‘আইন সবার জন্য সমান’ এর চেয়ে বড় প্রহসন আর কী হতে পারে!

 

ধৃত অভিযুক্তের জামিন মঞ্জুর করা আদালতের কাজ, নাকি নাকচ করা? ন্যায় বিচার বলে জীবনের অধিকারের মতোই, স্বাধীন ও মুক্ত থাকা নাগরিকের মৌলিক অধিকার। তাই জামিনই নিয়ম, পুলিশ বা জেল হেফাজত ব্যতিক্রম– বিচারব্যবস্থার সর্বস্তরে এ কথা সবসময় মনে রাখতে হয়, বারবার মনে করিয়ে দিতে হয়।

সম্প্রতি এ কথা আবার মনে করাতে গিয়ে বিচারপতি সঞ্জয় কিসন কউলের নেতৃত্বে সুপ্রিম কোর্টের তিন সদস্যের একটি বেঞ্চ হাইকোর্টগুলিকে নির্দেশ দিয়েছে, যে বিচারকরা যথেষ্ট বিবেচনা না করেই বহুক্ষেত্রে জামিনের আবেদন খারিজ করছেন, অভিযুক্তকে পুলিশ বা জেল হেফাজতে পাঠানো প্রায় নিয়মে পরিণত করেছেন। ক্ষোভের সাথে বেঞ্চ বলেছে, এই জাতীয় বিচারকদের আইনের পাঠ নিতে বিচারের কাজ থেকে অব্যাহতি দিয়ে পুনরায় আইন শিক্ষালয়ে পাঠাতে।

২০২২ সালের নভেম্বরে ভারতের প্রধান বিচারপতি বার কাউন্সিলের একটি অনুষ্ঠানে বলেছেন যে, হাইকোর্টগুলিতে জামিনের আবেদনের পাহাড় জমছে, কারণ নিম্ন আদালতে জামিন মিলছে না। এমনকি এলাহাবাদ হাইকোর্ট থেকে আসা একটি মামলায় প্রধান বিচারপতি বলেছেন, ‘যদি আমরা ব্যক্তি স্বাধীনতার বিষয়টি রক্ষা করতে না পারি, তাহলে আমরা রয়েছি কেন? এখানে কী করছি আমরা?’

ন্যাশনাল ক্রাইম রেকর্ড বুরোর ৩১ ডিসেম্বর ২০২১-এর তথ্য অনুসারে ৫ লক্ষ ৫৪ হাজার ৩৪ জন জেলবন্দির মধ্যে ৪ লক্ষ ২৭ হাজার ১৬৫ জন বিচারাধীন। চার লাখের বেশি এই বিচারাধীন বন্দি অনেকেই হয়ত নিরপরাধ বলে প্রমাণিত হবেন। কিন্তু তাঁরা জানেন না, কবে তাঁদের বিচার শেষ হবে। তাঁরা এও জানেন না, খোলা আকাশের নিচে গিয়ে দাঁড়াবার সুযোগ এ জীবনে আদৌ মিলবে কি না। এই অনন্ত বিচারপ্রক্রিয়ার শেষ দেখা যায় না। অর্থাৎ জামিনের বুনিয়াদি অধিকারটিই এখানে অস্বীকৃত হচ্ছে।

সাতেন্দর কুমার আন্তিল বনাম সিবিআই মামলায় সুপ্রিম কোর্ট গ্রেফতার এবং জামিনের বিষয়ে বিস্তৃত গাইডলাইন দিয়েছিল। সম্প্রতি সুপ্রিম কোর্টের দুই বিচারপতি সঞ্জয় কিসন কউল এবং এম এম সুন্দরেশ সংবিধান ও বিভিন্ন আইনের নানা ধারা বিশ্লেষণ করে জামিন দেওয়ার বিষয়ে এক বিস্তারিত নির্দেশনামা বা গাইডলাইন তৈরি করে দিয়েছেন। অকারণ গ্রেফতারি যে কোনও দেশকে পুলিশ রাষ্ট্রে পরিণত করে। গ্রেফতার করা বা জামিন খারিজ করার বিষয়ে সুপ্রিম কোর্টের যে রায়গুলিতে বিশদে বলা হয়েছে, সেগুলিকে আইনের পাঠক্রমে রাখারও নির্দেশ দিয়েছিল সুপ্রিম কোর্ট। তা সত্তে্বও বিভিন্ন রাজ্যের নিম্ন আদালতগুলি জামিনের আবেদন খারিজ করাকেই নিয়মে পরিণত করেছে। বিশেষত উত্তরপ্রদেশ, ওড়িশা, অসম এবং তামিলনাড়ুর পরিস্থিতি নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছে তিন সদস্যের বেঞ্চ।

নিরপরাধ হয়েও কেবল মামলার খরচ জোগাড় করতে না পারায় বহু বছর জেলবন্দি থেকে অবশেষে নির্দোষ প্রমাণিত হয়েছেন, এমন নিদর্শনও প্রচুর। সাম্প্রতিক কালে রাজনৈতিক প্রতিহিংসার কারণে মিথ্যা মামলা এবং গ্রেফতার করে জেলবন্দি করার ঘটনাও আশঙ্কাজনক ভাবে বেড়ে চলেছে। মানবাধিকার কর্মী, লেখক, শিক্ষক, সাংবাদিক সহ অসংখ্য সাধারণ নাগরিক জামিন না পেয়ে জেলের অভ্যন্তরে দুঃসহ জীবন কাটাচ্ছেন।

