স্বাধীনতা আন্দোলনের বিরোধীরাই আজ দেশপ্রেমিক সাজছে
২০১৪ সালে মাত্র ৩১ শতাংশ ভোট পেয়ে কেন্দ্রীয় সরকারে ক্ষমতায় এসেছিল নরেন্দ্র মোদির নেতৃত্বে বিজেপি৷ এর আগে এন ডি এ জোট ক্ষমতায় এলেও লোকসভায় বিজেপির একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা ছিল না৷ রাজ্যসভাতেও সংখ্যাগরিষ্ঠতার থেকে অনেক পিছনে ছিল তারা৷ ফলে বিজেপি তাদের উগ্র হিন্দুত্ববাদী বহু কর্মসূচিই সেই সময় প্রকাশ্যে আনতে পারেনি৷ কিন্তু ২০১৪ সালে লোকসভায় ‘ম্যাজিক ফিগার’ পার করার পর দেশ ক্রমশ তাদের আগ্রাসী চেহারা দেখতে থাকে৷ একদিকে কংগ্রেসের দেখানো পথেই তারা কর্পোরেট পুঁজির স্বার্থবাহী অর্থনৈতিক নীতি নিচ্ছে, অন্যদিকে অযোধ্যায় ঐতিহাসিক বাবরি মসজিদের ধ্বংসস্থলে রাম মন্দির নির্মাণ, ভাগবত গীতাকে ‘রাষ্ট্র গ্রন্থ’ ঘোষণা, গরুকে ‘জাতীয় পশু’ বা ‘রাষ্ট্র মাতা’ হিসেবে ঘোষণা করা, গরু–নিধনকে নিষিদ্ধ করা, এমনকী গো হত্যা করার সাজা হিসাবে ফাঁসি দেওয়ার পুরনো দাবি তারা ঝুলি থেকে এক এক করে বার করছে৷ বিভিন্ন রাজ্যে নির্বাচনের আগে তারা এই দাবিগুলি তুলে সাম্প্রদায়িক মেরুকরণ ঘটিয়ে কোথাও কোথাও সফলও হয়েছে৷ বর্তমানে রাফাল দুর্নীতি, সিবিআই অফিসারদের ঘুষ কেলেঙ্কারি, ব্যাঙ্কে গচ্ছিত জনসাধারণের হাজার হাজার কোটি টাকা নীরব মোদি, মেহুল চোকসি প্রমুখ বৃহৎ ব্যবসায়ীদের হাতে তুলে দেওয়া ও তাদের বিদেশে পালিয়ে যেতে সাহায্য করার অভিযোগ–সব মিলিয়ে নরেন্দ্র মোদি ও বিজেপির ভাবমূর্তির পারদ নিম্নমুখী৷ এই অবস্থায় আগামী লোকসভা নির্বাচনের দিকে তাকিয়ে তারা আবার সাম্প্রদায়িক জিগির তুলতে ঝাঁপিয়ে পড়েছে৷
কিন্তু বিজেপি জানে যে ধর্মীয় জিগির তৈরি করে দু–একটা নির্বাচন হয়ত পার করা যায়, বেশিদিন ক্ষমতায় টিকে থাকা যায় না৷ সাম্প্রদায়িক উত্তেজনা চরমে উঠলে এমনিতেই ধুঁকতে থাকা বাজার আরও বিপর্যস্ত হবে, দেশের মধ্যে চরম অস্থিরতা সৃষ্টি হবে, জাতীয়–আন্তর্জাতিক নানা মহলে সরকারকে চাপে পড়তে হবে, সেই সাথে দেশের বহু সাধারণ মানুষ যাঁরা দাঙ্গা চান না, তাঁরাও বিক্ষুব্ধ হবেন৷ ফলে বিজেপি ও তার চালক আর এস এস ‘দেশপ্রেম’–এর ধুয়ো তুলছে৷ তারা দেখাতে চাইছে সংঘ পরিবারই সাচ্চা দেশপ্রেমিক৷ নির্বাচনী বিভিন্ন সভায়, নানা সাংবাদিক সম্মেলনে, পার্লামেন্টের ভাষণে তারা এই ধরনের বক্তব্য রাখছেন৷ যদি আপনি কাশ্মীরে কিংবা মণিপুরে সাধারণ মানুষের উপর ভারতীয় সেনার অত্যাচার নিয়ে প্রশ্ন তোলেন, যদি ‘নোটবন্দি’ নিয়ে দ্বিমত পোষণ করেন, তা হলে ওদের দৃষ্টিতে আপনি ‘দেশদ্রোহী’৷ প্রগতিশীল যুক্তিবাদী লেখক–সাংবাদিক হত্যা হলেও আপনাকে চুপ করে থাকতে হবে, কারণ তারা ‘দেশদ্রোহী’ আর এঁদের হত্যার বিরুদ্ধে আপনি দাঁড়ালে আপনিও ‘দেশদ্রোহী’৷ এ দেশে একমাত্র দেশপ্রেমিক বিজেপি–আর এস এস৷ সংঘ পরিবারের এহেন প্রচারে সাধারণ মানুষের একাংশের মধ্যে বিভ্রান্তির সম্ভাবনা থেকে যায়৷ ফলে ইতিহাসের পাতা উল্টে দেখা জরুরি– বিজেপি–আর এস এস–হিন্দু মহাসভা তথা হিন্দুত্ববাদীদের ‘দেশপ্রেমের’ প্রকৃত ইতিহাসটা কী?
