৯০ টাকা কেজির সর্ষের তেল কয়েক মাসে পৌঁছেছে ২১০ টাকায়। ৭০ টাকার ডাল ১২০ টাকা। ৪৫০ টাকার গ্যাস ১০০০ টাকা। গরিবের সম্বল কেরোসিন, তাতেও মূল্যবৃদ্ধির ধাক্কা। ওষুধের দামবৃদ্ধি তো সব রেকর্ডকে ছাপিয়ে গেছে। পরিবহণের ভাড়া বাড়ছে লাফিয়ে। করোনাকে কেন্দ্র করে টানা লকডাউনের ফলে বিরাট সংখ্যক মানুষ কাজ হারিয়েছেন। মাইনে কমে গিয়েছে বহু মানুষের। ছোট ব্যবসা ও শিল্প মারাত্মক ক্ষতিগ্রস্ত। অসংখ্য সংস্থা বন্ধ। করোনা আক্রমণের আগের হিসেবেই মোদি জমানায় বেকারত্ব ৪৫ বছরের রেকর্ড মাত্রায় পৌঁছেছে। এর সাথে যুক্ত হয়েছে মারাত্মক মূল্যবৃদ্ধি। এই মূল্যবৃদ্ধি কোনও সাধারণ মূল্যবৃদ্ধি নয়। অর্থাৎ পুঁজিবাদী অর্থনীতির স্বাভাবিক নিয়মে যে মূল্যবৃদ্ধি ঘটে তা নয়। এই মূল্যবৃদ্ধি সরকারি সহযোগিতায় জনসাধারণের ঘাড়ে জোর করে চাপিয়ে দেওয়া। বড় কোম্পানিগুলি তাদের সর্বোচ্চ মুনাফা উশুল করতে প্রতিটি পণ্যের দাম বাড়িয়ে দিয়েছে অস্বাভাবিক হারে। এই অবস্থায় নাজেহাল মানুষ দুবেলা দুমুঠো খাবার জোগাড় করতেই হিমসিম খেয়ে যাচ্ছে। অথচ দেখা যাচ্ছে, টাকার অঙ্কে কর্পোরেটদের ব্যবসা আগের বছরের থেকে বেড়েছে। ফলে সরকারের জিএসটি আদায়ও বেড়েছে। কিন্তু বিক্রি কমেছে।
এই যে ইচ্ছামতো দামবৃদ্ধি, এখানে কোনও সরকারের কোনও নিয়ন্ত্রণ নেই। যেন দেশে কোনও সরকারই নেই বা সরকারের এ ব্যাপারে কোনও দায়িত্ব নেই। দেশের সাধারণ মানুষ যে ক্রমাগত দারিদ্রের অতলে তলিয়ে যাচ্ছে, তাদের পাশে দাঁড়ানো যেন সরকারের দায়িত্ব নয়। তাই হয়-কথায় নয়-কথায় তাদের রেশন বন্ধ হয়ে যায়, কেরোসিনের দাম বাড়ানো হয়, বরাদ্দ কমানো হয়, গ্যাসের দাম যথেচ্ছ বাড়ানো হয়। অর্থনীতিবিদরা মানুষের হাতে নগদ অর্থ দিতে বললে সরকার শুনতে না পাওয়ার ভান করে। কিন্তু মানুষের আজ দেওয়ালে পিঠ ঠেকে গিয়েছে। আর পিছনোর কোনও জায়গা নেই। ঘুরে দাঁড়ানোই এখন বাঁচার একমাত্র রাস্তা। আর সেই ঘুরে দাঁড়াতেই এস ইউ সি আই (কমিউনিস্ট)-এর পক্ষ থেকে ২২ মার্চ কলকাতা এবং শিলিগুড়িতে ডাক দেওয়া হয়েছে বিরাট বিক্ষোভ মিছিলের। পড়ে পড়ে মার খাওয়া নয়, প্রতিকারের দাবি তুলুন, আহ্বান জানিয়েছে দল। পাশাপাশি কেন্দ্রীয় ট্রেড ইউনিয়নগুলি ২৮-২৯ মার্চ দুদিনের যে সাধারণ ধর্মঘটের ডাক দিয়েছে এস ইউ সি আই (সি) তাকে সফল করে তুলতে সর্বাত্মক ভাবে ঝাঁপিয়ে পড়েছে।
প্রধানমন্ত্রী থেকে অর্থমন্ত্রী সকলেই দেশের মানুষকে প্রায়ই শোনাচ্ছেন, কোভিডের ক্ষয়ক্ষতি পূরণ করে ফেলেছে ভারত। একই সঙ্গে আর্থিক বৃদ্ধি কেমন দ্রুত হারে ঘটে চলেছে, তার ফিরিস্তি দিচ্ছেন। এ কথা ঠিক যে, দেশে ধনীর, এমনকি শত-কোটিপতির সংখ্যা বেড়েই চলেছে। কিন্তু সাধারণ মানুষের অবস্থা কী? অবস্থাটা স্পষ্ট জানা সত্ত্বেও প্রধানমন্ত্রী কিংবা অর্থমন্ত্রী কেউই তা উচ্চারণ করেননি। কেন করেননি? তা হলেই যে ধরা পড়ে যাবে অর্থনীতির আসল হালটা!
