70 Year 33 Issue 6 April, 2018
‘স্বচ্ছ বদমাস অভিযানের’ নাম শুনেছেন কি? না শুনলে চলে যান যোগী আদিত্যনাথের রাজ্য উত্তরপ্রদেশে৷
ক্ষমতায় এসে এই অভিযান চালিয়ে ‘সাড়া ফেলে’ দিয়েছেন তিনি৷ তাঁর মুখ্যমন্ত্রীত্বে পুলিশকে এমন ক্ষমতা দেওয়া হয়েছে যে, তাদের চোখে যে ‘ক্রিমিনাল’ বলে গণ্য হবে, তাকেই তারা ভুয়ো সংঘর্ষে মেরে ফেলতে পারবে৷
গত এক বছরে পশ্চিম উত্তরপ্রদেশের মিরাট, সামলি, মুজফফরনগর, সাহারানপুর, গাজিয়াবাদ, নয়ডা এবং বাঘপত জেলায় পুলিশ এনকাউন্টারের ঘটনা ঘটেছে ১,১৪২টি৷ জানুয়ারি পর্যন্ত মারা গেছেন ৪৯ জন, গুরুতর আহত ৩৭০–র বেশি৷ প্রতিটি হত্যার ক্ষেত্রেই একই কারণ দেখানো হয়েছে, এমনকী অভিযোগের বয়ানও একই৷ জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের কাছে অভিযোগ জানিয়েছেন নিহতদের পরিবারগুলি৷ একাধিক নিহত ব্যক্তির পরিবারের বিরুদ্ধে চলছে লাগাতার হামলা ও হুমকি৷ মুখ্যমন্ত্রী যোগী আদিত্যনাথ অবশ্য বিধানসভায় সদম্ভে বলেছেন, পুলিশের এনকাউন্টার চলবে৷ ২০১৭ সালের ২২ নভেম্বর এক বিবৃতি দিয়ে তিনি বলেছেন, ‘ক্রিমিনাল উইল বি জেইলড অর কিলড ইন এনকাউন্টারস৷’ তাঁর এই অভয়বাণীতে উৎসাহিত হয়ে ভুয়ো এনকাউন্টারের ঘটনা ঘটিয়েই চলেছে উর্দিধারী গুন্ডাবাহিনী পুলিশ৷
‘কোথাও কোনও এনকাউন্টার নয়৷ সমস্ত মিথ্যা৷ ঠাণ্ডা মাথায় দিনের আলোয় খুন করা হয়েছে আমার ছেলেকে৷’ বলেছেন, আজমগড়ের সন্তান হারানো পিতা শিবপূজন যাদব৷ চিকিৎসার জন্য বাবাকে হাসপাতালে নিয়ে যাবার জন্য বাসস্ট্যান্ডে দাঁড়িয়েছিল ২৭ বছরের জয়হিন্দ৷ ৬ জন লোক তাঁকে জোর করে একটা এসইউভি গাড়িতে তুলে নিয়ে চলে যায়৷ অসুস্থ পিতা বাধা দেওয়ার চেষ্টা করেও ব্যর্থ হন৷ কয়েক ঘণ্টা পরে জানতে পারেন ছেলে ‘এনকাউন্টারে’ মারা গেছে৷ পোস্টমর্টেম রিপোর্টে জয়হিন্দের সারাদেহে ২২টি ক্ষত পাওয়া যায়, তার মধ্যে ১৬–১৮টি আগ্নেয়াস্ত্রের৷ ২০১৭ সালের ঘটনা৷ এ বছর ফেব্রুয়ারিতে বিয়েবাড়ি থেকে ফেরার সময় নয়ডায় দু’জন নাগরিককে পুলিশ সরাসরি গুলি করে৷ একজন মারাত্মকভাবে আহত হয়৷ এই ঘটনাকে ‘সন্ত্রাসবাদীদের সঙ্গে সংঘর্ষ’ বলে কেস ফাইল করে পুলিশ৷ গাজিয়াবাদেও একই ঘটনা৷ রাতে গাড়ি করে পাঁচজন নিকটাত্মীয় বিয়েবাড়ি থেকে ফিরছিলেন৷ পুলিশের জিপ তাদের গাড়ি দাঁড় করিয়ে সন্ত্রাসবাদী অজুহাত দিয়ে গুলি চালায়৷ জিম ট্রেনার ও জুতোর দোকানের মালিক বছর ৩৫–এর জিতেন্দ্র যাদবের গলায় এবং বছর ৩০–এর সুনীল যাদবের পায়ে গুলি লাগে৷ অন্যরাও আহত হন৷ হাসপাতালে