আবারও রক্তাক্ত হল কলকাতার রাজপথ। এসইউসিআই (কমিউনিস্ট) দলের কর্মী এবং প্রতিবাদী জনতার রক্ত ঝরলো তৃণমূল শাসিত রাজ্য সরকারের পুলিশের বর্বরোচিত আক্রমণে। প্রাক্তন সাংসদ তরুণ মণ্ডল, প্রাক্তন বিধায়ক তরুণ নস্কর সহ ৭৯ জনকে পুলিশ গ্রেপ্তার করে। এদের মধ্যে ২৯ জন মহিলা এবং ২০ জন গুরুতর আহত। পুরুষ পুলিশের তাণ্ডবের শিকার হতে হয়েছে মহিলা আইন অমান্যকারীদেরও। এছাড়াও শতাধিক কর্মী আহত হয়েছেন। মহানগরী সাক্ষী থাকল একদিকে অতীতের সরকারগুলির মতোই বর্তমান সরকারের পুলিশের ঘৃণ্য আক্রমণের, আর অন্যদিকে প্রত্যক্ষ করল প্রতিবাদমুখর ছাত্র-যুব-শ্রমিক-কৃষক-মহিলার লড়াকু মানসিকতার। শোষণ, নিপীড়ন, জীবনের জ্বালা-যন্ত্রণা সহ্যের সীমা ছাড়িয়ে গিয়েছে। আজ তাই শুধু প্রতিবাদ নয়– গড়ে তুলতে হবে গণ প্রতিরোধ। সেই উদ্দেশ্য নিয়েই অগণিত মানুষ সুশৃঙ্খলভাবে সামিল হয়েছিলেন পূর্ব ঘোষিত আইন অমান্য আন্দোলনে। রামলীলা পার্ক থেকে মিছিল শুরু হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে পুলিশ মিছিলের পথ আটকায়। কিন্তু আন্দোলনকারীদের বলিষ্ঠতায় পুলিশ পিছু হঠতে বাধ্য হয়। তালতলাতে পুলিশ মিছিল আটকাতে চাইলে আবারও ব্যর্থ হয়, পুলিশি বাধা অতিক্রম করে দৃপ্ত মিছিল এগিয়ে চলে। মিলিত কন্ঠে তারা রাজ্য সরকারের বিরুদ্ধে স্লোগান তুলেছিলেন – এসএসসি, নার্স সহ বিভিন্ন স্তরের সরকারি কর্মী নিয়োগে চরম দুর্নীতি ও স্বজন পোষণ এবং আকাশছোঁয়া মূল্যবৃদ্ধির বিরুদ্ধে। রাজ্যবাসীর পক্ষ থেকে তারা প্রশ্ন তুলেছিলেন, কেন শিক্ষাবিদদের পরিবর্তে মুখ্যমন্ত্রীকে আচার্য পদে বসানো হবে? কেন স্কুল শিক্ষার সর্বনাশ সাধিত হবে? কেন রাজ্যে শিক্ষাক্ষেত্রে সরকারি দপ্তরে লক্ষ লক্ষ শূন্যপদে কর্মী নিয়োগ করা হচ্ছে না? আজও খেতমজুরের সারা বছরের কাজ, চা শ্রমিকদের ন্যনতম মজুরির নিষ্পত্তি হল না কেন? কেন মা-বোনেদের সম্ভ্রম ধূলায় লুণ্ঠিত হবে? কেন তাদের অকালে নির্যাতিতা হয়ে খুন হতে হবে? দোষীদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি না দিয়ে কেন অভিযুক্ত শাসক দলের নেতা-কর্মীদের আড়াল করা হবে? ‘দুয়ারে মদ’ প্রকল্প অবিলম্বে বাতিলের দাবিতে ে¦¡াগানে প্রতিবাদে সোচ্চার ছিল সেই মিছিল।
সাথে সাথে এই মিছিল কেন্দ্রীয় সরকারের কাছে দাবি তুলেছিল, দেশে যখন চূড়ান্ত বেকার সমস্যা তখন শুধুমাত্র রেলওয়েতে ৮০ হাজার পদ বাতিল করা হয় কোন যুক্তিতে? ‘অগ্নিপথ’ প্রকল্পের নামে এমনকি সেনাবাহিনীতেও দেশের যুবকদের স্থায়ী চাকরি থেকে বঞ্চিত করা হচ্ছে কার স্বার্থে? কেন রেল, ব্যাঙ্ক-বিমা-টেলিকমিউনিকেশন সহ রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থাগুলির বেসরকারিকরণের নামে পুরো দেশকে বিক্রি করে দেওয়া হচ্ছে দেশি-বিদেশি একচেটিয়া পুঁজি মালিকদের কাছে? কার স্বার্থে কর্মী সংকোচন নীতি? কার স্বার্থে শ্রম কোড এর নামে শ্রমিকদের সমস্ত অধিকার ও মর্যাদা কেড়ে নেওয়ার আইন? কেন আজও কৃষকরা ফসলের ন্যায্য মূল্য থেকে বঞ্চিত? পেট্রল-ডিজেল, রান্নার গ্যাস, কেরোসিন সহ নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যের বেলাগাম মূল্যবৃদ্ধি ঘটিয়ে মানুষকে লুঠ করা হচ্ছে কেন? কেন জনসাধারণের সঙ্গে প্রতারণা ও বিশ্বাসঘাতকতা? শাসক দল ও সরকার ধর্ম ও জাতপাতের নামে কেন সাম্প্রদায়িক বিদ্বেষের আগুন জ্বালিয়ে দেওয়ার ষড়যন্তে্র লিপ্ত? মুখে বিরোধিতা করলেও কেন রাজ্য সরকার কেন্দে্রর সর্বনাশা জাতীয় শিক্ষানীতিকে কার্যকর করছে?