এক বেসরকারি সংস্থার সাম্প্রতিক সমীক্ষায় উঠে এসেছে দেশের সাধারণ মানুষের বাস্তব আর্থিক অবস্থাটা। সমীক্ষায় দেখা যাচ্ছে, গত অক্টোবর-ডিসেম্বরে যখন উৎসবের মরসুম, তখন ভোগ্যপণ্যের বিক্রি কমেছে ২.৬ শতাংশ। শহরে তা নেমেছে ০.৮ শতাংশ, গ্রামে ৪.৮ শতাংশ।
প্রধানমন্ত্রী যখন অর্থনীতির ঘুরে দাঁড়ানোর গল্প শোনাচ্ছেন তখন বাস্তব পরিস্থিতি বলছে, গত ডিসেম্বরে কল-কারখানায় উৎপাদন (ম্যানুফ্যাকচারিং) সরাসরি কমে গিয়েছে ০.১ শতাংশ। মূলত সেই কারণেই ওই মাসে শিল্পবৃদ্ধির হারও নীচে নেমে ০.৪ শতাংশে দাঁড়িয়েছে। শুধু ডিসেম্বর নয়, চার মাস ধরে শিল্প বৃদ্ধির হার নাগাড়ে নেমে চলেছে। শিল্পোৎপাদনের বেশির ভাগ অংশ (৭৭ শতাংশের বেশি) জুড়ে রয়েছে কল-কারখানার যে উৎপাদন, তা-ও মুখ থুবড়ে পড়েছে। উৎপাদন শিল্পেই কর্মসংস্থানের সুযোগ সবচেয়ে বেশি থাকে। সেই ক্ষেত্র জুড়ে এমন মন্দা মানুষের ক্রয়ক্ষমতাকেও নামিয়ে দেয়। বাস্তবে তারই প্রতিফলন দেখা যাচ্ছে এই সব তথ্যে।
কিন্তু এই তথ্যগুলির তাৎপর্য কী? মানুষের জীবন-মানের সাথে সম্পর্ক কী? বেশির ভাগ মানুষ এ-সব বিচার করে দেখেন না। কেন্দে্রর বিজেপি সরকার কিংবা রাজ্যে রাজ্যে সরকারগুলি সকলেই কিছু দিন অন্তর শিল্পায়নের ধুয়ো তোলে। বিজেপি সরকারের মেক ইন ইন্ডিয়াই হোক বা এ রাজ্যে তৃণমূল সরকারের শিল্প সম্মেলনই হোক, দেশের জনগণের এই ধ্বংসপ্রাপ্ত ক্রয়ক্ষমতা নিয়ে এ-সব কোনও কিছুই কি সফল হতে পারে? সিপিএমও এক সময় নিয়মিত শিল্পায়নের একই ধুয়ো তুলত। এ-সব যে শুধুমাত্র মানুষের চোখে ধুলো দিতেই, উপরের পরিসংখ্যান তা স্পষ্ট করে দিচ্ছে।
তথ্য থেকে স্পষ্ট, বিজেপি সরকারের নেতা-মন্ত্রীরা আর্থিক বৃদ্ধির যে দাবি ফলাও করে প্রচার করছেন, তার সাথেও দেশের সাধারণ মানুষের জীবনমানের কোনও সম্পর্ক নেই। বরং আর্থিক বৃদ্ধি যা ঘটছে তা দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের জীবনমানকে তলানিতে ছুঁড়ে দিয়েই। সম্প্রতি উপদেষ্টা সংস্থা নাইট ফ্র্যাঙ্কের এক সমীক্ষায় দেখা যাচ্ছে, ২০২০-র তুলনায় ২০২১-এ ভারতে তিন কোটি ডলারের বেশি (প্রায় ২২৬ কোটি টাকা) সম্পদশালী ধনকুবেরের সংখ্যা বেড়েছে। সম্প্রতি অ’ফ্যাম ইন্ডিয়ার রিপোর্টে জানা গেছে, ধনীতম ১০ শতাংশের হাতে জমা হয়েছে জাতীয় সম্পদের ৪৫ শতাংশ। নিচু তলার ৫০ শতাংশের ভাগে জুটেছে মাত্র ৬ শতাংশ সম্পদ। এই অবস্থায় নাইট ফ্র্যাঙ্কের হিসেব অনুযায়ী, ধনকুবের (তিন কোটি ডলারের বেশি সম্পদশালী) ভারতীয়ের সংখ্যা ২০২১ সালে ২৩১ থেকে বেড়ে হয়েছে ২৫৭ জন। ২০১৬ সালের (১১৯) তুলনায় বৃদ্ধি ১১৫.৫ শতাংশ। স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে, দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ সাধারণ মানুষ যখন কাজ হারিয়ে, রোজগার হারিয়ে দুবেলা দু-মুঠো খাবার জোগাড় করতে হিমশিম খেয়ে যাচ্ছে, তখন পুঁজিপতিদের পুঁজি ক্রমাগত বেড়েই চলেছে। অসাম্য আজ আকাশ ছুঁয়েছে। স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে যে বৃদ্ধির সাফল্যে প্রধানমন্ত্রী সহ বিজেপি নেতারা উচ্ছ্বসিত, সেই বৃদ্ধি আসলে কাদের ঘটছে!