আমাদের দেশ ভারত যখন ব্রিটিশের উপনিবেশ ছিল, যখন দেশের তরুণেরা মুক্তির মন্দির সোপান তলে আত্ম বলিদান দিয়েছে, তখন কী ভূমিকা নিয়েছিল আরএসএস?
আরএসএস–এর প্রতিষ্ঠা ১৯২৫ সালে৷ প্রতিষ্ঠাতা ডঃ হেডগেওয়ারের পরে এম এস গোলওয়ালকর আরএসএস–এর পরিচালক হন৷ স্বাধীনতা আন্দোলন সম্পর্কে আর এস এস–এর দৃষ্টিভঙ্গি প্রসঙ্গে গোলওয়ালকর বলেছিলেন, ‘‘ব্রিটিশ বিরোধিতাকে ভাবা হচ্ছে দেশপ্রেম ও জাতীয়তাবাদের সমার্থক৷ এই প্রতিক্রিয়াশীল দৃষ্টিভঙ্গি আমাদের সমগ্র স্বাধীনতা আন্দোলন, তার নেতৃবর্গ ও সাধারণ মানুষের উপর বিনাশকারী প্রভাব ফেলেছিল’’ (চিন্তাচয়ন, ১ম খণ্ড, পৃ: ১২৫)৷ অর্থাৎ আর এস এস–এর কাছে ব্রিটিশ বিরোধী স্বাধীনতা আন্দোলন ছিল একটি ‘প্রতিক্রিয়াশীল আন্দোলন’৷ ফলে এই দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে চলা আর এস এস যে সর্বদাই জাতীয় স্বাধীনতা আন্দোলন থেকে নিজেদের বিচ্ছিন্ন করে রাখবে এতে অবাক হওয়ার কিছু নেই৷ বাস্তবে স্বাধীনতা আন্দোলনে সশস্ত্র বা শান্তিপূর্ণ কোনও সংগ্রামেই আর এস এস অংশগ্রহণ করেনি৷ এহেন আর এস এসকে কি দেশপ্রেমিক বলা যায়?
আর এস এস ভারতীয় জাতীয়তাবাদকেই স্বীকার করে না৷ হিন্দু–মুসলিম–বৌদ্ধ ইত্যাদি বিভিন্ন ধর্মের মানুষের শত–সহস্র বছরের প্রচেষ্টার মধ্য দিয়ে এবং পরিশেষে ইংরেজ সাম্রাজ্যবাদের অধীনে একই শোষণ–যন্ত্রণা, একই অত্যাচার–বঞ্চনার শিকার হওয়ার কারণে ঐক্যবদ্ধ জাতি হিসাবে ভারতের গড়ে ওঠাকেই তারা অস্বীকার করে৷ তাদের মতে, ‘‘আমাদের দেশের হাজার হাজার বছরের ইতিহাস এই কথাই বলে যে, সব কিছু করেছে একমাত্র হিন্দুরা৷ এর অর্থ কেবল হিন্দুরাই এই মাটির সন্তান হিসেবে এখানে বসবাস করেছে’’ (গোলওয়ালকর, চিন্তাচয়ন, ২য় খণ্ড, পৃঃ ১২৩–২৪)৷ আর এস এস–এর এই বক্তব্য বিবেকানন্দের চিন্তার, রবীন্দ্রনাথের চিন্তার বিরোধী৷ বিবেকানন্দ বলেছেন, ‘কোনও সভ্যতা সম্পূর্ণ স্বতন্ত্রভাবে গড়িয়া উঠিয়াছে, এরূপ দৃষ্টান্ত একটিও পাওয়া যায় না৷ একটি সুসভ্য জাতি আসিয়া কোনও জাতির সহিত মিশিয়া যাওয়া ছাড়াই যে জাতি সভ্য হইয়া উঠিয়াছে–এরূপ একটি জাতিও জগতে নাই৷’’ (বিবেকানন্দ রচনাবলি, ৩য় খণ্ড, পৃঃ ৩৪২)৷ রবীন্দ্রনাথও বলেছেন, ‘‘ভারতবর্ষের কেবল হিন্দু চিত্তকে স্বীকার করলে চলবে না৷ ভারতবর্ষের সাহিত্য, শিল্পকলা, স্থপতিবিজ্ঞান প্রভৃতিতেও হিন্দু–মুসলমানের সংমিশ্রণে বিচিত্র সৃষ্টি জেগে উঠেছে৷ তারই পরিচয়ে ভারতবর্ষীয়ের পূর্ণ পরিচয়’’ (রবীন্দ্র রচনাবলি, ১৪ শ খণ্ড, পৃঃ ২৫৯, বিশ্বভারতী সংস্ক্রণ)৷
