অর্থনীতির প্রকৃত অবস্থা গোপন করে এতদিন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি ও তাঁর অনুগামীরা জোরের সাথে বলে এসেছেন, ভারতীয় অর্থনীতির কোনও সংকট নেই, অর্থনীতির ভিত্তি খুবই মজবুত৷ কিন্তু অর্থনীতির মারাত্মক রোগটি শেষ পর্যন্ত প্রকট আকারে বেরিয়েই পড়ল৷
রোগটির নাম মন্দা, যা আসলে চাহিদার সংকট৷ ৩০ আগস্ট কেন্দ্রীয় পরিসংখ্যান দপ্তর (এনএসও) প্রকাশিত তথ্যে দেখা যাচ্ছে, এপ্রিল–জুন ত্রৈমাসিকে দেশের মোট উৎপাদন অর্থাৎ জিডিপি বৃদ্ধির হার ব্যাপক পরিমাণ কমে ছ’বছরে সর্বনিম্ন ৫ শতাংশে ঠেকেছে৷ জানুয়ারি–মার্চ এই ত্রৈমাসিকেও যা ছিল ৮.১ শতাংশ৷ মূলত কল–কারখানার উৎপাদন ব্যাপকভাবে কমে যাওয়াতেই অর্থনীতির এই দুর্দশা৷
কেন্দ্রীয় পরিসংখ্যান দপ্তর থেকে শুরু করে সেন্টার ফর মনিটরিং ইন্ডিয়ান ইকনমি, নীতি আয়োগের কর্মকর্তা থেকে রিজার্ভ ব্যাঙ্কের কর্মকর্তা, সকলেই স্বীকার করছেন, ভারতের অর্থনীতি মন্দার করাল গ্রাসে৷ গাড়ি শিল্প থেকে শুরু করে আবাসন শিল্প, বিসুক্ট থেকে অন্যান্য ভোগপণ্য প্রত্যেকটির উৎপাদন যেভাবে কমছে, সাময়িক বা স্থায়ীভাবে কর্মী ছাঁটাই চলছে, তাতে কেন্দ্রের শাসক দল বিজেপির মানা না মানার উপর আর মন্দার তীব্রতা দাঁড়িয়ে নেই– ভারতীয় অর্থনীতি মন্দার গ্রাসে তা অস্বীকার করার উপায় নেই৷
অর্থনীতির এই মরণ দশার কথা কেন্দ্রীয় সরকার প্রকাশ্যে স্বীকার না করলেও রোগ সারাতে হেকিমি–কবিরাজি থেকে তাগা–তাবিজ বাঁধা সবই শুরু করে দিয়েছে৷ প্রথম ধাপে কেন্দ্রীয় অর্থমন্ত্রী নির্মলা সীতারামন বেশ কিছু টোটকা ঘোষণা করেছেন৷ যেমন ব্যাঙ্কগুলিকে সরকারি তহবিল থেকে ৭০ হাজার কোটি টাকার জোগান দেওয়া, বিভিন্ন আর্থিক প্রতিষ্ঠান ও হাউজিং ফিনান্স কর্পোরেশনকে বাড়ি–গাড়ি কেনার জন্য আরও ২৫ হাজার কোটি টাকা দেওয়া, বাজেটে অতি ধনীদের উপর যে অতিরিক্ত সারচার্জ বসানো হয়েছিল