আইন অমান্যের দৃপ্ত মিছিল এ সমস্ত জ্বলন্ত প্রশ্নের জবাব চেয়েছিল, প্রতিকার দাবি করেছিল। মিছিলে উত্থাপিত সহজ প্রশ্ন আর যুক্তিসঙ্গত দাবির কোনও উত্তর ছিল না আপাদমস্তক দুর্নীতিতে ডুবে থাকা পুঁজিপতি শ্রেণির স্বার্থরক্ষাকারী এই শাসকদের কাছে। তাই সমস্ত গণতান্ত্রিক রীতিনীতিকে পদদলিত করে রাজ্য সরকার লাঠি, ঢাল, বর্ম, বন্দুক, কাঁদানে গ্যাস ইত্যাদি নিয়ে কাপুরুষের মতো হিংস্র আক্রমণ নামিয়ে এনেছে নিরস্ত্র শান্তিপূর্ণ আন্দোলনকারীদের উপর। প্রতিবাদী ছাত্র-যুবক, শ্রমিক-কৃষক, মহিলারা কিন্তু বুঝিয়ে দিয়েছেন তারা ভীরু নন, আক্রমণের মুখে পিছিয়ে যাওয়ার মতো মানুষও নন। তারা মা’র্বাদ-লেনিনবাদ-কমরেড শিবদাস ঘোষের চিন্তাধারায় উদ্বুদ্ধ। তারা নিরস্ত্র হয়েও পুলিশের নৃশংস আক্রমণকে মোকাবিলা করেছেন। জনজীবনের জ্বলন্ত দাবিগুলিকে উত্থাপন করেছেন। অগণিত মানুষের আশা আকাঙ্খাকে বাস্তবে রূপ দিয়েছেন এই আন্দোলনের মধ্য দিয়ে। তাই তারা রক্তস্নাত হয়েছেন, তবু অন্যায় জুলুমের বিরুদ্ধে মুখর থেকেছে তাদের কণ্ঠস্বর। তাদের মনে ছিল দিল্লির ঐতিহাসিক কৃষক আন্দোলনের সুদৃঢ় প্রত্যয় এবং মহান মা’র্বাদী দার্শনিক কমরেড শিবদাস ঘোষের শিক্ষা– ‘‘… বিপ্লবী আন্দোলন এবং লড়াই যারা গড়ে তোলে, অন্যায়ের বিরুদ্ধে যারা লড়াই শুরু করে, প্রথমে তাদের দিতে হয় বেশি, মরতে হয় বেশি, ত্যাগ করতে হয় বেশি … তাদের মনোভাব থাকে, তারা মরবে তবু অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করবে, … তারা লড়াই ছাড়বে না”। মনে রাখতে হবে, একটা সঠিক আদর্শভিত্তিক আন্দোলনের মধ্য দিয়েই শাসক শ্রেণির আক্রমণকে প্রতিহত করা সম্ভব। তাই আজ প্রয়োজন শহরে, গ্রামে, গঞ্জে একেবারে তৃণমূল স্তর পর্যন্ত ধর্ম-বর্ণ ও দলমত নির্বিশেষে নিষ্পেষিত জনসাধারণের ব্যাপক ঐক্য। গড়ে তুলতে হবে, কেন্দ্র ও রাজ্য সরকারের জনবিরোধী নীতি এবং পুলিশি বর্বরতার বিরুদ্ধে সর্বাত্মক প্রতিবাদ।
সেই প্রতিবাদকে সংগঠিত রূপ দেওয়ার উদ্দেশ্যে শহরে-গঞ্জে গড়ে তুলুন জনসাধারণের সংগ্রামের হাতিয়ার নাগরিক প্রতিরোধ মঞ্চ। গ্রামীণ ক্ষেত্রে গড়ে তুলুন কৃষকদের সংগ্রামী কমিটি। ছাত্র যুব মহিলারাও গড়ে তুলুন সংগ্রামের হাতিয়ার। এর মধ্য দিয়েই গণআন্দোলনকে ধাপে ধাপে উন্নীত করুন। দলের রাজ্য সম্পাদক কমরেড চণ্ডীদাস ভট্টাচার্য এই আহ্বান রেখেছেন।