জাতি গঠনের বৈজ্ঞানিক নিয়মকে তথাকথিত হিন্দুত্ববাদীরা কখনওই স্বীকার করেনি৷ তারা সর্বদাই হিন্দুরাষ্ট্রের দাবি করেছে৷ পরাধীন ভারতে তাদের শত্রু ব্রিটিশরা ছিল না, ছিল মুসলমানরা৷ এখনও তারা শোষক পুঁজিপতিদের নয়, শত্রু মনে করে মুসলিমদের৷ হায় রে দেশপ্রেম!
হিন্দু মহাসভাই প্রথম দেশভাগের দাবি তুলেছিল
সংঘ পরিবারের দেশ সেবকরা (!) দেশভাগের জন্য একতরফা ভাবে মুসলিম লিগ ও মুসলিম মৌলবাদী শক্তিগুলিকেই দায়ী করে৷ ১৯০৬ সালের ৩০ ডিসেম্বর ঢাকায় মুসলিম লিগের প্রতিষ্ঠা হয়৷ ৩৪ বছর পর ১৯৪০ সালের ২৩ মার্চ লাহোরে লিগের ওয়ার্কিং কমিটির মিটিংয়েই তারা প্রথম পৃথক দেশের দাবি তোলে৷ কিন্তু তার ঢের আগে ১৯২৩ সালেই হিন্দু মহাসভার নেতা বি ডি সাভারকার ধর্মভিত্তিক পৃথক দেশের ধারণা উপস্থিত করেছিলেন৷ তিনি ‘হিন্দুত্ব’ নামক গ্রন্থে ভারতবর্ষে হিন্দু এবং মুসলিম দুটি পৃথক জাতির তত্ত্ব পেশ করেন৷ ঐতিহাসিক রমেশচন্দ্র মজুমদার তাই বলেছেন, ‘‘সাম্প্রদায়িক পথে ভারত বিভাগের ধারণাটির উদ্ভাবনের জন্য বিপুল পরিমাণে দায়ী হল হিন্দু মহাসভা’’৷ তিনি আরও বলেছেন, ‘‘মুসলিম লিগ সাভারকারের ওই বক্তব্যকে অত্যন্ত গুরুত্বের সঙ্গে হৃদয়ঙ্গম করেছিল’’৷ ফলে এটা পরিষ্কার, ভারতভাগের জন্য হিন্দু মৌলবাদ ও মুসলিম মৌলবাদ উভয়ই দায়ী৷
ধর্মভিত্তিক জাতি বাস্তবে দাঁড়ায় না৷ ইউরোপের বিভিন্ন দেশে খ্রিস্টানরা সংখ্যাগরিষ্ঠ হলেও, ধর্মের ভিত্তিতে তারা কিন্তু ঐক্যবদ্ধ থাকতে পারেনি৷ সেখানে কয়েক ডজন পৃথক দেশ রয়েছে৷ সমগ্র মধ্যপ্রাচ্যে ইসলাম ধর্মও একটি ঐক্যবদ্ধ দেশ গঠন করতে পারেনি৷ যদি মুসলিমরা ধর্মের ভিত্তিতে একটি জাতি হত তাহলে পাকিস্তান ভেঙে বাংলাদেশ সৃষ্টি হত না৷ এ দেশে হিন্দুর সঙ্গে ‘জাতির’ বিষয়টিকে অত্যন্ত ধূর্ততার সাথে গুলিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করে হিন্দুত্ববাদীরা৷ কিন্তু তাদের এই প্রশ্নটির তো উত্তর দিতে হবে, হিন্দুমাত্রেই যদি এক জাতি হয়, তা হলে নেপালের হিন্দুরা কোন জাতি?
