আকাশছোঁয়া মূর্তি ও পর্বতপ্রমাণ ব্যর্থতা

প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি গুজরাটের সর্দার সরোবর বাঁধ এলাকায় বল্লভভাই প্যাটেলের এক মূর্তির উদ্বোধন করলেন যা বিশ্বে উচ্চতম৷ মূর্তি তৈরিতে খরচ হয়েছে তিন হাজার কোটি টাকা৷ এত বিরাট পরিমাণ খরচ করে প্রধানমন্ত্রী প্যাটেলের মূর্তি বসালেন কেন? তিনি কি বিজেপির কোনও নেতা ছিলেন– নিদেন পক্ষে আরএসএসের? না৷ তিনি ছিলেন কংগ্রেসের প্রথম সারির এক নেতা, যিনি স্বাধীনতার পর ভারতের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী হয়েছিলেন৷ স্বাভাবিক ভাবেই এ প্রশ্ন সমাজের সমস্ত মহল থেকেই উঠছে, এমন বিপুল আড়ম্বরে প্যাটেলের মূর্তি বসাতে বিজেপি এত তৎপর হয়ে উঠল কেন?

কিছুদিন আগে হঠাৎই প্রধানমন্ত্রী নেতাজি সুভাষচন্দ্রের ব্যবহৃত টুপির মতো একটি টুপি মাথায় লাগিয়ে আজাদ হিন্দ ফৌজের ৭৫ বছর পূর্তিতে লালকেল্লায় পতাকা তুলে ফেললেন৷ তবে কি এই সব রাজনৈতিক ব্যক্তিদের নীতি কিংবা আদর্শের প্রতি বিজেপি–আরএসএস কিংবা বিশেষ করে প্রধানমন্ত্রীর আন্তরিক কোনও আগ্রহ জন্ম নিয়েছে? বিজেপির অভিভাবক আরএসএসের ইতিহাস বলে, তারা সবসময় স্বাধীনতা আন্দোলনের বিরোধিতা করে এসেছে৷ স্বাধীনতা আন্দোলনের নেতাদের প্রতিক্রিয়াশীল বলেছে৷ তা হলে এমনকী ঘটল যে হঠাৎ আরএসএসের অনুগত সেবক নরেন্দ্র মোদি স্বাধীনতা আন্দোলনের নেতাদের ভক্ত হয়ে উঠলেন? প্যাটেলের মূর্তি উদ্বোধন করে প্রধানমন্ত্রী এটিকে ‘ঐক্যের প্রতিমূর্তি’ বলে ঘোষণা করেছেন৷ প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, ‘‘ভারতকে এক করার জন্য সর্দার প্যাটেলের বড় ভূমিকা ছিল৷ তাঁর মূর্তিও সব ভারতীয়ের কাছে গর্বের৷ এ নিয়ে রাজনীতি হওয়া উচিত নয়৷’’ বিজেপি নেতারাই বলতে পারবেন, কত কোটি ভারতবাসী সর্দার প্যাটেলের ভূমিকার কথা স্মরণ করে তাঁর এমন বিশাল মূর্তি বসানোর জন্য প্রধানমন্ত্রীর কাছে দাবি জানিয়েছিলেন অন্তত কোটি কোটি যুবক, যারা একটা কাজের জন্য হন্যে হয়ে দেশের এ প্রান্ত থেকে ও প্রান্ত ছুটে বেড়াচ্ছে, কাজ হারানো লক্ষ লক্ষ শ্রমিক কিংবা ফসলের ন্যায্য দাম না পেয়ে ঋণজর্জরিত কোটি কোটি চাষি যে তাঁর কাছে এমন উদ্ভট দাবি নিয়ে হাজির হননি তা নিশ্চয়ই হলফ করে বলা যায়৷