জামিন না দেওয়ার ব্যতিক্রমকে নিয়মে পরিণত করেছে যে আদালতগুলি, তারাও কিন্তু কোনও কোনও ক্ষেত্রে নিজেদের গড়া নিয়মের ব্যতিক্রম ঘটায়। যেমন, যে সুপ্রিম কোর্টে শত শত জামিনের আবেদন পড়ে আছে, অসংখ্য হেবিয়াস কর্পাস পিটিশনে ধুলো জমছে, সেই সুপ্রিম কোর্টেই মধ্যরাতে অর্ণব গোস্বামী মামলার শুনানি হয়। অর্ণব গোস্বামী মামলায় সুপ্রিম কোর্টের প্রধান বিচারপতির পর্যবক্ষেণ হল, ‘ডিপ্রাইভেশন অফ লিবার্টি ফর এ সিঙ্গল ডে ইজ এ ডে টু মেনি’। অর্থাৎ, স্বাধীনতা থেকে মাত্র এক দিন বঞ্চিত হওয়ার অর্থ বহু দিনের বঞ্চনা। দুঃখের হলেও এ কথা সত্য যে, অধিকাংশ ক্ষেত্রেই এ কথা মনে রাখা হয় না।

সম্প্রতি উত্তরপ্রদেশের লখিমপুর খেরির ঘটনা আবারও চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেয়, আইন সবার জন্য সমান নয়। উত্তরপ্রদেশের বিজেপি সাংসদ কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী অজয় মিশ্রর ছেলে আশিস মিশ্র কৃষকদের মিছিলের উপর তার এসইউভি গাড়ি চালিয়ে দেয়। আটজন ঘটনাস্থলেই মারা যান, আহত হন আরও অনেকে। তা সত্ত্বেও রাজ্যের বিজেপি সরকারের পুলিশ আশিস মিশ্রকে গ্রেফতার করে না। সুপ্রিম কোর্টে পুলিশি নিষ্ক্রিয়তার বিরুদ্ধে জনস্বার্থ মামলা দায়ের হয়। পুলিশ খুনি ওই মন্ত্রীপুত্রকে গ্রেফতার করতে বাধ্য হলেও এলাহাবাদ হাইকোর্টের এক সদস্যের বেঞ্চে সঙ্গে সঙ্গেই তাকে জামিন দেওয়া হয়। সুপ্রিম কোর্টে আবার মামলা হয়। হাইকোর্ট বাধ্য হয়ে জামিন বাতিল করে। আশিস মিশ্র সুপ্রিম কোর্টে আবেদন করে। সুপ্রিম কোর্টের যে বেঞ্চ জামিন বাতিল করেছিল, এবার তারাই জামিনের পক্ষে দুটি কারণ দেখায়। প্রথমত, অভিযুক্ত এক বছরের বেশি হেফাজতে আছে। দ্বিতীয়ত, এই মামলা শেষ হতে প্রায় পাঁচ বছর লাগবে, তাই পরীক্ষামূলকভাবে তার জামিন মঞ্জুর করা হয়। যে গণহত্যাকারী প্রকাশ্য দিবালোকে আটজনকে পিষে মেরে দিল, বহু মানুষকে আহত করল, তাকে পরীক্ষামূলকভাবে জামিন দেওয়া অত্যন্ত বিস্ময়কর নয় কি? সুপ্রিম কোর্টের এই পরীক্ষা ব্যর্থ হলে যে ক্ষতি হবে, তা আর মেরামত করা যাবে কি?

বিচারালয়গুলিতে ন্যায়বিচারের প্রতীকি মূর্তিটির দুটি চোখ কাপড়ে বাঁধা থাকে। এর অর্থ, ন্যায়বিচার পক্ষপাতিত্বহীন। বলা হয়, আইনের চোখে সকলেই সমান। কিন্তু বাস্তব অভিজ্ঞতা বিপরীত কথা বলে। রাজনৈতিক ভাবে প্রভাবশালী হওয়ার দরুন আশিস মিশ্র দিনের আলোয় সকলের চোখের সামনে ৮ জন মানুষকে হত্যা করেও জামিন পেয়ে যায়। অথচ সামান্য অপরাধ করে, এমনকি কোনও অপরাধ না করেই যে লক্ষ লক্ষ সাধারণ বিচারাধীন বছরের পর বছর দণ্ড ভোগ করে চলে, তাদের ক্ষেত্রে এই ধরনের ‘পরীক্ষামূলক জামিন’ দেওয়ার ভাবনাই বিচারব্যবস্থার কর্তাদের মনে আসে না।

আসলে শ্রেণিবিভক্ত ও শোষণমূলক এ দেশের সমাজে শুধু আইন কেন, কোনও কিছুর উপরেই সকল নাগরিকের সমান অধিকার নেই। পুঁজিবাদী এই সমাজ ব্যবস্থায় রাষ্টে্রর শাসক পুঁজিপতি শ্রেণি ও তার সেবাদাস সরকারগুলির নেতা-মন্ত্রীদের জন্য আইন আর শ্রমিক-কৃষক খেটে-খাওয়া সাধারণ মানুষের জন্য আইন, বিচারালয়ের বিচারপদ্ধতি কখনই সমান নয়, সমান হতে পারে না। কারণ এই ব্যবস্থায় শোষণের জন্য, শোষক শ্রেণির স্বার্থসিদ্ধির জন্যই আইন, বিচারালয়, বিচারপদ্ধতি এই সমস্ত কিছুর সৃষ্টি। তাই রাতারাতি আশিস মিশ্ররা খালাস পেলেও বছরের পর বছর গারদের দেওয়ালে মাথা ঠুকে মরতে হয় নিরপরাধ অসহায় বিচারাধীন গরিব মানুষকে