আর এস এস–এর দৃষ্টিতে অসহযোগ আন্দোলন ছিল অশুভশক্তির জাগরণ
ব্রিটিশ বিরোধী অসহযোগ আন্দোলন গোটা দেশে ১৯২১–২২ সালে তীব্র রূপে ফেটে পড়েছিল৷ ধর্ম–বর্ণ–সম্প্রদায়গত পার্থক্য গৌণ করে হাজার হাজার মানুষ এক হয়ে আন্দোলনে নেমেছিলেন৷ অবিভক্ত বাংলাতেও এই আন্দোলন প্রবলভাবে আছড়ে পড়েছিল৷ দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাশ, সুভাষচন্দ্র বসু প্রমুখ নেতা সহ হাজার হাজার সত্যাগ্রহীকে ব্রিটিশ পুলিশ গ্রেপ্তার করে৷ আর এই গণসংগ্রামের মধ্যে আর এস এস প্রতিষ্ঠাতা ডাঃ হেডগেওয়ার দেখতে পেলেন ‘অশুভ শক্তির জাগরণ’৷ তাঁর কথায়, ‘‘মহাত্মা গান্ধীর অসহযোগ আন্দোলনের ফলে দেশে উৎসাহ (জাতীয়তাবাদের জন্য) ক্রমে শীতল হয়ে যাচ্ছিল এবং এই আন্দোলন সৃষ্ট অশুভ শক্তিগুলি সমাজজীবনে বিপজ্জনকভাবে মাথা চাড়া দিচ্ছিল৷ …অসহযোগের দুগ্ধ পান করে বেড়ে ওঠা যবন–সর্প তার বিষাক্ত নিঃশ্বাস নিয়ে দেশে দাঙ্গার প্ররোচনা দিচ্ছিল’’ (ভিশিকার–১৯৭৯, পৃঃ ৭)৷ এই ছিল অসহযোগ আন্দোলন সম্পর্কে হেডগেওয়ার–এর বিদ্বেষপূর্ণ দৃষ্টিভঙ্গি৷
স্বাধীনতা আন্দোলনকে দেশের পক্ষে ক্ষতিকারক এবং প্রতিক্রিয়াশীল ভাবার কারণেই বিজেপির পূর্বসূরি আর এস এস দেশকে স্বাধীন করার কোনও কর্মসূচিতেই ছিল না৷ ১৯২৮ সালে সাইমন কমিশন বিরোধী আন্দোলন থেকে তারা নিজেদের দূরে সরিয়ে রাখে৷ ১৯২৯ সালে ভগৎ সিং এবং বটুকেশ্বর দত্ত দিল্লি অ্যাসেম্বলিতে বোমা নিক্ষেপ করলেন, উত্তরপ্রদেশের এলাহাবাদে আলফ্রেড পার্কে (১৯৩১ সালের ২৭ ফেব্রুয়ারি) পুলিশের সঙ্গে সংঘর্ষে নিহত হলেন বিপ্লবী নেতা চন্দ্রশেখর আজাদ, ১৯৩১ সালে ২৩ মার্চ ভগৎ সিং, শুকদেব, রাজগুরুকে ফাঁসি দিল ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদ৷ ব্রিটিশের বিরুদ্ধে গোটা দেশ যখন উত্তাল সে সময়, আর এস এস তার শরিক হল না৷ ১৯৩০ সালে কলকাতার রাইটার্স বিল্ডিং–এ বিনয়–বাদল–দীনেশ ঐতিহাসিক অলিন্দ যুদ্ধ, ১৯৩০–৩২ সালে চট্টগ্রামে মাস্টারদা সূর্য সেনের বীরত্বপূর্ণ লড়াই, প্রীতিলতার শহিদ হওয়া– কোনও ক্ষেত্রেই আর এস এস দেশের কল্যাণ দেখেনি৷ ১৯৪২–এর ভারত ছাড়ো আন্দোলন, ১৯৪৫ সালে আজাদ হিন্দ ফৌজের অফিসারদের বিচারের বিরুদ্ধে আন্দোলন, ১৯৪৬ সালে নৌ–বিদ্রোহ, ওই বছরের ২৯ জুলাই দেশব্যাপী ধর্মঘট – এসবেও আর এস এস–এর নিষ্ক্রিয় ভূমিকা ইংরেজ প্রভুদের খুশি করেছে৷