তা হলে কোন প্রয়োজন মেটাতে বিজেপির এমন রাজসূয় যজ্ঞের আয়োজন? প্রয়োজন বিজেপির দুটো৷ প্রথম হল, বিজেপি এবং তার পূর্বসূরি জনসংঘ, আরএসএসের ইতিহাসের ভাণ্ডারে এমন একজনও নেতা নেই যাঁকে সারা দেশের মানুষের সামনে তাঁরা আদর্শ হিসাবে তুলে ধরতে পারেন৷ এটা তাদের নীতি ও আদর্শের দেউলিয়াপনারই নজির৷ এই গুরুতর অভাবটি যে বিজেপি নেতাদেরও মাথাব্যথার কারণ তা তাঁদের ‘আইকন’ খোঁজার মরিয়া প্রচেষ্টা থেকেই স্পষ্ট৷ কিন্তু এমন অভাবের কারণটি কী? কারণ, দেশের মানুষ যাঁদের নেতা বলে, মনীষী বলে, স্মরণীয় বলে মনে করে তাঁরা প্রত্যেকে হয় দুশো বছরের ব্রিটিশ শাসনের জমাট অন্ধকারের মধ্যে নবজাগরণের আলো এনেছিলেন, কিংবা দেশকে স্বাধীন করতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নিয়েছিলেন৷ মুশকিল হল, ব্রিটিশ বিরোধী স্বাধীনতা আন্দোলনের বিরোধী হওয়ায় বিজেপির পূর্বসূরি আরএসএস কিংবা জনসংঘের নেতারা এই আন্দোলনে যোগ দেননি, বরং বিরোধিতাই করেছিলেন৷ ব্রিটিশ শাসনের বিরুদ্ধে ধর্ম–বর্ণ নির্বিশেষে সমস্ত ভারতীয়ের সংগ্রামের মধ্য দিয়ে স্বাধীনতা অর্জনের পরিবর্তে এই দলগুলির নেতারা চেয়েছিলেন হিন্দুত্বের ভিত্তিতে রাষ্ট্রগঠন করতে৷ ফলে দেশের মানুষের সামনে উপস্থিত করার মতো সর্বজনমান্য কোনও নেতাই আরএসএস–জনসংঘে গড়ে ওঠেনি৷ প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি জনসভায় গলা কাঁপিয়ে যতই সাধারণ মানুষকে ‘মিত্রোঁ’ বলে সম্বোধন করুন, দেশের মানুষ যে আদৌ তাঁকে মিত্র মনে করে না তা বিজেপি নেতারা খুব ভাল জানেন৷ তাঁদের নেতা গোলওয়ালকর, হেডগেওয়ার এমনকী দীনদয়াল উপাধ্যায়কেও তাঁরা দেশের মানুষের সামনে নানা কায়দায় বহু আড়ম্বরে বারে বারে উপস্থিত করে দেখেছেন, মানুষ তাঁদের গ্রহণ করেনি৷ গান্ধীজি কংগ্রেসের সঙ্গে এমন ওতপ্রোত ভাবে জড়িত এবং গান্ধী–হত্যার সাথে আরএসএস এমন সরাসরি যুক্ত যে তাঁকে বিজেপির নেতা বলে চিহ্ণিত করা অসম্ভব৷

এই দৈত্যাকার মূর্তি বসানোর পিছনে বিজেপির উদ্দেশ্য জাঁকজমকে মানুষের চোখকে এমন করে ধাঁধিয়ে দেওয়া যাতে মানুষ বিজেপির অপশাসনের যন্ত্রণা ভুলে যায় এবং একে বিজেপির এক মহান কীর্তি বলে মনে করে৷ কিন্তু জীবন–যন্ত্রণায় ছটফট করতে থাকা দেশের কোটি কোটি মানুষ কিছুতেই শুধু বিশাল মূর্তি দেখে তাঁদের জীবনের দুঃখ–কষ্টকে ভুলে যেতে পারে না৷ মূর্তি স্থাপন করতে যে ২২টি গ্রাম থেকে আদিবাসী দলিতদের কোনও ক্ষতিপূরণ কিংবা পুনর্বাসন না করেই উচ্ছেদ করা হয়েছে এবং পুলিশ দিয়ে তাঁদের প্রতিবাদকে স্তব্ধ করে দেওয়ার চেষ্টা হয়েছে, গ্রেপ্তার করে জেলে ঢোকানো হয়েছে, তাঁরা কীভাবে শুধুমাত্র দীর্ঘ মূর্তি দেখেই দেশের সাথে নিজেদের একাত্ম অনুভব করবেন? তাঁরা কী করে এটা মেনে নেবেন যে, সর্দার সরোবর প্রকল্পে সেচখাল তৈরির ও পুনর্বাসনের কয়েকশো কোটি টাকা প্রধানমন্ত্রীর ইচ্ছায় মূর্তি এলাকায় পর্যটক আকর্ষণ করতে গল্ফ কোর্স, পাঁচ তারা হোটেল, বোটিংয়ের জন্য লেক তৈরি, বিলাসবহুল তাঁবুর ব্যবস্থা করতে নয়ছয় করা হবে৷ যে গরিব প্রান্তিক কৃষকদের চাষের কাজে বাঁধের জল দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়েছিল, তার পরিবর্তে বোটিংয়ের জন্য সেই জল ব্যবহারকে কী করে তারা মেনে নেবে!