মৃত্যুর সাথে পাঞ্জা লড়ছে জিতেন্দ্র৷ পুলিশ পরদিন সাংবাদিক বৈঠক করে এই ঘটনাকে ‘সন্ত্রাসবাদীদের সাথে সংঘর্ষ’ বলে প্রচার করে৷ স্থানীয় মানুষ এর প্রতিবাদ জানালে পুলিশকর্তা বলেন, ওদের নিজেদের মধ্যে সংঘর্ষ হয়েছিল৷ পরে চাপে পড়ে বাধ্য হয়ে এক সাব ইন্সপেক্টর ও তিন কনস্টেবলকে ‘অ্যাটেম্পট টু মার্ডার’ কেসে দোষী সাব্যস্ত করে সাসপেন্ড করা হয়৷
মনে পড়ে যাচ্ছে ইশরাত জাহান, সোহরাবুদ্দিন শেখের হত্যাকাণ্ড একই কায়দায় ‘সন্ত্রাসবাদী’ ছাপ দিয়ে এদের হত্যা করা হয়েছিল গুজরাটের তৎকালীন নরেন্দ্র মোদি সরকারের উদ্যোগে৷ ২০০৪ সালে আহমেদাবাদে পরিকল্পনা করে ইশরাত জাহান ও তার তিন সঙ্গীকে গুজরাত পুলিশ গুলি করে হত্যা করেছিল৷ আর গান্ধীনগরে ছক কষে ঠাণ্ডা মাথায় হত্যা করেছিল সোহরাবুদ্দিন শেখকে সন্ত্রাসবাদীদের সাথে যুক্ত এই অভিযোগ তুলে৷ এমন অসংখ্য ঘটনা ঘটে চলেছে দেশজুড়ে৷ জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের তথ্য অনুযায়ী, এ ধরনের ঘটনার তালিকার শীর্ষে রয়েছে উত্তরপ্রদেশ৷ খুব একটা পিছিয়ে নেই অন্ধ্রপ্রদেশ, ঝাড়খণ্ড, বিহার, মনিপুর ও আসাম৷ দিল্লি এবং জম্মু–কাশ্মীরেও ঘটে চলেছে ভয়ঙ্কর এই মারণযজ্ঞ৷
ক্রিমিনালদের শাস্তি দেওয়া আর পুলিশের মর্জিমাফিক সাধারণ মানুষকে ক্রিমিনাল দাগা দিয়ে গুলি চালিয়ে হত্যা করা কি এক বিষয়? আদিত্যনাথ কথিত ক্রিমিনাল কারা? যারা নিতান্তই সাধারণ মানুষ, দিনযাপন করেন আর পাঁচটা মানুষের মতো, তারাও তাঁর তালিকায় আজ যুক্ত৷ বিজেপির হিংসার রাজনীতি, একপেশে রাজনীতির জন্য যাদের বলি দেওয়া প্রয়োজন, তাঁরাই ‘ক্রিমিনাল’৷
দেশ জুড়ে বিজেপির এই অসহিষ্ণু রাজনীতি, সাম্প্রদায়িক রাজনীতির শিকার মানুষের সংখ্যা ক্রমশ বাড়ছে৷ যাঁরা আদিত্যনাথ কিংবা বিজেপির সমালোচক তাঁদেরকেই ‘ক্রিমিনাল’ তকমা দিয়ে দেওয়া হচ্ছে৷ এমনকী যাঁরা গণতান্ত্রিক চিন্তা–চেতনা নিয়ে চলেন, যাঁরা যুক্তি দিয়ে, কার্য–কারণ সম্পর্কের ভিত্তিতে কোনও বিষয়কে বিচার করেন, যাঁরা অন্ধতা–কুসংস্কারাচ্ছ থেকে দূরে থাকার চেষ্টা করেন, যাঁরা সাম্প্রদায়িক হানাহানির বিরোধিতা করেন, তাঁরাও বিজেপির চোখে ‘ক্রিমিনাল’৷ সাধারণ সংখ্যালঘু মানুষ এদের সফট টার্গেট৷ সফট টার্গেট হিন্দু সমাজের গরিব বা তথাকথিত দলিত অংশের মানুষও৷ এ ভাবে শাসক দলই নির্ধারণ করে দিচ্ছে খারাপ–ভালোর সংজ্ঞা৷ তোমরা আমাদের পক্ষে নও, তাহলে নিশ্চয়ই আমাদের বিরুদ্ধে– যুগে যুগে ফ্যাসিস্ট শাসকদের এই কণ্ঠস্বর এখন প্রতিধ্বনিত বিজেপি–আরএসএস নেতাদের গলায়৷