১৯৪০–এর দশকে আর এস এস–এর ভূমিকা প্রসঙ্গে আন্ডারসন এবং ডামলে বলেছেন, ‘‘গোলওয়ালকর বিশ্বাস করতেন, আর এস এস–কে নিষিদ্ধ করার কোনও রকম অজুহাত ব্রিটিশ শাসকদের দেওয়া চলবে না’’৷ ১৯৪৩ সালের ২৯ এপ্রিল গোলওয়ালকর আর এস এস–এর সদস্যদের উদ্দেশ্যে একটি নির্দেশ জারি করে আর এস এস–এর সমস্ত বিভাগগুলি বন্ধ করে দেন৷ এই আনুগত্যের স্বীকৃতিস্বরূপ আর এস এস সম্পর্কে ব্রিটিশ সরকারি প্রতিবেদনে বলা হয়, ‘‘আর এস এস আইন–শৃঙ্খলার পক্ষে এখনই বিপজ্জনক–এ কথা বলার যুক্তি নেই’’৷ অত্যাচারী ব্রিটিশ শাসকের পক্ষ থেকে ‘দেশপ্রেমিক’ আর এস এসের কাছে এর চেয়ে বড় সার্টিফিকেট আর কী হতে পারে? ভারত ছাড় আন্দোলন সম্পর্কে গোলওয়ালকর এও পর্যন্ত বলেছিলেন– ‘‘এই সংগ্রামের খারাপ ফল হতে বাধ্য৷’’ এহেন আর এস এস–এর চিন্তাকে পরাধীন ভারতের জনগণ গ্রহণ করলে দেশ স্বাধীনতা অর্জন করতে পারত না৷ এর পরেও আর এস এসকে দেশপ্রেমিক বলা যায়? না বলা উচিত দেশদ্রোহী?
হেডগেওয়ারের জেলে যাওয়ার নেপথ্যে
স্বাধীনতা আন্দোলনের বিরোধিতা করে জনগণের কাছে চূড়ান্ত ধিক্কৃত আর এস এস ডাঃ হেডগেওয়ারের জেলে যাওয়ার কাহিনী পরিবেশন করে থাকে৷ এই কলঙ্ক ঢাকতে ধূর্ত আরএসএস প্রচার করে, ১৯৩০ সালে গান্ধীজির লবণ সত্যাগ্রহের সময় হেডগেওয়ার জেলে গিয়েছিলেন৷ আরএসএস প্রকাশিত তাঁর এক জীবনী গ্রন্থে বলা হয়েছে– ‘‘১৯৩০ সালে মহাত্মা গান্ধী আইন অমান্যের ডাক দিয়েছিলেন৷ …ডাক্তার সাহেব (ডাঃ হেডগেওয়ার) সব জায়গায় খবর পাঠালেন সংঘ এই সত্যাগ্রহে অংশগ্রহণ করবে না৷ সে যাই হোক ব্যক্তিগত ভাবে যারা অংশগ্রহণ করতে চাইবে তাদের বাধা দেওয়া হবে না৷ এর অর্থ হল সংঘের কোনও দায়িত্বশীল কর্মকর্তা এতে অংশগ্রহণ করতে পারবে না’’ (সিপি ভিশিকর, সংঘবিকাশ কে বীজ, ডাঃ কেশব রাও হেডগেওয়ার, নিউ দিল্লি, পৃ: ২০)৷
তাহলে ডাঃ হেডগেওয়ার নিজে ব্রিটিশ কারাগারে গিয়েছিলেন কেন? এর উত্তর পাওয়া যাবে আর এস এস প্রকাশিত হেডগেওয়ারের জীবনী গ্রন্থেই৷ ‘‘ডাক্তার সাহেবের এই প্রত্যয় ছিল জেলের ভিতর তিনি একদল স্বদেশপ্রেমী, অগ্রগামী, নামজাদা লোক পাবেন৷ তাঁদের সাথে তিনি সংঘ নিয়ে আলোচনা করতে পারবেন এবং সংঘের কাজে তাঁদের টেনে আনতে পারবেন’’ (ঐ)৷