তা প্রত্যাহার করে নেওয়া, কর্পোরেট ট্যাক্স কমিয়ে দেওয়া, সরকারি দপ্তরের সমস্ত পুরনো গাড়ি বাতিল করে নতুন গাড়ি কেনার মাধ্যমে খানিকটা চাহিদা তৈরি করা, অতিকায় ধনকুবের কর্পোরেট সংস্থাগুলির মোট মুনাফার যে ২ শতাংশ সামাজিক উন্নয়নে খরচ করার কথা অর্থাৎ কর্পোরেট সোস্যাল রেসপন্সিবিলিটি (সিএসআর), তা লঙঘন করলেও সেটিকে আরপরাধ হিসাবে গণ্য না করা, শ্রমিকদের পাওনাগণ্ডা আত্মসাৎ করা সহ শ্রমিক বিরোধী নানা ভূমিকার কারণে শিল্পপতিদের বিরুদ্ধে দায়ের হওয়া ১৪০০ মামলা প্রত্যাহার করে নেওয়া ইত্যাদি ৩২ দফা দাওয়াইয়ের কথা বলা হয়েছে ধুঁকতে থাকা ভারতীয় পুঁজিবাদী অর্থনীতির আয়ুষ্কাল কিছুটা দীর্ঘায়িত করার জন্য৷
কিন্তু তাতেও অর্থনীতি কতটা শ্বাস নিতে পারবে সে বিষয়ে ঘোরতর সন্দেহ রয়েছে বিজেপি নেতা–মন্ত্রীদের নিজেদের মধ্যেই৷ তাই এই ঘোষণার দিন পাঁচেকের মাথাতেই কেন্দ্রীয় মন্ত্রীসভা আরও কিছু দাওয়াই ঘোষণা করেছে৷ যেমন, দেশের কয়লাখনিতে ১০০ শতাংশ বিদেশি লগ্ণির রাস্তা খুলে দেওয়া হয়েছে৷ এর ফলে দেশের কয়লাখনি থেকে কয়লা তুলে বিক্রি করতে পারবে বিদেশি সংস্থাগুলি৷ ডিজিটাল মিডিয়াতেও ২৬ শতাংশ প্রত্যক্ষ বিদেশি বিনিয়োগের সুযোগ দেওয়ার সিদ্ধান্ত হয়েছে৷ কিন্তু এ সবের দ্বারা কতটুকু বিদেশি লগ্নি আসবে তা নিয়ে আর্থিক বিশেষজ্ঞদের মধ্যেই রয়েছে বহু ধন্ধ৷ কারণ গোটা বিশ্বেই মন্দা৷ তবুও রপ্তানি বাড়ানোর কথা বলে সিঙ্গল ব্র্যান্ড রিটেলে বিদেশি সংস্থাগুলিকে অন লাইনে বিক্রির অনুমোদন দেওয়া হয়েছে৷ এ দেশে দোকান বা শো রুম খোলার যে শর্ত এ ক্ষেত্রে আগে ছিল তা–ও তুলে নেওয়া হয়েছে৷ চিনিকল মালিকদের ৬,২৬৮ কোটি টাকা ভরতুকি দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে সরকার৷ কিন্তু এতে চাহিদা কতটুকু বাড়বে? এ ভাবে ঠেকনা দিয়ে কি পক্ষাঘাতগ্রস্ত অর্থনীতিকে দাঁড় করানো সম্ভব?