মূর্তি নির্মাণে খরচ ৩০০০ কোটি টাকা

এই টাকায় করা যেত

(যে কোনও একটি)

*     ৫, ৯৮,০০০ সুক্লে শৌচালয়

*     ৫,২৯৬ জন শিশুকে মানুষ করা

*     ১৬২টি ক্ষুদ্র সেচ প্রকল্পের পুনর্নির্মাণ

*     ৪০,১৯২ হেক্টর জমিতে সেচের ব্যবস্থা

*     ৪২৫টি ছোট বাঁধ

*     ২টি নতুন এইমস ক্যাম্পাস

*     ৭৫ মেগাওয়াট ক্ষমতাসম্পন্ন ৪টি সৌরবিদ্যুৎ প্রকল্প

 

গ্যাস–কেরোসিন সহ প্রতিটি নিত্য প্রয়োজনীয় দ্রব্যের ব্যাপক মূল্যবৃদ্ধি, সীমাহীন বেকারি, হাজারে হাজারে কল–কারখানা বন্ধ হয়ে যাওয়া, কৃষকের ফসলের দাম না পাওয়া, ক্রমাগত বেড়ে চলা নারী নির্যাতন, অপরদিকে পুঁজিপতিদের দেশের সম্পদের অবাধ লুটপাঠ, ব্যাপক দুর্নীতি এবং এর মধ্য দিয়ে তাদের অকল্পনীয় ভাবে ফুলে–ফেঁপে ওঠা দেশের মানুষ কী করে ভুলে যাবে প্রধানমন্ত্রী দেশের একচেটিয়া পুঁজিপতিদের স্বার্থরক্ষার জন্য রাতারাতি নোট বাতিল ঘোষণা করে যেভাবে দেশের সাধারণ মানুষকে চরম দুর্ভোগে ফেললেন, যেভাবে জিএসটি ঘোষণা করে ক্ষুদ্র ও মাঝারি ব্যবসার সর্বনাশ ডেকে আনলেন তা তারা কি শুধু মূর্তি দেখে ভুলে যেতে পারে দেশের কোটি কোটি শিক্ষা–চিকিৎসা বঞ্চিত মানুষ কী করে ভুলে যাবে প্রধানমন্ত্রী তাঁর অতুল কীর্তিস্থাপনের জন্য যে অঢেল খরচ সরকারি কোষাগার থেকে করলেন তাতে অসংখ্য স্কুল হাসপাতাল নির্মাণ করা যেত, গৃহহীনদের জন্য গৃহের ব্যবস্থা করা যেত, হাসপাতালগুলিতে চিকিৎসক এবং ওষুধের বরাদ্দ বাড়ানো যেত৷ স্বাভাবিক ভাবেই প্রধানমন্ত্রী সহ বিজেপি নেতারা যতই এই দীর্ঘতম মূর্তিকে তাঁদের অতুল কীর্তি হিসাবে উপস্থিত করতে চান, দেশের শোষিত নিপীড়িত শ্রমিক কৃষক সহ সাধারণ মানুষের মধ্যে এ নিয়ে বিন্দুমাত্র আগ্রহ লক্ষ করা যায়নি৷ বরং বিজেপি সরকারের জনবিরোধী নীতিগুলির কুফল তাদের জীবনে মারাত্মক সর্বনাশ হিসাবে নেমে এসেছে, যা তারা অন্য কোনও কিছুতেই ভুলতে পারছে না৷ তাদের ক্ষোভ ক্রমাগত বেড়ে চলেছে৷ জনমনে পুঞ্জীভূত এই পাহাড়প্রমাণ ক্ষোভকে বিজেপি নেতারা দীর্ঘতম মূর্তি দিয়ে ঢাকতে পারবেন না৷

(৭১ বর্ষ ১৩ সংখ্যা ৯ – ১৫ নভেম্বর, ২০১৮)