অর্থাৎ, স্বাধীনতা আন্দোলনের সমর্থনে হেডগেওয়ার জেলে যাননি, তিনি জেলে গিয়েছিলেন স্বাধীনতা সংগ্রামীদের যেভাবেই হোক স্বাধীনতা সংগ্রাম থেকে সরাতে৷
হিন্দু মহাসভা ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদকেই সমর্থন করেছিল
স্বাধীনতা আন্দোলনে হিন্দু মহাসভার ভূমিকা কী ছিল? যুদ্ধের সময় ব্রিটিশ সরকারের প্রতি দেশবাসীর দৃষ্টিভঙ্গি কী হবে সেই প্রসঙ্গে বিনায়ক দামোদর সাভারকর ১৯৪১ সালে ভাগলপুরে হিন্দু মহাসভার ২৩তম অধিবেশনে বলেন, ‘‘ভারতের প্রতিরক্ষার কথা বলতে গেলে, ভারত সরকারের সমস্ত যুদ্ধ প্রস্তুতিকে হিন্দুদের অবশ্যই দ্বিধাহীন চিত্তে সমর্থন করতে হবে৷ …হিন্দুদের বৃহৎ সংখ্যায় সেনাবাহিনী, নৌবাহিনী ও বিমানবাহিনীতে যোগ দিতে হবে’’ (সাভারকর সমগ্র, খণ্ড–৬, মহারাষ্ট্র প্রান্তিক হিন্দু সভা, পুণা, ১৯৬৩, পৃ: ৪৬০)৷
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় ব্রিটিশ সরকার তার সাম্রাজ্যবাদী লক্ষ্য পূরণের জন্য যখন নতুন সশস্ত্র ব্যাটেলিয়ান তৈরির সিদ্ধান্ত নিল তখন সাভারকরের নেতৃত্বে হিন্দু মহাসভা সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে, এই প্রচেষ্টাকে সফল করতে একটা বড় সংখ্যক হিন্দু যুবকের নাম নথিভুক্ত করাতে হবে৷ সেদিন হিন্দু মহাসভা ব্রিটিশের যুদ্ধ প্রচেষ্টাকে সাহায্য করার জন্য দেশের নানা প্রান্তে সহায়ক কেন্দ্র খুলেছিল যাতে হিন্দু যুবকেরা সহজেই ব্রিটিশ সেনাবাহিনীতে যোগ দিতে পারে৷ এই বাহিনীকেই ব্রিটিশ পাঠিয়েছিল আজাদ হিন্দ ফৌজের সেনাদের হত্যা করতে৷ সাভারকর সেই কাজে ব্রিটিশদের পাশে ছিলেন৷ দেশপ্রেমের নামে কি নির্লজ্জ গোলামি!
এই গোলামির পুরস্কারস্বরূপ ভাইসরয়ের জাতীয় প্রতিরক্ষা কাউন্সিলে সাভারকরের পছন্দমতো লোক মনোনীত করা হল৷ সে জন্য টেলিগ্রামে ভাইসরয়কে ধন্যবাদ দিলেন সাভারকর৷ টেলিগ্রামটি এই রকম, ‘‘ইওর এক্সেলেন্সিজ অ্যানাউন্সমেন্ট ডিফেন্স কমিটি উইথ ইটস পারসোনেল ইজ ওয়েলকাম হিন্দু মহাসভা ভিউজ উইথ স্পেশাল স্যাটিসফেকশন অ্যাপয়েন্টমেন্ট অফ মেসার্স কালিকর অ্যান্ড জমনদাস মেহতা’’ (বিনায়ক দামোদর সাভারকর হোয়্যার্ল উইন্ড প্রোপাগান্ডা– এ এস বিন্দে, পৃঃ ৪৫১)৷ এমনই ছিল হিন্দু মহাসভার নেতা সাভারকারের সঙ্গে ব্রিটিশের সম্পর্ক বীর স্বাধীনতা সংগ্রামীই বটে!