সরকার পুঁজিপতিদের জন্য যে এত আর্থিক ত্রাণ প্যাকেজ ঘোষণা করে চলেছে, তার জন্য টাকা পাবে কোথা থেকে? দুটো পথ খোলা– এক) জনগণের উপর বাড়তি ট্যাক্স চাপানো, দুই) রাষ্ট্রায়ত্ত কল–কারখানা–সম্পত্তি বিক্রি করা৷ দুটো প্রক্রিয়াই অবশ্য সরকার চালিয়ে যাচ্ছে৷ কেন্দ্রীয় সরকার ২৫টি বিমানবন্দর বেসরকারি সংস্থার হাতে তুলে দেওয়ার সিদ্ধান্ত পাকা করে ফেলেছে৷ যে ছ’টি বিমানবন্দর ইতিমধ্যেই বেসরকারি হাতে তুলে দেওয়া হয়েছে তার পাঁচটি পেয়েছে বিজেপি ঘনিষ্ঠ আদানি গোষ্ঠী৷ প্রতিরক্ষা শিল্পেও বেসরকারিকরণের লক্ষ্য নিয়ে চলেছে সরকার৷ সেগুলির দখল নেবে আম্বানি, আদানি, টাটা, মাহিন্দ্রা সহ একচেটিয়া পুঁজিপতির দল৷ আরও বহু ক্ষেত্রে সরকার বেসরকারিকরণের নীতি নিয়ে চলছে৷ রেলের বিপুল পরিমাণ জমি বেচে দেওয়ার পরিকল্পনা নিয়েছে সরকার৷ একের পর এক ট্রেন বেসরকারি হাতে তুলে দেওয়া হচ্ছে৷ টিকিটে ভরতুকি ছাঁটাই করা হচ্ছে৷ ছাঁটাই হতে চলেছেন প্রায় ৩ লক্ষ রেল কর্মচারী৷
কিন্তু এভাবে জনগণের উপর ক্রমাগত ট্যাক্সের বোঝা চাপিয়ে, সরকারি সম্পত্তি বেচে অর্থনীতিকে কতদিন অক্সিজেন জোগানো সম্ভব? মুমূর্ষু অর্থনীতিকে বাঁচানোর নামে সরকার যা দিচ্ছে তা তো সবই পুঁজিপতিদের পকেটে যাচ্ছে৷ অর্থনীতির এই সংকটটা কি পুঁজির অভাবে? বাস্তবে সংকটটা তো উৎপাদনের নয়৷ রিজার্ভ ব্যাঙ্কের গভর্নর থাকাকালীন মন্দার অবস্থা বোঝাতে রঘুরাম রাজন বলেছিলেন যে, দেশের মোট উৎপাদন ক্ষমতার মাত্র এক–তৃতীয়াংশ ব্যবহার হচ্ছে৷ অর্থাৎ দেশের মানুষের জীবনযাপনের জন্য প্রয়োজনীয় সামগ্রীর সামান্যতম অংশ না মেটা সত্ত্বেও দুই–তৃতীয়াংশ উৎপাদন ক্ষমতা অব্যবহৃত হয়ে পড়ে থাকছে৷ তা হলে সংকটটা তো বাজারের৷ কারণ বাজারে ক্রেতা নেই৷ এই ক্রেতা কারা? দেশের জনগণ৷ সেই জনগণ এমনই আর্থিক দুর্দশার মধ্যে দিন কাটাচ্ছে যে তাদের শিল্পদ্রব্য কেনার মতো ক্ষমতাই নেই৷ তা হলে তো সরকারের উচিত জনগণের ক্রয়ক্ষমতা বাড়ানোর পরিকল্পনা করা৷ সরকার তা করছে না কেন? কেন তাদের উপর চাপাচ্ছে আরও ছাঁটাই, মূল্যবৃদ্ধি, করের বোঝা?
দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষ কৃষিকাজের সঙ্গে যুক্ত৷ সেই কৃষির অবস্থা কী? কৃষি অর্থনীতিও পুঁজিবাদী ব্যবস্থার অধীন হওয়ায় কৃষকরা ফসলের যা দাম পায় তাতে বিপুল খরচ মিটিয়ে তাদের হাতে অধিকাংশ সময়ই কিছু থাকে না৷ বরং ঋণগ্রস্ত হয়ে পড়ে ধান, আলু, আখ, তুলো, সয়াবিন চাষিরা লাখে লাখে আত্মহত্যা করছে৷ এরই ফলে দেশের গ্রামীণ বাজার ধুঁকছে৷ সরকার বাজার চাঙ্গা করতে চাইলে তো সার বীজ কীটনাশক বিদ্যুতের দাম কমিয়ে ফসলের লাভজনক দামের ব্যবস্থা করত৷ তা কেন করছে না? মোটর গাড়ি থেকে ভোগ্যপণ্য, উৎপাদন শিল্পে মন্দা মারাত্মক আকার নিয়েছে৷ লক্ষ লক্ষ কর্মী ছাঁটাই হচ্ছে৷ যা বাজারকে আরও সংকুচিত করে দিচ্ছে৷ যাদের এখনও কাজ আছে তাদের জন্য সরকার কতটুকু বেতন বরাদ্দ করেছে? দৈনিক ১৭৮ টাকা৷ এই বিরাট অংসগঠিত শ্রমিকরা তো বাজারেরই অংশ৷ সরকার বাজার চাঙ্গা করতে চাইলে তো শ্রমিক শ্রেণির বেতন বাড়িয়ে তাঁদের হাতে আরও বেশি অর্থের জোগানের ব্যবস্থা করত৷ তা তো কই করল না দেশে বেকারি বৃদ্ধির হার গত ৪৫ বছরে সর্বোচ্চ হয়েছে৷ এই কোটি কোটি বেকারের ক্রয়ক্ষমতা তো প্রায় কিছুই নেই৷ এঁদের জন্য সরকার কী ব্যবস্থা করল? কিছুই না৷ জনগণের হাতে অর্থ জোগানোর পরিবর্তে পুঁজিপতিদের পকেটেই আরও অর্থ ঢেলে চলেছে সরকার৷ যা আসলে গোড়া কেটে আগায় জল ঢালা ছাড়া আর কিছু নয়৷ এর দ্বারা বাজার চাঙ্গা হতে পারে কি? অবশ্য সরকারি ত্রাণ প্রকল্পে পুঁজিপতিদের মুনাফার ঘাটতি মিটে যাবে৷ তার মানে মন্দার আক্রমণে পুঁজিপতিদের কোনও ক্ষতি নেই৷ বরং সরকারি বদান্যতায় তাদের লাভ অটুট থাকবে৷ মন্ত্রী–আমলা–অফিসার গায়ে মন্দার আঁচ লাগবে না৷ ছাঁটাই শ্রমিক, অভুক্ত কৃষকের করের অর্থে তাদের চর্ব্য–চোষ্য–লেহ্য–পেয়-তে কোনও ঘাটতি পড়বে না৷ মন্দার ফল ভোগ করবে শুধু শ্রমিক–কৃষক সহ মধ্যবিত্ত–নিম্নবিত্ত-দরিদ্র জনগণ৷
আসলে পুঁজিবাদী সমাজ ব্যবস্থায় পুঁজিপতি শ্রেণির অর্থে পরিপুষ্ট তাদেরই পলিটিক্যাল ম্যানেজার হিসাবে কাজ করা বুর্জোয়া দলগুলি ও তাদের সরকার পুঁজিপতিদেরই স্বার্থ দেখে, জনগণের নয়৷ তাই ত্রাণপ্রকল্প পুঁজিপতিদের জন্যই বরাদ্দ হচ্ছে, জনগণের জন্য নয়৷ জনগণের উপর চাপছে আরও বোঝা৷ এই অবস্থায় শ্রমিক–কৃষক সহ জনগণের কর্তব্য কী? তারা কি শুধু পড়ে পড়ে মার খাবে? না৷ এর বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ ভাবে রুখে দাঁড়াতে হবে৷ বাঁচার দাবিগুলি নিয়ে গড়ে তুলতে হবে তীব্র আন্দোলন৷ সরকারকে বাধ্য করতে হবে দাবি মানতে৷ শোষিত মানুষ যাতে সরকার এবং পুঁজিপতি শ্রেণির এই জঘন্য স্বৈরাচারের বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ ভাবে রুখে দাঁড়াতে না পারে তার জন্যই তাদের ধর্মে–বর্ণে ভাগ করে দেওয়ার এত ষড়যন্ত্র৷ এই ষড়যন্ত্রকে রুখে দিয়ে সচেতন সংগ্রাম গড়ে তোলাই আজ সময়ের ডাক৷ সেই ডাকে সাড়া দিতে হবে প্রতিটি শোষিত মানুষকে৷