ক’দিন আগেই প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি ঘোষণা করেছেন, সরকারের দায়িত্ব হল দেশের শিল্পপতিদের পাশে দাঁড়ানো, তাদের বিভিন্ন ভাবে সাহায্য করা। প্রধানমন্ত্রীর এই ঘোষণা সরকার নামক প্রতিষ্ঠানটির শ্রেণিচরিত্র নগ্ন করে দিয়েছে। সাধারণ মানুষ কত সহজেই না বিশ্বাস করে বসেন, সরকার হল জনগণের জন্য, জনগণের দ্বারা, জনগণের সরকার। বাস্তবে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি বলেই দিলেন, তাঁর সরকার শুধুমাত্র পুঁজিপতিদের জন্যই। এরপরও এই তীব্র ধনবৈষম্য, সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের চরম দুর্দশা– এটা কি মোদি শাসনে অনিবার্য ছিল না? দেশ সেবার নামে বাস্তবে পুঁজিবাদী একটি সরকার যে শুধুমাত্র পুঁজিপতি শ্রেণিরই সেবা করে, মার্কসবাদের সেই বুনিয়াদি কথাই কি প্রমাণিত হচ্ছে না প্রধানমন্ত্রীর কথা এবং বাস্তব পরিস্থিতিতে? মুখে ‘সবার বিকাশ’-এর কথা। তা হলে এমন আকাশছোঁয়া বৈষম্য ঘটতে পারছে কী করে, বৈষম্য রোধে কেন সরকার কোনও ব্যবস্থা নিচ্ছে না কেন? তার উত্তর তো প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্য থেকে পরিষ্কার। এ সব জেনেও যদি মানুষ পুঁজির এই সব সেবকদের মধুমাখা বুলিতে বারবার ভুলতে থাকেন, এই বৈষম্যই তো ক্রমাগত তীব্র হতে থাকবে।
আসলে যে পুঁজিবাদী ব্যবস্থাটি এদেশে কায়েম রয়েছে, তা গড়েই উঠেছে পুঁজিপতি শ্রেণির স্বার্থরক্ষার জন্য। এর নিয়ম-নীতি, আইন-কানুন সবই পুঁজিপতি শ্রেণির স্বার্থ তথা মুনাফা বাড়িয়ে চলার জন্য। জনগণের জন্য শুধুই পাঁচ বছর অন্তর একবার করে ভোট দেওয়ার অধিকার। তাও প্রায়শই লুঠ হয়ে যায়। পুঁজিপতিদের টাকার থলি, মিডিয়ার প্রচার, আর গুন্ডা মস্তানরা গণতন্ত্রকে প্রহসনে পরিণত করে। তাই শুধু ভোট দিয়ে সরকার বদলে মানুষের এই ভয়ঙ্কর দুরবস্থার বদল হতে পারে না। প্রবল গণআন্দোলনের চাপে এই পুঁজিবাদী ব্যবস্থার বদলই একমাত্র পারে মানুষের দুরবস্থার স্থায়ী বদল আনতে। সেই লক্ষ্যেই আজ গণআন্দোলনগুলি পরিচালিত করতে হবে। এস ইউ সি আই (সি) গণআন্দোলনগুলিকে সেই লক্ষে্যই পরিচালিত করছে। আগামী ২২ মার্চ সেই আন্দোলনেরই ডাক দেওয়া হয়েছে। মূল্যবৃদ্ধি রোধ, শিক্ষার বেসরকারিকরণ বন্ধ, দুয়ারে মদ প্রকল্প বাতিল, ফসলের ন্যায্য দাম সুনিশ্চিত, শ্রমিকস্বার্থ বিরোধী নতুন শ্রমকোড বাতিল প্রভৃতি জনজীবনের গুরুত্বপূর্ণ দাবি নিয়ে ২২ মার্চ কলকাতা ও শিলিগুড়িতে বিক্ষোভ মিছিলের ডাক দিয়েছে এস ইউ সি আই (সি)। একদিকে আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে যুদ্ধের ধ্বংসলীলা, দেশের বুকে বিজেপি সরকারের সাম্প্রদায়িক রাজনীতি, বিদ্বেষ-বিভাজন, অন্য দিকে রাজ্যে তৃণমূলের নীতিহীন রাজনীতি, ভোটলুটের উল্লাসে চাপা পড়ে যাচ্ছে জনজীবনের জ্বলন্ত সমস্যাগুলি। ২২-শের মিছিলে গ্রাম-শহর থেকে হাজার হাজার সাধারণ মানুষ সরকারের কাছে এ সবের জবাব চাইতে আসবে। মানুষ আর পড়ে পড়ে মার খেতে রাজি নয়।