মুচলেকা দিয়ে ব্রিটিশের কাছে আত্মসমর্পণ করেছিলেন সাভারকর
সাভারকর প্রথম জীবনে স্বদেশি আন্দোলনে যোগ দিয়েছিলেন৷ ১৯০৭–১৯০৯, এই ক’বছর তিনি নানা বিপ্লবী উদ্যোগ গ্রহণ করেছিলেন৷ ১৯১০ সালের মার্চে প্যারিসে তিনি গ্রেপ্তার হন৷ কিন্তু বহু অনামী বিপ্লবীরাও যে কাজ করতে ঘৃণা বোধ করতেন, সেই কাজটিই করলেন ‘বীর’ সাভারকর৷ ১৯১১ সালের ৩০ আগস্ট তিনি ক্ষমাভিক্ষার আবেদন করলেন৷ সে চিঠি খারিজ হয়ে যায়৷ ১৯১৪ সালের ১৪ নভেম্বর সাভারকর আবার ক্ষমাভিক্ষার আবেদন করলেন৷ সাভারকর লিখেছিলেন, ‘‘ …সরকার যদি তাদের বহুমুখী দয়ার দানে আমাকে একটু মুক্ত করে দেন তবে আমি আর কিছু পারি বা না পারি চিরদিন সাংবিধানিক প্রগতি এবং ব্রিটিশ সরকারের আনুগত্যের অবিচলিত প্রচারক হয়ে থাকব৷ …সরকার আমাকে যত কাজ করতে বলবে, সেই মতো প্রায় সব কাজ আমি করতে প্রস্তুত৷ কেন না আমার আজকের পরিবর্তন যেহেতু বিবেকের দ্বারা পরিচালিত, তাই আমার ভবিষ্যতের আচরণও সেই রকমই হবে৷ অন্যভাবে যা পাওয়া যেতে পারে সে তুলনায় আমাকে জেলে আটকে রাখলে কিছুই পাওয়া যাবে না৷ শক্তিশালীর পক্ষেই একমাত্র ক্ষমাশীল হওয়া সম্ভব৷ কাজেই অনুতপ্ত সন্তান পিতৃতুল্য সরকারের দরজায় ছাড়া আর কোথায় ফিরে যাবে? মহামান্য হুজুর অনুগ্রহ করে বিষয়গুলি বিবেচনা করবেন এই আশা রইল’’ (পেনাল সেটলমেন্টস ইন আন্দামানস, আর সি মজুমদার, পৃ: ২১১–১৩)৷
ক্ষমার জন্য কোনও ভিক্ষা, কোনও আবেদন, এর চেয়ে বেশি নীচ, বেশি হীন হতে পারে না৷ ক্ষমাভিক্ষার আবেদনের ছত্রে ছত্রে ফুটে উঠেছে একজন আত্মমর্যাদাহীন ব্যক্তির আত্মসমর্পণ৷ যে দেশের স্বাধীনতা সংগ্রামীরা হাসতে হাসতে ফাঁসির দড়িকে চুম্বন করেছেন, সেই দেশের একজন ‘স্বাধীনতা সংগ্রামী’ হয়ে সাভারকর জেল থেকে বাইরে আসার জন্য নীতি–আদর্শ–মর্যাদা– সবই হেলায় বিসর্জন দিয়েছেন৷ এই হল হিন্দুত্ববাদী নেতা সাভারকরের দেশপ্রেমের নমুনা৷
হিন্দুত্ববাদী এই সব সংগঠনের যেমন ব্রিটিশপ্রীতি ছিল অফুরান, তেমনি ছিল মুসলিম লিগেরও৷ হিন্দু মহাসভা মুসলিম লিগের সাথে বাংলা, সিন্ধু ও উত্তর–পশ্চিম সীমান্ত প্রদেশে কোয়ালিশন মন্ত্রীসভা পরিচালনা করছিল৷ এর পিছনে যে ব্রিটিশ সরকারের মদত ছিল তাতে সন্দেহ নেই৷ ওই সময় সম্পর্কে হিন্দু মহাসভার কানপুর অধিবেশনে (১৯৪২) সাভারকর বলেছিলেন, ‘‘বাস্তব রাজনীতির ক্ষেত্রে হিন্দু মহাসভা জানে যুক্তিসঙ্গত আপসের দ্বারাই আমাদের এগোতে হবে৷ এই যুক্তিসঙ্গত আপসের প্রমাণ হল সম্প্রতি সিন্ধু প্রদেশে একত্রে সরকার চালানোর জন্য হিন্দু মহাসভা মুসলিম লিগের আমন্ত্রণ গ্রহণ করেছে৷ … ফজলুল হকের প্রধানমন্ত্রীত্বে এবং আমাদের পরম শ্রদ্ধেয় নেতা শ্যামাপ্রসাদ মুখার্জীর পরিচালনায় কোয়ালিশন মন্ত্রীসভা সাফল্যের সাথেই চলছে’’ (সাভারকর সমগ্র– খণ্ড ৬, পৃ: ৭৯–৮০)৷
