাধীনতা আন্দোলনের আহ্বান ছিল, মায়েরা যদি আন্দোলনে না নামে, তাহলে সন্তানদের চরিত্র গড়ে উঠবে না৷ আপনারা অগ্রণী ভূমিকা নিয়েছেন৷ এ সম্পর্কে কিছু বলুন৷ বললেন, আমরা এই আন্দোলনের মধ্য দিয়ে পরবর্তী প্রজন্মের কাছে একটা বার্তা দিতে চাই৷ যেখানেই অন্যায় হবে, মায়েরা প্রতিবাদ করবে, ছেলেমেয়েরা তাদের দেখে প্রতিবাদ করতে শিখবে৷ স্বাধীনতা আন্দোলনে দেশবাসী জেগে উঠেছিল, আবারও জেগে উঠেছে এই দুঃসময়ে৷ বললেন, হিন্দু–মুসলিম সকলে মিলে আমরা একটা পরিবার৷ এটাই এ দেশের বৈশিষ্ট্য৷ সেই পরিবারকে কেউ ধ্বংস করতে এলে আমরা এককাট্টা হয়েই প্রতিরোধ গড়ে তুলব৷
সেই সময় বছর পাঁচেকের একটি মেয়ে হাতে মাইক নিয়ে একটানা স্লোগান দিয়ে চলেছে – ‘ভগৎ সিং কি আজাদি’ চাহিয়ে, ‘ইনকিলাব জিন্দাবাদ’৷ প্রত্যুত্তরে হাত তুলে স্লোগান দিয়ে চলেছেন আট থেকে আশি সব বয়সের কয়েকশো মানুষ৷
তিলজলা থেকে আসা নুরশেদ আলম বললেন, বাচ্চাদের সন্ধ্যে ৬ থেকে ৮টা পর্যন্ত পড়াই, সে সব এখন বন্ধ৷ যতদিন আন্দোলন চলবে, ততদিন আসব ব্যক্তিগত ক্ষতি হলেও৷
স্কুল ছাত্রী জেসকা হুসেইন অবস্থানে আসায় পড়াশোনার ক্ষতি হচ্ছে স্বীকার করেও সাফ জবাব দিলেন, এনআরসি–সিএএ এর থেকেও বড় সমস্যা৷ আর ছাত্ররা প্রতিবাদে রাস্তায় নামবে না তো কারা নামবে? জেএনইউ, জামিয়া মিলিয়া আমাদের চোখ খুলে দিয়েছে৷ একদিকে মোদিজি বলছেন, ‘বেটি বাঁচাও, বেটি পড়াও’, কিন্তু বাঁচার জন্য আন্দোলনে নামতে হচ্ছে মেয়েদের, তাঁর কোনও ভ্রূক্ষেপ নেই৷
মঞ্চে তখন দিল্লির শাহিনবাগের অভিজ্ঞতা বলছেন অমিতা বাগ৷ বলছেন, এই আইন চরম বেআইনি৷ একটা ধর্মনিরপেক্ষ নামধারী রাষ্ট্রে মানুষে–মানুষে বিভেদ ঘটানো যায় না৷ দিল্লিতে প্রশাসনের রক্তচক্ষুকে উপেক্ষা করে হাজার হাজার মা–বোন যেমন রাতের পর রাত ঠাণ্ডায় খোলা রাস্তায় এনআরসি–সিএএ বাতিলের দাবিতে অবস্থান করে চলেছেন, ক্ষমতাপিপাসু কোনও রাজনৈতিক দল আন্দোলনের মঞ্চকে ভোট প্রচারের মঞ্চে পরিণত করতে পারেনি, হীন উদ্দেশ্য নিয়ে এসেও এই ঐক্যবদ্ধ আন্দোলন ভাঙতে পারেনি, সেভাবেই আপনারা আন্দোলন চালিয়ে যাবেন৷ কোনও গদ্দারকে জায়গা দেবেন না৷ যখন তিনি বললেন, পার্ক সার্কাস পশ্চিমবঙ্গের ‘শাহিনবাগ’–এ পরিণত হয়েছে, তখন করতালিতে ফেটে পড়েছে ময়দান চত্বর৷ এক বাক্যে এ কথায় সায় দিলেন ভবানীপুর কলেজের ছাত্রী আসমা পারভিন৷ বললেন– এনআরসি, সিএএ চূড়ান্ত বিভেদমূলক, আইন বিরোধী৷ গণতান্ত্রিক এই রাষ্ট্রে ধর্মের ভিত্তিতে কিছু হওয়া উচিত নয়৷
ধূর্ত বিজেপি এই আন্দোলনকে মুসলিমদের আন্দোলন বলে দেগে দিতে চায়৷ এই চক্রান্তের জবাব দিচ্ছে পার্ক সার্কাস৷ ধর্মীয় পরিচয় দূরে সরিয়ে পারস্পরিক বিশ্বাসে অক্লান্তভাবে কাজ করে চলেছেন সরফরাজ নওয়াজ, ইমরান, গুরুবক্স সিং, রেশমা, ইসমত, ফিরোজ, শম্পা, অনুমিতা, দেবু সাউ–এর মতো স্বেচ্ছাসেবকেরা৷ কারও কোনও অসুবিধা যাতে না হয় তার জন্য তাঁরা সর্বদা তৎপর৷ ধর্নামঞ্চের সামনে অতন্দ্র প্রহরীর মতো বসে রয়েছেন আশি বছরের বৃদ্ধা৷ রয়েছেন দুধের শিশু কোলে মায়েরা৷ ক্ষমতালোভী দলগুলির নেতাদের চোখরাঙানি, পুলিশি অত্যাচারের হুমকি রয়েছে৷ তা উপেক্ষা করে প্রেসিডেন্সি, যাদবপুর, সেন্ট জেভিয়ার্স, যোগমায়া দেবী কলেজ, মুরলীধর গার্লস কলেজ, বঙ্গবাসী, মৌলানা আজাদ কলেজের ছাত্রছাত্রী সহ পুরুষ–মহিলা নির্বিশেষে কয়েক হাজার মানুষের জমায়েত তখন পার্ক সার্কাস চত্বরে৷ মাইকে বাজছে, অত্যাচারী ব্রিটিশের ফাঁসির দড়িকে উপেক্ষা করে বিপ্লবী রামপ্রসাদ বিসমিলের গাওয়া গান ‘সর ফরসি কি তামান্না আজ হামারে দিল মে হ্যায়, দেখনা কি জোর কিতনা বাজু–এ–কাতিল মে হ্যায়৷’
এই ‘শাহিনবাগ’কে হঠায় কার সাধ্য প্রতিবাদ আন্দোলনই যে মানুষকে চরিত্র দেয়, ভাল–মন্দ বুঝতে শেখায়, সচেতন করে– আবার প্রমাণ করে দিয়ে যাচ্ছে শাহিনবাগ থেকে পার্ক সার্কাস সহ এমন অসংখ্য ধর্না মঞ্চের সংগ্রামী মায়েরা৷