এই কোয়ালিশন মন্ত্রীসভা ব্রিটিশ বিরোধিতার জন্য তৈরি হয়নি৷ সাভারকরের ‘পরম শ্রদ্ধেয়’ শ্যামাপ্রসাদ মুখার্জী বলেছিলেন, ‘‘এখন যুদ্ধকালীন অবস্থায় জাতীয় গভর্নমেন্ট এমনভাবে গঠিত হবে যাতে মিত্রপক্ষের সঙ্গে নিবিড় সহযোগিতায় যুদ্ধ করা সম্ভব হয়’’ (রাষ্ট্র সংগ্রামের এক অধ্যায়, শ্যামাপ্রসাদ, পৃঃ ১১৬)৷ শ্যামাপ্রসাদ মুখার্জী ’৪২–এর ভারত ছাড়ো আন্দোলনেরও বিরোধিতা করেছিলেন৷ তিনি বলেছিলেন, ‘‘আমি মনে করি না, গত তিন মাসের মধ্যে যেসব অর্থহীন উচ্ছৃঙ্খলতা ও নাশকতামূলক কাজ করা হয়েছে, তার দ্বারা আমাদের দেশের স্বাধীনতা লাভের সহায়তা হবে’’ (রাষ্ট্র সংগ্রামের এক অধ্যায় শ্যামাপ্রসাদ মুখার্জী, পৃঃ ৬১)৷ ভারত ছাড়ো আন্দোলন শ্যামাপ্রসাদের কাছে ‘অর্থহীন উচ্ছৃঙ্খলতা’ ও ‘নাশকতামূলক’ কাজকর্ম৷ তাই তিনি মনে করেছেন, এই আন্দোলন দমন করা উচিত এবং কীভাবে এই আন্দোলন দমন করা যায় তার একটা তালিকাও তিনি ব্রিটিশ সরকারের কাছে পেশ করেছেন৷ ব্রিটিশের কী নির্লজ্জ দালালি!
শ্যামাপ্রসাদ মুখার্জীর কীর্তি এখানেই শেষ নয়৷ নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসুর নেতৃত্বে যখন আজাদ হিন্দ ফৌজ বীরত্বের সাথে লড়াই করছিল, সেই সময় শ্যামাপ্রসাদ মুখার্জী ইংরেজ সাম্রাজ্যবাদকে সহায়তা করার জন্য আগ বাড়িয়ে বললেন, ‘‘বঙ্গদেশকে রক্ষা করিবার জন্য একটা গৃহবাহিনী গঠনের অধিকার আমাদের দেওয়া হউক’’ (রমেশচন্দ্র মজুমদার লিখিত ‘বাংলাদেশের ইতিহাস’ গ্রন্থে উল্লিখিত শ্যামাপ্রসাদ মুখার্জীর পত্র থেকে উদ্ধৃত)৷ শ্যামাপ্রসাদ মুখার্জী সুভাষচন্দ্রের পক্ষে না থেকে ব্রিটিশের পক্ষে ছিলেন৷ এর পরেও কেউ শ্যামাপ্রসাদ মুখার্জীকে স্বাধীনতা সংগ্রামী বলতে পারেন?
বিজেপি–আর এস এসের বর্তমান ভূমিকাও অশুভ
হিন্দু মহাসভা থেকে ‘জনসংঘ’ গড়ে তুলেছিলেন শ্যামাপ্রসাদ মুখার্জী, আর সেই ‘জনসংঘ’ থেকেই জন্ম আজকের ‘ভারতীয় জনতা পার্টি’ বা ‘বিজেপি’–র৷ সেই বিজেপিই আজ দেশপ্রেমের ধ্বনি তুলছে৷ যে নেতাজির আজাদ হিন্দ বাহিনীর বিরুদ্ধে লড়তে হিন্দুদের আহ্বান জানিয়েছিলেন শ্যামাপ্রসাদ মুখার্জী, তাদেরই উত্তরসূরি বিজেপি আজ আজাদ হিন্দ বাহিনীর ৭৫ বছর উদ্যাপন করছে৷ এটা ভণ্ডামি ছাড়া আর কী?
শুধু পরাধীন ভারতেই নয়, স্বাধীনতার পরও বিজেপির ভূমিকা সমাজ প্রগতির বিরুদ্ধে৷ বিশেষ করে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির নেতৃত্বে যেভাবে উগ্র হিন্দুত্ববাদী তৎপরতা চলছে, ধর্মনিরপেক্ষতার উপর, সংখ্যালঘু জনগণের উপর আক্রমণ নামিয়ে আনা হচ্ছে তা খুবই বিপজ্জনক৷ একই সাথে দেশি–বিদেশি পুঁজিপতি শ্রেণির স্বার্থে জনগণের উপর নানা অন্যায় জুলুম চলছে৷ হরণ করা হচ্ছে শ্রমিক কর্মচারীদের অধিকার৷ এই অপশক্তিকে সমূলে উৎপাটন করা আজ সমাজ প্রগতির স্বার্থে অত্যন্ত প্রয়োজন৷